Friendship forever!

Friendship forever!

With my mentor Shahid Ullah bhai during crossing river for research work on Climate Change Adaptation in Morrelgong, Bagerhat District. Shaid bhai is a devoted development researcher, social scientist, and activist. I enjoy his good contact always, however, love to debate with him with joking on contemporary issues.

It needs to mention, after my university education in Geology, I got the chance to work and learn with Shahid Ullah on the human rights and development issues ( 1995-2000). The opportunity helped me to fill up the gap of social-science knowledge. Once we tried to practice together the regenerative agriculture ( Masanobu Fukuoka Method ) and ‘People Participatory Process’ in Tagoregaon (1997). During staying together he openly shared many experiences and his views that helped me to analysis the social issues critically and deeply. In the early period of my career development, his help was very needed, however, encouraged me a lot in different ways.

I will never forget his contribution in my life. Still, his suggestions give me the power to move ahead. After many years, last month we got a chance to work together again for making a documentary film.

Photo Credit // Jahangir Alam

জাপানি চোর

জাপানি চোর

সাদো টিভিতে একটা স্ক‍্যালিং উঠছে, একজন সরকারী অফিসার – শপিংমল থেকে ৩০০০ ইয়েনের ( ৩০ ডলার) খাদ‍্য চুরি করে ধরা পড়েছে! অল্প দামের একটি চুরি, হয়তো ভুল বা স্বভাব লোকটি’র কপাল ভাঙ্গলো!

জাপানে চুরি শান্তি খবুই সরল – জরিমানা ও ন‍্যাশনাল ডাটাবেইজে – ‘চোর’ অর্থাৎ অপরাধী হিসাবে তালিকাভুক্ত হওয়া।

জানলাম, লোকটির প্রথমিক শাস্তি হবে – চাকুরী থেকে বিতারণ! এরপর, জরিমানা – অনাদায়ে জেল এবং সারাজীবনের জন‍্য চোর হিসাবে অফিসিয়াল কলঙ্ক। আর সহজে চাকুরী বা কাজ পাওয়া যাবে না, চাকুরীর আবেদন – এমনকি ব‍্যবসা করার চেষ্টা করলেও পদে পদে প্রশ্ন ও বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে।

ছেলে-মেয়ে-আত্নীয় স্বজনও ঘৃণা করবে, এড়িয়ে চলবে! কারণ তাদেরকেও সমাজে, স্কুল-কলেজ, চাকুরি ও অফিসে আইডেনটিফিকেশনের সময় প্রশ্নের সম্মুখী হতে হবে! ফলত – অনেক চোর আত্নহত‍্যা ও এলাকা ত‍্যাগ করে বাঁচার ব‍্যর্থ চেষ্টা করে! কিন্তু সার দেশে তার অবস্থান একই! ! তাই ধরা-পড়া চোরের নিভৃত ও একাকিত্ব জীবনই একমাত্র পথ! হয়তো এই কারণেই অতি অভাবীরাও চুরি-ডাকাতি করে না! যারা করে, আসলেই তারা চোর ও বাটপার, শরম-লজ্জ্বা কম!

আমি ১৩-১৪ বছর ধরে নিয়মিত জাপানে আসি; দীর্ঘ এই সময়ে আমি মাত্র দুই বার চুরির সংবাদ শুনলাম! জাপানের বাড়ি ও দোকান বেশ নিরাপ্ত্তা সুরক্ষিত! শপিং মলে – ক‍্যামেরা থাকলেও, সাধারণত ওটার চেয়ে নাকি জাপানীদের নৈতিক শিক্ষা বেশী কার্যকর।

মধ‍্যপ্রাচ‍্যের দেশগুলো যেখানে হাত কেটে, অঙ্গচ্ছেদ করে চুরি বন্ধ করতে পারেনি, জাপান শুধু নৈতিক শিক্ষা দিয়ে তা চুরি প্রায় বন্ধ করে ফেলেছে!

জাপানের স্কুলে, অক্ষর শেখানোর আগে জাপানে শিক্ষা দেয়া হয় – চুরি না করা, অন‍্যের ক্ষতি না করা, সঠিক ভাবে হাগা-মুতা ও খাদ‍্য খাওয়া!

এক সময় জাপানী প্রধানমন্ত্রী ও আমলারা ঘুষ খাওয়ায় চ‍্যাম্পিয়ান ছিল। তাই ঘন ঘন প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রীর পদত‍্যাগ হতো। এখন এটাও কমে গেছে – মুল কারণ; আইনের শাসন, শাক্তিশালী মিডিয়া, নৈতিক শিক্ষা আর ধরা পড়লে- সে যেই হোক সর্বনাশ – ক্ষতিপূরনের পাশাপাশি সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয়!

‘ডিজিট‍াল বাংলাদেশ’ আন্দোলন আমার প্রাণে এক সময় আশার আলো জ্বালিয়ে ছিল! ভেবেছিলাম – সরকার প্রথম যে কাজটি করবেন, তা হবে ‘ন‍্যাশনাল ডাটাবেইজ তৈরী। দেশের প্রতিটি নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ তথ‍্য সংরক্ষন ও সঠিক ভাবে ব‍্যবহার। কিন্তু তা আজও হলো না!

দেশের নাগরিক, অফিসার, মন্ত্রী-আমলা প্রমুখের সুকর্ম-কুকর্ম রের্কড থাকলে, রের্কড অনুসারে ‘রিওয়ার্ড ও পানিশমেন্ট’এর ব‍্যবস্থা নেয়া যায়। এর ফলে দ্রুত অপরাধ কমে যেতে পারে – আইনের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজ থেকেও অপরাধীর চাপ আসবে। মেয়ে-মেয়েরা হয়তো বলবে,
– বাবা/ মা, ঘুষ-চুরি-দূনীতি বন্ধ কর! আমরা চোরের সন্তান হিসাবে বড় হতে চাই না!

