May 30, 2019 | সাহিত্য
কাঁদতে কাঁদতে আমার হৃদয় পাথর! ভালোবাসাহীন! আমার পাষান হাতে রক্ত দেখে, জানি তোমারা সবাই আমাকে আজ চেন, ঘৃণা করবে! আমি অপরাধী! খুন করেছি! খুন হয়েছি ৫১ বছর!
সবাই আমাকে খুন করেছো! ভালোবাসোনি! ভেবেছ- আমি তোমাদের কেউ নই, এক অপ্রত্যাশিত ঝামেলা! একাকিত্বে আমার হৃদয়, ছেলেবেলা থেকে ক্ষতবিক্ষত! কেউ আমার সঙ্গে একটু কথা বলনি, কেউ আমার কথা শুননি!
এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই! মা স্কুলে যাবার আগে কখনো পোষাক পড়িয়ে দেয়নি! পিতা কখনো আমাকে আইক্রিম কিনে দেয়নি। ভাই-বোন কেউ খেলেনি! নেই! আমি এক অদ্ভুত এতিম!
জন্ম হলো! পিতা-মাতা আমাকে ত্যাগ করলো! তাদের সঙ্গে আমার একটি ছবিও নেই! বড় হলাম দাদীর ঘরে। দাদা-দাদীও কখনো আমার সঙ্গে ছবি তোলেনি। অথচ চাচা-জেঠার ঘরে, পিসতু ভাই-বোনের হাসিভরা কত ছবি। তাদের জীবনে কত সুখ, কত ভালোবাসা! অথচ কেউ আমার সঙ্গে প্রাণ খুলে হাসতো না! সবাই যেন আমাকে পরাজিত দেখে খুশী হতো!
দাদী আমাকে ভাত দিয়েছে ঠিকই; কিন্ত প্রতিটি দানা’র জন্য- প্রতিদিন খোটা খেয়েছি। আমি যেন ভাত খাইনি কখনো, পাথর খেয়েছি! তার দেয়া পোষাককে আমার মনেহতো, বন্য সরীসৃপের চামড়ার তৈরী কাপড়, আদরহীন! শাসনের অতি তাপে-চাপে; বুকের গহীনে সব সময় উনুনু জ্বলতো! বকা-ঝকার ভয়ে কাতর থাকতাম!
বাবা-মা মিথ্যা আবেগে, যৌনক্ষুধায় উদ্রান্ত হয়ে সংসার ভাঙ্গলো! আমাকে ত্যাগ করলো! নতুন সংসার পাতলো! ছেলের কোন খবর নেয়নি কেউ কোন দিন!
– কি খাই? কি পরি? কোথায় থাকি? কি আমার ভবিষৎ? কখনো তারা ভাবেনি। অদৃশে্য মিশে গেছে তারা!
জীবনের প্রতিটি দিন কেটেছে আমার অবচেতনে, অমনোযোগে। বাঁচার প্রতি আগ্রহের একটি আঙ্কুরও গঁজাতে পারেনি হৃদয়ে। পড়তে চেয়েছিলাম কারিতাসে, ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে! দিদিমা খোটা দিলেন,
– কে তোর হাতীর খরচ দিবে, হারামজাদা?
চাচাতো ভাই-বোনেরা কারিতাস স্কুলে গেল! আমি গেলাম সাধারণ স্কুলে! প্রতিদিন পিসতুদের সাথী হয়ে স্কুলে যাই! পথে আমি বিভক্ত হয়ে চলে যাই – প্রাইমারীতে আর ওরা কারিতাস! আমিও তো ওদের মতো হতে চেয়েছিলাম!
আমার হৃদরের হাহাকার, ভালোবাসার পিপাসা, বেঁচে থাকার চিৎকার, বড় হবার আগ্রহ কেউ শুনেনি কোনদিন! ঐ সুন্দুর স্কুল আমাকে প্রতিদিন রুদ্র করেছে, কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে আমার ভবিষত! জাগিয়েছে হিংসার হুঙ্কার, না পাওয়ার কষ্ট! আমি ঐ স্কুলে যেতে পারিনি, কাউকে যেতে দিব না!
– এই দেখ, আমার হাতে- আমার রক্ত! কেউ আমাকে থামাতে পারবে না!
এ বলে কাঁদতে কাঁদতে, ছুড়ি চালিয়ে শিক্ষার্থীদের আঘাত করে ছেলেটি! এক সময় মাটি লুটিয়ে পড়লো। হাত থেকে পড়ে গেলে ধারালো চাকু, অশ্রুধারা! হাউমাউ আহারাজি করে,
– আমার মতো, কোন সন্তান যেন পিতা-মাতা ছাড়া বড় না হয়! কারো হৃদয় যেন ভালোবাসাহীন না থাকে! কারো অন্তরে যেন পশুর হিংস্রতা জেগে না উঠে!
