Apr 17, 2020 | সাহিত্য
এক গৃহহীন হতদরিদ্র আধা পাগল রাস্তায় দাঁড়িয়ে বহুতল ভবনের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘ঘরে থাকতে কইতাছেন ভালা কথা, থাকুম, কিন্তু যার ঘর নাই বাড়ি নাই, সে থাকবো কোথায়? পথশিশু, বস্তিবাসী ছাড়াও, ঢাহার শহরের বেশীর ভাগ মানুষের আমার মত ঘরবাড়ি নাই, ভাড়াবাড়িতে থাকে! বড়াই করে! টানা কয়েক মাস কাজকাম না থাকলে, আয় রোজগার না হইলে, দেখি না কয়জনের শহরপ্রেম, ফুটাঙ্গি থাকে! সবাই আমার লাহান, সমান হইয়া যাব।’
এ বলে অট্ট হাসিতে হাসতে থাকে, পাগল।
এটা-সেটা করে কতক্ষণ থেমে থাকার পর, পাগলটা আবার প্রলাপ বকতে শুরু করে, ‘নাটকের প্যাথেটিক পর্ব শুরুর আগেই, চল নিরাপদে, সবুজ-শ্যামল যে গেরামে জন্ম হয়েছিল, সেখানে চইলা যাই। ভালাবাসা পাবার সাথে সাথে, করোনামুক্ত পরিবেশ পাবা। নদী-বিলে মাছ ধরবা, পুকুরে সাঁতার কাটবা, তরতাজা সবজি খাবা। নদী আর প্রকৃতি দেইখা দেইখা, নির্মল হিমেল বাতাস খাইয়া অপার শান্তি পাবা। হয়তো বুকে লুকিয়ে থাকা কবিতাও মুখে ফুটবে।
পাগলের চিল্লাচিল্লি শুনে টক্কর আলী ৩য় তলার বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। টক্কর আলিকে লক্ষ্য করে পাগল বলে, ‘আগেই কইছিলাম, গেরামের পোলা লও গেরামে যাই, কেউ কথা শোন নাই, এমনকি রথি-মহারথি, মন্ত্রী-মিনিষ্টারাও শোনে নাই! নীচে নাইমা আসো! আও চইলা যাই, পাগলের এই শহর থেইকা লাভ নাই, চল পালাই।
পাগলের বকবকানি শুনে টক্কর আলি আইসোলেশনের অতি কষ্টেও মজা পায়! হাসে আর মনে মনে বলে, ‘দুনিয়াতে পাগলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।’
টক্কর আলির হাসি দেখে পাগল আবার বলতে শুরু করে,
”হাইসো না হাইসো না, নিটকাইয়া আর হাইসো না, দুবাইয়ের বুর্জখলিফা কাঁপতাছে! প্যারিস, লন্ডন, নিউয়র্ক পুরো খালি! সব বিল্ডিং ভয়ে থরথর করতাছে, চল পালাই, গেরামে যাই! নিজের জায়গায় যাই! দুইদিন আগে বা পরে ঐখানেই তো কব্বর টা হইবো, আগেবাগে গেলে অসুবিধা কি?’
পাগলের কথা শেষ হওয়ার পর, চারদিক অসম্ভব ভয়ার্ত নীবব লাগে। তিন তলা থেকে বামে ডানে তাকিয়ে পুরো রাস্তা দেখে, পুরো শহর খালি, একা একা লাগে। টক্কর আলি হৃদয় মৃত্যুভয়ে কেঁপে উঠে। চির বিদায়ের আশঙ্কায় অনুভূতি জেগে উঠে, সবকিছু যেন ভেঙ্গে পড়ে। আশেপাশের সব বিল্ডিংএর কাঁপন অনুভূত হয়। কষ্টে, দীর্ঘশ্বাসে চোখ বন্ধ করতেই টক্কর আলির কল্পণায় ভেসে উঠে, ছেলেবেলায় দেখা নিজ গ্রামের বিলের ধারে সূর্যাস্তের দৃশ্য। কতদিন দেখা হয়নি প্রিয় গ্রামের শেষ সোনালী আলো। বোধ করে – স্বর্গে আছি, নিজগ্রামে একজনকেও এখনো করোনা ধরেনি, একজনও এখানে মারা যায়নি! সব রহমত গ্রামে!
চোখ খুলতেই দেখে পাগলটি তার পুটলা থেকে একটি বনরুটি বের করে খাচ্ছে, খাদ্যদানা দাড়ি-মোছ লাগছে, এদিক সেদিকে ছিটছে! অস্পষ্ট কন্ঠে বলছে, ‘চিন্তার কারণ নাই, কেবারে-বাবারে ছাড়া গেরামে কোন কিছুর অভাব নেই। কোন কথা না বইলা, সুবোধ বালক ও বালিকারা যদি শান্তিতে থাকতে চাও, বাঁচতে চাও, নিজ গেরামে চলে যাও। হে কমরেডগণ, গেরামে তোমার সব আছে, তুমি তো ঐখানে সর্বহারা নও, ঐখানে তুমি রাজা, অমৃতার সন্তান!’
‘শহরে ঘর নাই বাড়ি নাই, চল নিরাপদ গেরামে যাই!’