একদিন, আমি এক সন্তের লেকচারে যোগদিয়েছিলা। সন্ত বারবার শয়তানের প্রসঙ্গে আনছিলো। আমি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাগা করেছিলাম, ‘স‍্যার, আপনি লেকচারে বার বার শুধু শয়তানের প্রসঙ্গ বলেছেন কেন? শয়তান কিভাবে কাজ করে?
কিছুক্ষন চুপ থাকার পর সন্ত বললেন,
– শয়তানের মুল কাজ, ‘গুড এন্ড ইবিল’ মিশিত করে ফেলা, মানুষকে কনফিওশনে ফেলে দেয়া! তাহলে মানুষের সঠিক পথে চলতে পারবে না, সমাজ উন্নত হবে না, অধিকাংশই পথহারা হবে!

আমার মনেহয়, আমরা সেই ভ্রান্তিতেই আছি! এখন, ডিজিট‍্যাল বাংলাদেশ; উন্নত দেশ গুলোর মতো যদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সঠিক ও পূর্ণ ডাটাবেইজ বানায়- আমরা চুরি, ঘুষ-দূনীতি, শয়তানের শয়তানি থেকে সহজে মুক্তি পেতে পারি!
সুখের কথা বাংলায় – “সুকর্মের জন‍্য পুরুস্কার ও কুকর্মের জন‍্য ধীক্কার”এর সংস্কৃতি চালু হবে! জাপানের মতো বাংলাদেশের সমাজেও স্বস্তি আসবে!

কপিরাইট ও বই প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশে শুভঙ্করি

কপিরাইট ও বই প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশে শুভঙ্করি

“কপিরাইট: শিল্পী-লেখকরাও ‘সচেতন নন” মাননীয় সংস্কৃতি মন্ত্রীর কথাটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৯৯% সঠিক! ইউরোপ-আমেরিকা-জাপানে, এই ডিজিটালের যুগেও কেউ অনুমতি ছাড়া কোন শিল্পীর শিল্প বা লেখা প্রকাশ তো পরের কথা , ব‍্যবহারও করে না। লেখক-শিল্পীরাও ছাড়ে না – ধরা পড়লে কেইস ফাইল ও সরকারের মাধ‍্যমেই উপযুক্ত জরিমানা!
 
‘কপিরাইট’ আসলে সংস্কৃতি, সভ‍্যতা – অন‍্যের জিনিষ চুরি বা গ্রাস না করার সুঅভ‍্যাস! যা গড়ে উঠতে সময় লাগে! বাংলাদেশ – স্বভাবটা মনেহয় ইন্ডিয়া থেকে পেয়েছে! হিন্দি গানের ও ছবি বিনামূল‍্যে উত্তাপ ছড়ানো আগে বাংলাদেশের বাজার ছোট থাকলেও অবস্থা এত খারাপ ছিল না!
 
বাংলাদেশে // গান, বই বিক্রি, সিডি, ফটো এমনকি ফেইজবুক ষ্ট‍্যাটাসের কপি দেখলে বুঝা যায় – কি করুণ অবস্থায় আছেন আমাদের লেখক ও শিল্পীগন।
 
গত বই মেলায় ”জাপান স্মৃতি বাংলা প্রীতি’ নামের বইটা প্রকাশ করার ইচ্ছা করেছিলাম। কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সবই বললো – সুন্দর থীম, লেখা গুলোও বেশ ভালো। পাঠক প্রিয় হবে। কিন্তু স‍্যার, ছাপার খরচটা আপনাকে দিতে হবে। আমি বললাম – কত টাকা লাগবে? কত কপি ছাপাবেন?
প্রকাশক বললো – আপনি জাপানে থাকেন, টাকা অভাব তো আপনার নাই! ৫০ হাজার দিলেই হবে? ১০০০ কপি ছাপাবো, পরে চললে আরো ছাপাবো…
 
আমি বললাম – আর কপিরাইট? কষ্ট করে লিখলাম – আমাকে কিছু দিবেন না?
এই প্রসঙ্গ আনতেই প্রকাশক মিয়া বললেন – স‍্যার, এবার থাক, সময় কম! আগামীবার প্রকাশ কইরেন! ….
আমি জানি, আমার কপালে আগামীবার আর আসবে না ! বই প্রকাশ করতে চাইলে, টাকা আমাকে দিতেই হবে! প্রথম বই ‘আশার আলো’ টাকা দিয়েই প্রকাশ করতে হয়েছিল!
 
“হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে…. ” কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।
 
ভাবছি, জাপান থেকেই প্রকাশ করবো। এতে খরচ নিয়ে শুভঙ্করী হবে না, চললে – কপিরাইটের পুরো লাভটা পাবো! বাংলা বলে, প্রচার সংখ‍্য হয়তো একটু কম হবে!
জাপানী বাড়ি, টুনটুনির বাড়ি

জাপানী বাড়ি, টুনটুনির বাড়ি

জাপানী বাড়ি মানেই টুনটুনির বাসা! শুধু বাড়ি না, সব কিছুই যত সম্ভব ছোট ও যথাযথ বানানো জাপানীদের নৈপূন‍্য!