কাউসাকি বাসষ্টপে সাত-সকালে স্কুলগাশী শিক্ষার্থীদের লাশের সারি দেখে সবাই হতবাক! পুলিশ আসলো! তদন্ত শুরু হলো! সতি্যই পুলিশ তার অতীতের কোন ছবি খুঁজে পেল না! খোঁজে পেল না ভালোবাসার খাতা! খুনের রহস্য উৎঘাটনে তদন্ত চলছে!
বি.দ্র.: কাওয়াসাকি অঘটনের খলনায়ক ‘রয়োচি আইওয়াসাকি’র কাল্পনিক ভাষ্য!
—-
নিগাতা, জাপান
৩০ মে, ২০১৯
Apr 8, 2019 | সাহিত্য
একটি সুরিয়ালিষ্টিক ছোটগল্প।
——————
আকাশ থেকে ঐ দূর পাড়াড়ের চূঁড়ায় নেমে আসে এক অশরীরি! মাথায় তার আলোকিত অরা! গায়ে শুভ্রতা! দূর থেকে ডাকছে,
– হে তানসি, একটু দাঁড়াও! আমি আসছি। ভয় পেও না!
নিঘুম এই ভয়ার্ত গভীর রাতে, অপ্রত্যাশিত ডাকে – তানসির ভয়ের মাত্রাটা আরো বেড়ে যায়! এখন আর একাকিত্ত্বের শোক নেই! প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে আছে! গায়ে চিমটি কেটে তানসি চেতন পরীক্ষা করে!
দোতলায় তানসির শোবার ঘর থেকে স্বর্ণদ্বীপের পুরো দিগন্ত দেখা যায়! ঠিক পাহাড়ের প্রান্তসীমা পর্যন্ত! তাদের বাড়ির পর মাঝে কোন ঘরবাড়ি নেই! শুধু ফসলের মাঠ!
জোসনা রাত! সুনশান নীরবতা। জোসনা রাতে আকাশে পাখী উড়ে কিনা, দেখতে গিয়ে – তানসির এই মহাবিপদ! ইচ্ছা থাকার পরেও দরজা বন্ধ করতে পরছে না! অশরীরি যদি পিছন থেকে আসে, ক্ষ্যাঁপে আক্রমন করে। হাত-পা কাঁপতে থাকলেও, সাহসীর ভাব নিয়ে, তানসি সবকিছু দেখেও না দেখার, শোনেও না শোনার ভান করে, দাঁড়িয়ে থাকে! তানসি শুনেছে,
– ভূত বা অশরীরিরা ক্ষ্যাঁপে গেলে নাকি বেশী ক্ষতি করে!
বিজ্ঞান পড়ুয়া, তানসির ভূতে বিশ্বাস নেই, তারপরও চারদিকের আলো পরীক্ষা করে! আলোর অনেক কমতি! মেঘ গুলো বারবার চাঁদমূখ ঢেকে দিচ্ছে! জোসনা যেন একবার নিভে, আরেকবার জ্বলে!
দেখে সত্যিই আলোক দেহটি আস্তে আস্তে, অদ্ভুদ শব্দ করতে করতে কাছে আসছে! জানলার পাশে, ফুল গাছের কাছে আসতেই তানসি আর কিছুই দেখতে পায় না! ভয়ে চোখ-মুখ চরক গাছে! ভয় আর ধূয়া চারদিক যেন গ্রাস করে ফেলেছে! হঠাৎ লাফ দিয়ে অশরীরি আলোকদেহটি তানসির শরীরের ভিতর ঢুকে পড়ে। ভয়ে তানসি জ্ঞান হারিযে ফেলে! ক্লান্তদেহে ঘুমিয়ে পড়ে মেঝেতেই! স্বপ্নে দেখে এক শুদ্ধপুরুষ বলছে,
– কাকে ভয় পাচ্ছে? আমি তো তুমি! অন্য কেউ নই! তোমার সঙ্গে থাকবো না তো কার সঙ্গে থাকবো?
উষার আলো চোখে পড়ে তানসির ঘুম ভাঙ্গলো। অপূর্ব এক নতুন অনুভূতিতে জানালার পাশে দাঁড়াতেই দেখে, গাছে অপূর্ব সাকুরার সমারোহ। হৃদয়ে কোন ভয় নেই! চারদিক যেন স্বর্গ! শুদ্ধতা! জীবনটা যেমন দরকার ছিল – ঠিক তেমনই হয়ে গেছে! নীরবতার ভাষায় সম্মতি দিতেই আনন্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে! ভালোবাসা আর মিলনে পুরো সত্ত্বা আবেশিত হয়ে যায়! হৃদয়ে বেজে উঠে পূর্ণতার গান!