জেন গার্ডেন সহ জাপানী ট‍‍্যাডিশনাল বাড়ি আমার খুব পছন্দ। সেরকম একটি বাড়িও সিলেক্টও করেছিলাম! কিন্তু পুত্র-কণ‍্যার পছন্দ অাধুনিক বাড়ি! ওরা বলে – বাবা, ট‍্যাডিশনাল বাড়ি বড় ও সুন্দর হলেও ঠান্ডা ও স্বাস্থ‍্যকর না। তাই গণতন্ত্র মোতাবেক আধুনিক বাড়িতেই উঠতে হচ্ছে।

৮০০-৯০০ বর্গফুটের জায়গায় তিনতলা বাড়ী! ছোট আকার দেখে প্রথম আমার পছন্দ হয়নি, লিলিপুটের বাড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু ভিতরে এসে মন বদলে গেল ! পাঁচতাঁরা হোটেলের প্রায় সব সুবিধাই আছে কাঠ-ষ্টিল-কনক্রিটের তৈরী ছোট বাড়ীতে – পরিপাটি লিভিং রুম, অটো বাথটপ, ইলেকট্রনিক চুলা, টয়লেট, সংক্রিয় লাইটিং, হিট কন্ট্রোল ইত‍্যাদি।

এক সপ্তাহ ধরে রিমোটের বোতাম গুলোর ফাংশন মুখস্ত করা চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন মতেই বশে আনতে পারছি না। ইলেকট্রনিক চুলার বোতামে কথা শুনে না । টয়লেটে – শুচুর সময় প্রায়শ মতুর জায়গায় চাপ দিয়ে দেই…ভাষার পাশাপাশি, টেকনোলজিক‍্যাল সংস্কৃতি ঝামেলায় আছি। রপ্ত করতে হয়তো আরো কয়েকদিন লেগে যাবে!
বাড়ি পরিবর্তন নিয়ে ঝামেলা আমাকে সাধারনত পোহাতে হয় না। এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি ঢাকাতে ছোট ভাইয়ের উপর দিয়ে সাধারনত যায়! কিন্তু এবার আমার উপর দিয়ে গেল। ১০ দিন ধরে জিনিষ আনছি, শেষ যেন হয় না। আমি যে এত বইয়ের মালিক বাড়ি পরির্বতন না করলে হয়তো বুঝতামই না!

উল্লেখ‍্য, জাপান আয়তনে বাংলাদেশে প্রায় তিনগুণ হলেও জনসংখ‍্যা প্রায় সমান। জায়গার অভাব জাপানে নেই, তারপরও এরা ছোট ছোট বাড়ি বানায় – মুল কারণ ভুমিকম্প থেকে সুরক্ষা, চাকর-বাকর ছাড়াই নিজের বাড়ী নিজে পরিস্কার রাখা! ঝামেলা মুক্ত সহজ ও অাধুনিক জীবন যাপন করা। জাপানী বাস্তুসংস্থান কৌশল বাংলাদেশে প্রয়োগ করা দরকার! এতে যেমন বাড়ি বানানো খরচ কমবে, টাকা ওয়ালাদের ফ্লাট-গাড়ী কেন্দ্রিক মিথ‍্যা অহংকার-নবাবী কমবে, সুবিধা না দিয়ে ভাড়াটেদের প‍্যাকেট কাটার দৌরত্ন‍্যও কমবে। সমতা আনার মানসিকতা ও পরিবেশ সৃষ্টি হবে!

এসো হে নারী সমতার পথে।

এসো হে নারী সমতার পথে।

‘নূপুর নয়, তরুনাস্থির ঝনকার বাজানোর সময় এসেছে নারীর”

পুরুষের সমান শক্তি, সার্মথ‍্য ও যোগ‍্যতার জন‍্য জাপানী নারীদের মত বাংলার নারীরা যদি আস্থার সাথে সব কাজ করে; অর্থ ও ক্ষমতার সাথে সাথে সমতা আসবেই। জাপানের প্রায় সব নারীই শরীর স্বাস্থ‍্য ও মনের সুস্থ‍তার জন‍্য নিয়মিত ব‍্যায়াম- অন্ততঃ খালি হাতের শরীর চর্চ্চা ‘রাজু টাইসো’ চর্চ্চা করতে ভুলে না । পোষাকও পড়ে হালকা, শরীর, সজ্জ্বা, ঋতু ও কাজ বান্ধব।

Exercise is the popular culture among to Japanese women and girls. They love it for good health, good mind, good spirit and BEAUTY as well.

জাপানে ভাষা আন্দোলন- সাফল‍্য ও সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের সৎসাহস

জাপানে ভাষা আন্দোলন- সাফল‍্য ও সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের সৎসাহস

‘ভাষা আন্দোলন’ কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে শুধু বাঙালী না, এখন পৃথিবীর সমস্ত ভাষাপ্রেমিকদের মনেপড়ে ১৯৫২ সালের আত্নত‍্যাগের কথা।  ২০০৫ সালে জাপানে আসার পর থেকে দেখছি জাপানী সমাজের পদে পদে ভাষা আন্দোলন।  ইংরেজী ও পশ্চিমা সংস্কৃতির দাপটেও এরা অদৃশ‍্য অহিংস লড়াইয়ে টিকে আছে সাফল‍্যের সাথে।  মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন আন্দোলন তো হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশে।  কিন্তু শহীদমিনার বানিয়ে যেন আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছি।  লড়াই পরিবর্তে যেন চলছে আপোষরফা, উল্টোরথে যাত্রা, আত্নবিসর্জনের মহাউৎসব।

জাপান পুঁজিবাদী দেশ, সমতা, মুক্তবিশ্ব ও মুক্ত অর্থনীতিতে বিশ্বাসী হলেও, সংস্কৃতি ও স্বদেশপ্রেমে এরা বেশ রক্ষণশীল।  যখন-তখন যে কেউ এসে গাঢ়ে চড়ে বসবে, তা এরা মেনে নেয় না।  জাত যাবে যাক, কিন্তু মান দিতে এরা নারাজ! তবে জাপানি সমাজে যুক্তি সঙ্গত, উপকারী সবকিছুই গ্রহনীয়।  এদের গ্রহনের মাত্রাটা লক্ষনীয় ভাবে ধীর ও সুদূরপ্রসারি। পুরো ব‍্যাসস্থাটাই যেন চলে অলিখিত ও অদৃশ‍্য অভিভাবকত্বে।  ভবিষৎ ফলাফলের চিন্তা-।সরকার, পরিবার, মিডিয়া ও বিদ‍্যালয় সব জায়গাতেই স্পষ্ট!

জাপানবাসী হওয়ার পর থেকে অন‍্য আট-দশটা বিদেশীদের মতো আমাকেও ভাষার কারণে, সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।  বাংলাদেশের প্রতি, বাংলাভাষার প্রতি আমার বিশেষ আবেগে টান থাকার কারনে- দীর্ঘ প্রবাস জীবনেও জাপানী ভাষা ও সংস্কৃতি দক্ষভাবে রপ্ত করতে পারিনি! বেশ সময় নিয়েছে।  যা আমাকে কষ্ট প্রায়শঃ পীড়া দেয়! জাপানীদের সবকিছুই ভিন্ন, সরল, একরোখা ও রক্ষণশীল বলে মাঝে মাঝে অনাগ্রহ ও বিরক্তি জাগে।
ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতি জাপানিদের প্রণোদনা – মহাকবি আব্দুল হাকিম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্রপাধ‍্যায় সহ যেসব বাঙালী মনীষীরা সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনে রক্ত-মাংস-আবেগ মিশিয়ে কাজ করেছেন,  তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছে।  আমার আস্থা বেড়ে গেছে – সবস্তরে বাংলা প্রচলন করা গেলে, স্বদেশপ্রেম, বাংলাদেশের উন্নয়ন, উন্নত চিন্তা ও সভ‍্য জীবন-যাপন কেউ আটকে রাখতে পারবে না।

পৃথিবীতে যত গুলো দেশ উন্নত ও স্বনিভর্র হয়েছে, প্রতিটি দেশই মাতৃভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলন করে বড় হয়েছে।  ভাষা নিয়ে যেসব জাতি শুভঙ্করি করেছে, আপোষ করেছে, তাদের কেউ কেউ অর্থনীতিতে উন্নত হলেও (যেমন হংকক, সিঙ্গাপুর ইত‍্যাদি) কিন্তু আত্নমর্যাদায় দৈন‍্যতা কেটে উঠতে পারেনি।

মাত্র দুই দশকে নিজ ভাষায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ব‍্যবহার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপানে দ্রুত উন্নয়ন দেখে,  ১৯৬২ সালে বিশ্বখ‍্যাত বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিম্মিত হয়েছিলেন।  ‘আধুনিক বিজ্ঞান এবং মানবের ভবিষ্যৎ অভিমুখ কী হবে’, শিরোনামের এক জাপান-সম্মেলনে ইংরেজী জানা জাপানী বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিক্ষকদের নিজ ভাষায় বক্তব্য দেয়া দেখে অবাক হয়েছিলেন।  নিজ ভাষায় সঠিক ভাবে বুঝে, আত্নস্থ করে, সমাজ ও জীবনে প্রতিফলনের জাপানীদের সেই ভালোবাসা আজো অটুট আছে।  প্রয়োজন ছাড়া জাপানীরা ইংরেজী বা অন‍্যভাষায় কথা বলে না।  নিজের ভাষার চেয়ে অন‍্য ভাষা বা সংস্কৃতিকে অধিক গুরুত্ব দেয় না।  বিদেশীদের সাথে ইংরেজী বললেও, এরা নিজেদের মাঝে সবসময় জাপানীতে শু্দ্ধভাবে কথা বলে।

আধুনিক টয়লেটের বোতাম থেকে শুরু করে, পণ‍্যের বিজ্ঞাপন, সরকারী ফরম, নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা, টিভি অনুষ্ঠান সবই জাপানী।  ইংরেজী ভাষার উপনেবেশিক ও আন্তজার্তিক বিস্তার ফ্রান্স, জার্মান, রাশিয়া, চীন ও আরাবিয়ান রাষ্ট্রগুলোর মতো জাপানীদের ভুগিয়েছে- কিন্তু টলাতে পারেনি।  এই লড়াইয়ে যে জাতি হাল ছেড়েছে, উন্নয়নের সাথে সাথে ভাষা-সংস্কৃতি-সম্পদ, জাত-মান-কুল সবই সেবই সেসব জাতির গেছে।  এককথায়, যে সব দেশে ইংরেজী প্রীতি ও বিদেশপ্রীতি যত কম, সে সব দেশ তত বেশী জাতীয়তাবাদী, স্বদেশপ্রেমিক।  ফলে জাপান-জার্মান-ফ্রান্স-রাশিয়া ইত‍্যাদি আত্নমর্যাদার কারণে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির আজ বিশেষ ফ‍্যাক্টর।

শুনতে খারাপ শোনায়, তবুও বলতে হয় – আমাদের বিদেশপ্রীতি, লন্ডনস্মৃতি, নিউয়র্কগীতি আমাদের কপাল খেয়েছে।  এর ফলে আমরা আজো হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছি! আস্থার সাথে দৌড়াতে শিখিনি! তাই হয়তো নিজের দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে অন‍্যদেশের জন‍্য উৎপাদন করতে চাই! নিজের দেশের মানুষের আগে বিদেশীদেরকে কাপড় পড়ানোর জন‍্য মরিয়া থাকি! নিজের দেশে টাকা অন‍্যদেশের ব‍্যাংকে রাখে শান্তি বোধ করি।  সরকারি-এনজিও প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে বাঙালীর জন‍্য ইংরেজীতে রির্পোট লিখি! দেশে ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ‍্যালয় থাকার পরও ছেলে-মেয়েদেরকে বিশাল খরচে দেশান্তরি করি, বিদেশে পড়াতে ভালোবাসি।  ফলশ্রুতিতে প্রত‍্যক্ষ ও প্ররোক্ষ ভাবে আমরা গাছেরও হারাই, তলারও হারাই।  তবে, আমি আশাবাদী, এইদিন থাকবে না! হৃদয়ে থাকা স্বদেশ প্রেম জাগলে আমাদেরকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।  পরির্বতন আসবেই।