Jan 10, 1994 | সাহিত্য
এত ব্যস্ততাতেও মিন্টু ভুলিনি- ভোরের শিশির ভেজা বেলির হাসি, বাগানবিলাসীর রাত্রিজাগা ভালোবাসা, কারেরীর আয়ত চোখের লাজুক আবেদন। শাহাবাগের আঙ্গিনায়, মোড় বৃত্তে যন্ত্র দানবগুলো ঘুৎ ঘুৎ করে অবিরত ঘুরছে। কারো ক্লান্তি নেই! অনুভূতি যেন ভোতা! অকারণে সবাই যেন ব্যস্ত! ভাবটা এমন – একটু দেরী হলেই স্বর্গ হাত ছাড়া হয়ে যাবে! পেট্রোল পোড়ার গন্ধে, ধূয়োর ধুম্রজালে- স্বর্গযাত্রীরা ভুলেই গেছে- স্বর্গ এই শহরে নয়; গ্রামে! নদীর তীরে, কাশবনে, আগুনলাগা উষায়, পাখির গানে, ঝরনার স্রোতে!
শাহবাগে ইউনিভার্সিটির বাস আসতে আরো সময় লাগবে! তাড়া নেই! সিগ্রেটের ধুয়োর স্রোতে সকল অবসাদ ভাসিয়ে দিতে মন চায়! এমন সময় দৃষ্টিতে পড়ে, চাপা কামিজ পরা ষোড়শী ফুলকন্যার হাসি। ফুলের মুহু মুহু সৌরভে নিয়ে সে ঘুরছে। এদিক ওদিক ঘুরছে, ফুল ফেরি করছে। মোড়ে পার্ক করা ‘টাউন সাভিস’ ড্রাইভারের ইশারায় ফুলকন্যা কাছে যায়। কতক্ষন ফিস ফিস আলাপ শেষে, ড্রাইভার হাক দেয়,
– আজ আইমু! রেডি থাকিস!
ফুলকন্যার ত্বকের মসৃণতা, টেনে চুলবাঁধার বাহার, অমায়িক হাসি; আর বাঁশপাতা কামিজে ভাঁজপড়া যৌবন মিন্টুকে এক জগত থেকে অন্যজগতে নিয়ে যায়! সংসারী হওয়ায় আবেগ জাগায়। ফুলকন্যা আর ড্রাইভারকে, কয়েরকবার এপাশ ওপাশ করে দেখে। সম্পর্কটা বুঝার চেষ্টা করে। ড্রাইভারকে কয়েকবার লুঙ্গি আওয়াতে দেখে ভিতরটায়, কেন যেন মুচড়ে উঠে! সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে! সকল ‘টাউন সার্ভিসে’ আগুণ দিতে মন চায়। মন চায় ময়লা নোটে তাবত ফুল কিনে নিতে! বন্ধি ফুলকন্যাকে মুক্ত করতে। ঘোমটা পড়িয়ে ঘরে তুলতে।
ইচ্ছা অঙ্কুরেই ব্যর্থ হয়! কল্পনা বেশী দূর এগোয় না! হৃদয় ক্লান্ত হয়ে যায়,
– হে ফুলকন্যা, তুমি আমার! তুমি যোগ্য! কিন্তু দুঃখিত- তোমায় ঘরে তুলতে পারবো না! এ সমাজ মেনে নিবে না! তুমি যে দ্ররিদ্র! আমি তো ধনীর দুলাল! আমি তো ধনীগিরি শোষন-শাসনকে দুধেভাতে লালন করি!
একটু বেশী মনযোগী হতেই, মিন্টু ফুলকন্যার নগ্ন পায়ের দিকে নজর পড়ে! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহপাঠি বলে,
– কি দেখ? ঐ মাইডা কিন্তু খারাপ, জলবেশ্যা! দিনে ফুল বেছে আর রাইতে ফুল ফুটায়! হা হা হা…
– ক্যামনে বুঝলা?
– ওর খালি পা দেইখ্যা! এরা ইচ্ছা করেই সেন্ডেল পড়ে না! যারা এই লাইনের, তারা বুঝে যায়!
মেয়েটা কয়েকবার তাকিয়ে মিন্টুর মনোযোগ নেয়ার চেষ্টা করে! ব্যার্থ হয়ে রাস্তার ওপারে চলে যায়। হৃদয়ে ভালোবাসা আর আত্নকেন্দ্রিকতা ঝগড়া উঠে!
– এত সুন্দরী মেয়ে! এ পথে কেন?
ফুলকন্যার বিদায়ের সাথে সাথে বুক থেকে বিদায় নেয় ক্ষনিকের ভালোবাসা। মিলিয়ে যায় নেকড়ের সঙ্গে ফুলওয়ালীর হাসির জটিলতার প্রশ্ন। কল্পনায় ভেসে উঠে, গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আরেক পছন্দ কাবেরীর হাসিমুখ!
– ধনীর দুলালি কারেরী কি আমাকে গ্রহন করবে? দুনিয়াটা বড়ই জটিল! সব মানুষই নিজের চেয়ে ধনী, নিজের চেয়ে বড় মানুষের সঙ্গে আত্নীয়তা করতে চায়!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১০ই জানুয়ারী, ১৯৯৪