অনেকে হয়তো আমার সঙ্গে ভিন্নমত হবেন।  ইংরেজী যদি না শিখি, আন্তজার্তিক ব‍্যবসা যদি না করি, তবে তো আমরা আরো পিছিয়ে পড়বো।  কথাটা সব উন্নয়নশীল ক্ষেত্রে সত‍্যি ! কিন্তু নিজেদের সতিত্ব বিসর্জন দিয়ে, নিজ ভাষা-সংস্কৃতি ত‍্যাগ করে ‘জাতে উঠার মিথ‍্যা মানসিকতা’ হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।  ইতিহাসে এমন উদাহরণ অনেক।  ব‍্যবসা করতে হলে, বিজ্ঞান শিখতে হলে নাগা-সন‍্যাসী হয়ে মাতৃভাষা ত‍্যাগ করে  ইংরেজী শিখতে হবে, এ ধারণা ভুল।  ইংরেজী না জেনেও, জাপানীরা আজ ৩৩০ এর অধিক বহুজাতিক-কোম্পানীর মালিক! দুনিয়াব‍্যাপি দাপটের সঙ্গে ব‍্যাবসা করছে।  ফ্রান্সের প‍্যারিস হয়ে গেছে বিশ্ব সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ইত‍্যাদি।  প্রবল ইংরেজীপ্রীতির পরও আমাদের ঘরে বলতে গেলে একটি বহুজাতিক কোম্পানীও নেই! বিজ্ঞানে বিশেষ কোন আবিস্কার নেই।  আমাদের মাথাপিছু আয় এখনো ২ হাজার ডলারের নীচে! আমাদের ইংরেজী প্রীতি, ইংরেজ শাসনের স্মৃতি কি দিয়েছে? আমি মনেকরি – এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার, পথ বদলে জাপানীদের মত নিজপথে চলার।

জাপানীরা স্বদেশী, পাশাপাশি আন্তজাতিকবাদী! কোন পণ‍্য বানালে বিদেশে বাজারজাত করার আগে চিন্তা করে নিজের দেশে প্রয়োজন ও বাজার নিয়ে।  নিজের দেশে যে ব‍্যবসা সফল হয় না, তা আন্তজার্তিক বাজারেও জনপ্রিয়তা পায় না।  ভিন্নদেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন‍্য ইংরেজী বা অন‍্য ভাষায় কথা বলার বিপক্ষে আমি নই।  ‘দ্বিতীয়’ অর্থাৎ ‘গৌণ ভাষা’ হিসাবে শেখার কৃতিত্ব আছে।  তবে নিজে দেশে – নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে বাংলার পরির্বতে অশুদ্ধ উচ্চারণে, অদ্ভুট অভিনয়ে ও জটিল মানসিকতায় ইংরেজি বলার বাহাদুরিকে আমি বোকামি মনেকরি! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে উল্লাস করা মনে করি।

কষ্টের কথা – প্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার পরও বাংলা সর্বস্তরে চালু হয়নি আজো।  এটা কারো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, আমাদের সমাজিক ও জাতীয় সমস্যা।  বাংলাদেশে অফিস-আদালত-বিদ‍্যালয়সহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাকে নানান ভাবে অবহেলা করে, গর্বের সঙ্গে ইংরেজির ব্যবহার করা হয়! সংবিধানিক রীতি ও প্রেরণা অমান‍্য করা হয় অহরহ! এজন‍্য কোন নাগরিক বা অফিসারকে ভোগান্তি পোহাতে হয় না।  কিন্তু জাপানের অফিস-আদালত-বিদ‍্যালয়সহ কোথায় জামাই-আদরে ইংরেজী ব‍্যবহার করা হয় না।  কারণ ছাড়া ইংরেজী বা অন‍্য ভাষা ব‍্যাবহার অলিখিত অপরাধ!

বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শাসনামল ১৯৭৫ পর্যন্ত অক্ষুণ ছিল।  ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পাঠ-জটিলতা সম্পর্কিত দ্বিতীয় ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলার পরিবর্তে ‘ইংরেজি ভাষা’ কে প্রাধান্য দেয়া হয়।  এরপর থেকে শুরু হয় সর্বত্র ইংরেজীতে পরিপত্র জারির রেওয়াজ।  উন্থান হয় ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্বপ্রদানকারী নব‍্য এলিট শ্রেণীর।  এই এলিটরাই চার দশক ধরে বাংলা ভাষা উপর গোপনে ও প্রকাশ্য অত‍্যাচার করছে।  যার নগ্ন কুফল – আজ সরকারি বড় কর্তারা ভুল ইংরেজি লিখলে লজ্জিত হন; কিন্তু ভুল বাংলায় দোষ মনে করেন না! বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে বক্তব‍্য দিয়ে নিজেদের প্রজ্ঞাবান মনে করেন।  অথচ গ্রাহক-পাঠক-শ্রোতা সবাই বাঙালী, বাংলা ভাষাভাষি, ইংরেজ নন!

বিদেশী ভাষা ব‍্যাবহারে জাপান ও বাংলাদেশের চিত্র পুরাই ভিন্ন! জাপানে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে হলে – জাপানী জেনে,  জাপানীদের মতো হয়েই বাস করতে হয়, কাজ করতে হয়।  কিন্তু বাংলাদেশে, একজন ইংরেজী জানা বিদেশী – বাংলা না জেনেও বিশাল দাপটের সঙ্গে সারাজীবন কাজ করতে পারে।  কোন সমস‍্যা হয় না ।  তার মোসাহেবের অভাব হয় না।  বাংলাদেশে বাসকালে, বিদেশী বাংলাভাষা শেখার কোন চাপ বা প্রয়োজনবোধ করেন না।

সম্প্রতি এক সকালে আমি আমার ছোট পুত্র ‘কওন’কে ইংরেজী শিখাচ্ছিলাম।  বড় পুত্র ‘করোনেট’ বললো,
– বাবা, তুমি ওকে ইংরেজী শেখাচ্ছো কেন? ওকে হয় বাংলা শেখাও, না হয় জাপানী শেখাও।  বড় হয়ে হয় বাংলাদেশে, না হয় জাপানেই কাজ করবে।  ইংল‍্যান্ড বা আমেরিকাতে কাজ করবে না!”
আমি বললাম,
– ইংরেজী শেখার আগে নিজের ভাষা শিখতে হয়, তোমাকে কে বলেছে।
সে বললো
– স্কুলে, সেনসে ( শিক্ষক) বলেছে।  তিনি বলেছেন, নিজের ভাষা প্রাণের ভাষা, এই ভাষাই নাকি একমাত্র প্রকৃত আনন্দ ও উন্নয়ন নিশানা পাওয়া যায়!
আমি ১২ বছরের পুত্রের সচেতনতা দেখে হতবাক!

বাংলাদেশে খৈই হারনো অনেক শিক্ষিতজনের আশঙ্কা – বিজ্ঞান ও সভ‍্যতা ইংরেজী কেন্দ্রিক হওয়ায়, বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষা ও সভ‍্যতা চর্চ্চা সম্ভব না।  হয়তো এই অপপ্রচারের কারণেই – চারদিকে শিক্ষিত পরিবাররের শিশুদের ইংরেজী স্কুলে পড়ানো হিরিক।  শহরের পিতা-মাতারা আজকাল শিশুদের বাংলামাধ্যমে পড়াতে চায় না! শিশুরা ‘মা-বাবা’ বদলে ‘মাম্মি-ডেডি’ বলে ডাকুক এটাই তাদের প্রবনতা।  জাপান, ফ্রান্স, জার্মান, স্প্যানে ইংরেজি মাধ্যমে ইস্কুলের প্রতাপ নেই।  স্কুলে ইংরেজি বিষয় থাকলে, ইংরেজী মাধ্যম বলতে কোন কিছু নেই।  এরা ইচ্ছা-অনিচ্চায় বাঙালিদের মতো, একটা বাক্যের মধ্যে দুই-তিনটে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে না! নিজের শিক্ষিত ও বাবু-সাহেব বলে জাহির করে না।

“যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না. নয় বিজ্ঞান বোঝেন না”, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিখ‍্যাত এই উক্তি সবার জানা! বাংলা ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চ্চা করে যে বিশ্বজনীন হওয়ায় যায়, বাঙালী তিন প্বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, এবং প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভাবনা ও কাজ জানলে তা বুঝা যায়।

বিশ্ববিদ‍্যালয়ে প্রথম বর্ষে ‘ইংরেজী’ কম জেনে বিজ্ঞান পড়ার ভুক্তভোগী আমি।  ১৯৯০ সালে ভুতাত্ত্বিক বিজ্ঞানে ভর্তির আমি ‘শিলাবি‍দ‍্যা’ নামে মাত্র বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একটি বাংলা বই পেয়েছিলাম।  আর বাকি সব বই ছিল ইংরেজীতে।  বাংলা মিডিয়ামে পড়া মফস্বলের ছেলে হঠাৎ ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ার কুফল আমি প্রথমবর্ষে পেয়েছি, প্রথম-দ্বিতীয় হতে পারেনি। পালে এ উল্টো হাওয়া আমার বিশ্ববিদ‍্যালয়ের পুরো ছাত্রজীবনে ছিল। ভুগোলের সঙ্গে মিল থাকার কারণে আমি ওদের বইয়ের অনেক সহযোগীতা নিতাম।  বাংলায় পড়তে চাইতাম, বাংলায় পরীক্ষা দিতে চাইতাম।  কিন্তু শিক্ষকদের অলিখিত মানা ছিল।  আমার বাংলাপ্রীতি কারণে এক শিক্ষক আমার উপর রুষ্ট হয়ে বলতেন,
– শাহজাহান সিরাজ, বিজ্ঞান কি বাংলা সাহিত‍্য? বাংলায় লেখতে চাও কেন? তুমি নম্বর কম পাবে, পাশ করবে না!…

শেষে কোন গত্তর না দেখে, বিজ্ঞান শেখার চেয়ে – ইংরেজী শেখায় আমাকে প্রথমবর্ষে বেশী হয়েছিল।  খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গত বিশ বছরেও বাংলায় ভুতত্ত্ব ও বিজ্ঞান পড়ানোর মত বই এখনো লেখা হয়নি, অনুবাদ হয়নি।  বাংলায় বিজ্ঞান পড়ানো মানসিকতা তৈরী হয়নি, বরং কমেছে।

অথচ আমার পুত্র ‘করোনেট’ জাপানে পড়ে।  বিজ্ঞানের বই, দর্শনের বই, ইতিহাস বই কোনটাই তাকে ইংরেজীতে পড়তে হয় না।  জাপানী ভাষায় পড়ে! ইংরেজী না বলা ও না পারার কারণে তাকে ভোগান্তি পোহাতে হয় না।  স্কুল ও পাড়ার লাইব্রেরীর ৯৯% ভাগ বই জাপানী ভাষায়।  বিদেশী লেখক ও বিশ্ব-ক্লাসিক ছাড়া ইংরেজী বই নাই বললেই চলে।

শুরু থেকেই বাংলা ভাষার উপর। অনেক অত্যাচার, ও নিপীড়ন হয়েছে।  এখনো প্রকাশ্যে ইংরেজি, গোপনে হিন্দি ভাষার, উর্দূ ভাষার, আরবী ভাষার যন্ত্রণা চলছে।  আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অর্জন অনেক।  কিন্তু চর্চ্চায় ব্যর্থতায় প্রচুর।  এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বেড়েছে।  কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষাপদ্ধতিতে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের চেয়ে বৈষম্য কম নয়! সুক্ষ বিচারে দেখলে বুঝা যায় – এখনকার মতো প্রবল বৈষম্য তখনও ছিল না।

আমাদের প্রিয় ভাষা আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা ছিল বাংলা ভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা।  অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে সেই ভাষা নেই।  ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আমলেও বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত ছিল; অন্য ভাষার প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল।  স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সেই প্রতিবাদ নেই, সচেতনতা নেই।  না পেয়ে, পাওয়ার মিথ‍্যা স্বস্থি আছে, যা একেবারে গ্রহনযোগ‍্য না ! বাংলাদেশে যে তরুণসমাজ মাতৃভাষার জন‍্য সোচ্চার হয়েছে, রক্ত দিয়েছে – সেই তরুণ সমাজ এখন আপোষ করে, নিজ ভাষাকে অবহেলা করে! এই করুণ বাস্তবতা একান্তই কাম‍্য নয়।

পৃথিবীতে ৮,৬৩৭টি ভাষা আছে।  প্রতি সপ্তাহে একটা করে ভাষা আক্রান্ত হচ্ছে, লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।  নতুন প্রজন্ম বাংলাভাষাকে ভালোবেসে না শিখলে, শুদ্ধ ভাবে না চর্চা করলে, হয়তো বাংলাভাষাও স্বকীয়তা হারাবে, যেমনটা হারিয়েছে বলিভিয়ার ভাষা!  বলিভিয়ার মানুষ একসময় কথা বলতো ‘আয়মারা’ ও ‘কুয়েছুয়া’ ভাষায়।  খনিজ তেল ও সিসার লোভে স্প্যানিশরা বলিভিয়ায় উপনেবিশ স্থাপন করলো! খনিজের সাথে সাথে ভাষা-সংস্কৃতিও দখল করে নিলো।  জাতে উঠার জন‍্য বলিভিয়ানর স্প্যানিশ ভাষা আবেগের সাথে গ্রহন করলো।  ফলে স্প্যানিশ, আয়মারা ও কুয়েছুয়া ভাষার মিশ্রণে বলিভিয়ায় সৃষ্টি হলো অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি ভাষা।  বলিভিয়ার ১ কোটি মানুষের মধ্যে এখন মাত্র ১০ লাখ মানুষ নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে, বাকিরা কথা বলে খিচুড়ি ভাষায়।

বাংলা ভাষা নিয়ে একই শঙ্কা আছে।  ইংরেজী, আরবী, হিন্দির উৎপাত না কমাতে পারলে, ভয়ের বিষয় বাংলাও হয়তো একদিন খিচুড়ি ভাষা হয়ে যাবে।  এসএমএসের মাধ্যমে, ফেইজবুকের মাধ‍্যমে, এফএম বেতারে মাধ‍্যমে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি যে ‘বাংলিশ’ বলা প্রচলন করা হচ্ছে, বাঙালীকেও হয়তো বলিভিয়ার ভাগ্য বরণ করতে হবে।

সম্প্রতি নতুন উত্পাত শুরু হয়েছে।  নারী-শিশুরা হিন্দি সিনেমা-সিরিয়ালের মাধ‍্যমে হিন্দির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।  ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি শাসনামলেও বাংলার যতটা বিকৃতি হয়নি, স্বাধীন বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশী বিকৃতি হচ্ছে।  বাংলাদেশে প্রায় ৫০টির মত ইলেকট্রনিক গনমাধ্যম আছে।  আমি কারণ খুঁজে পাই না – প্রত‍্যক্ষ আয়-রোজগার, বিনোদন ও ব‍্যাবসার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও অন‍্য দেশের, অন‍্য ভাষার অনুষ্ঠান, কিভাবে বাজার দখল করে! দেশীয় অনুষ্ঠানের নিম্নমানের কারণে, সরকার ও জনগনের সচেতনতার কারণে- দৈইয়ের পরিবর্তে ঘোল খাইয়ে শত কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে? আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির বারোটা বাজাচ্ছে!

গোঁজামিল ও অদ্ভুত ভাড়ামী থেকে আমাদের নাটক, গান, অনুষ্ঠান চলচিত্রকে বেরিয়ে আসতে হবে।  সৃজনশীলতায় স্বশক্তিতে দাঁড়াতে হবে।  চেনাবাহিনী-কেনাবাহিনীর গ্রাস থেকে শিক্ষা, মিডিয়া, ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার সময় এখন।

পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা মিলিয়ে আজ ৩০ কোটিরও বেশি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।  দিন দিন বাংলা ভাষার শক্তি কমে যাচ্ছে।  বাংলা অ্যাকাডেমি নতুন কোন শব্দ তৈরি করছে না।  নানান ছুতা-নাতায় পরিভাষা তৈরি হচ্ছে না।  অথচ আইসল‍্যান্ডের ‘আইস্লেন্ডিক’ ভাষায় মাত্র তিন-চার লক্ষ লোক বলে।  কম্পিউটার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত সব শব্দ আছে তাদের ভাষায়! আধুনিক প্রযুক্তি ও বিশ্বসংস্কৃতির কারণে নতুন শব্দ আসলেই ওরা আইস্লেন্ডিক অর্থ বের করে ।   অথচ এব‍্যাপারে আমার কত দরিদ্র, অনেকক্ষেত্রেই হীন‍মন‍্য!

প্রযুক্তি নির্ভর একবিংশ শতাব্দীতে তরুণ প্রজন্মও বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীন।  প্রযুক্তি বা আধুনিক যোগাযোগ মাধ‍্যমের দোষ দেয়া অন‍্যায়।  মানসিকতা সঠিকপথে থাকলে সুফল অবসম্ভাবী।  জাপানী তরুণ-তরুণীরা নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী মোবাইল চেট র করে।  অথচ তাদের হৃদয় ভাষা ইংরেজী দখল করতে পারেনি। ।উল্টো তাদের উদ্ভাবিত ‘ইমিকন’ ( ইমোজি) আজ সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয়।

শব্দ গ্রহন ও তৈরীর ব‍্যাপারে জাপানে আমার আছে এক অনন‍্য অভিজ্ঞতা।  আমার প্রথম পুত্র, নাম রেখেছিলাম ‘করোনেট’ অর্থাৎ ‘রাজ মুকুট’! জাপানের সিটি অফিসে নাম রেজেষ্ট্রি করতে গেলাম।  অফিসার গ্রহন করলো না, বলল – এ নামের জাপানী অর্থ নাই।  গ্রহন করার যাবে না ।  শেষে শশুর মশাই নাম পরির্তন করে ‘করোনেট্টো’ রাখলেন, জাপানী অর্থ বের করলেন, গ্রহনীয় হলো।  এভাবে জাপানের প্রতিটি মানুষের নাম, দোকানের নাম, পণ‍্যের নাম ইত‍্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক ছাঁকুনী দিয়ে ছেঁকে সমাজে প্রচলিত হয়।  নিজস্ব বিশুদ্ধতা রাখা হয়।  বাংলায় এমন ব‍্যবস্থা চালু করা গেলে কতই না ভালো হবে।

উন্নত প্রায় সব দেশেই একমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা! অথচ আমাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থা বহুধাবিভক্ত, অন্ততঃ ৮ থেকে ১০ ভাগে বিভক্ত! বাংলা নিয়ে নয় বরং ইংরেজি শিখাতেই অভিভাবকদের চিন্তা বেশি, কারণ ইংরেজী না শিখলে সন্তান নাকি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।  এমন চিন্তাতে অতিরিক্ত ইংরেজী প্রীতির কারণে, সিংগাপুরে ‘সিংলিশ’ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।  কিন্ত নতুন এই সিংলিশ নিয়ে বর্তমানে সিংগাপুরের সরকার ও সুশীল সমাজ বেশ চিন্তিত।

১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো কাজই বাংলায় হয় না… ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই।  ইংরেজি এক রাজভাষা, তাহা অর্থ উপার্জনের ভাষা।’…” কিন্তু এ লেখার দেড়শ বছর পরও আমরা একই বাস্তবতায় অবস্থান করছি।  ইংরেজি এখন আর আমাদের রাজভাষা নয়, তবু ওই প্রবণতা কেন বিদ্যমান?

জাতিক ও আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্রের খপ্পরে আজ বাংলার অবস্থা খুবই শোচনীয়।  বাংলা একাডেমির বই নিজের তৈরি ‘প্রমিত বানান রীতি’, স্কুল টেকস্ট বুক বোর্ডের বইয়ে বানান ভুল করা অমার্জনীয় অপরাধ! পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র-রেডিও-টিভি সমূহে বাংলা ভাষার নানামাত্রিক ভুল ব্যবহার সৃষ্টি করছে বহুমুখী বিভ্রান্তি।  এই নৈরাজ‍্যের সময় মনে হচ্ছে বাংলাকে দেখবাল করার কেউ যেন নেই।  এই করুণ বাস্তবতার মুল কারণ সদিচ্ছার অভাব, আস্থার অভাব।  বাংলা ভাষা প্রচলন আইন আছে, কিন্তু আইন না মানলে অসদাচরণের অভিযোগে নেয়ার কথা।  আমার জানামতে এ পর্যন্ত সরকারী-বেসরকারী কারো বিরুদ্ধেই ‘বাংলা অপব‍্যবহার’ বা ‘না ব‍্যবহার’ করার কারেণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে ১৯১৫ সালে লিখেছেন, ‘উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে।  পশ্চিম হইতে যা কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান কারণ, এই শিক্ষাকে তারা দেশী ভাষার আধারে বাঁধাই করিতে পারিয়াছে। অথচ জাপানি ভাষার ধারণা শক্তি আমাদের ভাষার চেয়ে বেশি নয়।  নতুন কথা সৃষ্টি করিবার শক্তি আমাদের ভাষায় অপরিসীম।…বাংলা ভাষাতেই আমরা উচ্চশিক্ষা দিব এবং দেয়া যায়, এবং দিলে তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে।’

বাংলা নিয়ে কারো হীনমন‍্য হওয়া উচিত না।  রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের প্রমুখের মতো সুসাহিত‍্যিক, হাজারো মনীষীর সৃষ্টি হয়েছে এ ভাষায়।  আসুন আমরা সবাই নিজ ভাষাকে ভালোবাসি, প্রাণের কথা জাপানীদের মত প্রাণ দিয়ে বলি।  বাংলাকে শ্রদ্ধা করি।  স্বদেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে সর্বস্তরে বাংলা প্রচারের মনোযোগী হই।

নিগাতা, জাপান
২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