এ শ্লোগান জপতে জপতে চৈরঙ্গীর থেকে সুরু এক গলিতে ঢুকে যায়। পাগলটাকে আর দেখা যায় না, আর কথা শোনা যায় না। টক্কর আলি ঘরে এসে, বিছানায় শুয়ে বিশ্রামের চেষ্টা করে। হোম কোয়ারেন্টাইনে, দীর্ঘ গৃহবাসের অবসাদ মনে, তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ, শৈশব থেকে পুরো জীবনের ঘটনা হৃদয়ের পর্দায় সিনেমার মত দেখতে থাকে। পাগলের প্রলাপগুলো নিজের জীবনের সাথে মিল খুঁজে পেয়ে কষ্ট পায়। শৈশবের আনন্দ আর স্বর্গসুখ হারিয়ে হৃদয় হাহাকার করে! অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ভাবে, ‘কেন এত কষ্ট, কেন অযথা ব্যস্ত বড়াইয়ের জীবনযাত্রা। সুখে থাকার জন্য এত আয়োজন, এত কৌশল, এত ছলছাতুরি কি আসলেই দরকার? আমি কি এতদিন ঠিক পথে চলেছি?’
টক্কর আলি একা একা কাঁদে, জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করে!
Mar 29, 2020 | সাহিত্য
মোহাম্মদপুর টাউনহলের দিনমুজুরদের জটলার মত, রাস্তার মোড়ে একদন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এমপি, মন্ত্রি, কৃষক, মুজুর সবাই কোদাল, দা, খন্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; শীতের ভোরের প্রচন্ড ঠান্ডায় সবার শ্বাস দিয়ে বাস্প-ধোঁয়া বের হচ্ছে, রাস্তাঘাট পরিস্কারের জন্য ওয়ার্ড অফিসের নিদের্শের অপেক্ষো করছে, এমন দৃশ্য বাংলাদেশে অকল্পনীয়। কিন্তু তুখোড় পুঁজিবাদি দেশ, এক সময় দূরপ্রাচ্যের সাম্রাজ্যবাদি জাপানে এ দৃশ্য স্বাভাবিক। দেশের, বিশেষ করে গ্রাম ও মফস্বলের রাস্তাঘাট জাপানে, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নিবিশেষে সবাই মিলেমিশে পরিস্কার করে। এ সমাজিক কাজে কোন বরাদ্ধ নেই, নেই রাজনীতি, ফান্ড, দূনীতি ও ক্ষমতার ক্যারাবেরা।
করোনায় যখন সারা বিশ্ব আতঙ্কিত, তখন আমরা সাদোতে রাস্তা পরিস্কার করছি। আমি আর্শীবাদপুষ্ট যে দ্বীপে থাকি, সেখানে করোনার আক্রমণ নেই, এখনো কোন রোগী ধরা পড়ে নাই। মনেহয় মেইনল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে, বা আদি থেকে অনেক নির্বাসিত মহামতির আস্তানার কারণে এই পূণ্যভূমিতে রহমতটা আজো আছে।
জাপান পুঁজিবাদি দেশ হলেও, মানুষ এখানে সম্পদ ও বংশের বড়াই করে না, কেউ পার পায় না, কেউ পূঁজির প্রসঙ্গ টানলে, বাহদূরী করলে হাসির পাত্র হয়। সম্পদশালী হয়ে কেউ কোন বাড়তি সুবিধা পায় না। যার আছে সে যেমন বলে না আমার আছে, যার নাই সে’ও বলে আমার নাই! অনেকটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র প্রখরতার সমাজ, কেউ কারে তেমন বিরক্ত করে না। সম্পদ ও বংশের বিচারে সম্পর্ক উঠানামা করে না।
টাকার বড়াই ব্যংকে, ক্ষমতার বড়াই পদে আর বংশের বড়াই চরিত্রে রেখে জাপানে জীবনযাপন করতে হয়। কেউ গা গরম করলে, শক্তি দেখালে, আইনের সাথে সাথে, বিনাপয়সা ইয়াকুজা মানে মাফিয়া অপবাদ, উপাদি পেতে হয়। ফলে কে লাখপতি, কে কোটিপতি, কে হাজারপতি বুঝার উপায় নেই, সবাই সাদাসিদে শার্ট-গেঞ্জি পড়ে, যতদূর সম্ভব ভদ্রতা ও বিনয় দেখায়!। অযথা অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগীতা করে না। যাদের টাকা পয়সা রাখার জায়গা নেই, তারা সাধারনত ডাকঢোল না পিটিয়ে, বারে গিয়ে দামী দামী বিদেশী খাবার খায়, পাগলা পানি পান করে, জুসি ললনাদের সাথে জুস খায়, জাপানি গাড়ি না চালিয়ে দামি বিএমডাবলিও, কেডিলাক গাড়ি চালায়, অর্থ বার্ণ করে, হারমাতি দেখাতে পারে না! টাকা উড়ানোর কালচার জাপানের গ্রামে নেই, আছে মেঘাসিটিতে, হোটেল আর এপার্টমেন্টর খুঁপড়ি রুমে।
মেঘাসিটির মানুষের টাকা থাকলেও, রাস্তা পরিস্কার না করতে হলেও, অন্যকে সেবার করার ঝুটঝামেলা না থাকলেও, জীবন হয় বন্ধুহীন, কমিউনিটিহীন। জীবনে থাকে না উৎসবের আনন্দ, ভালোবাসার সুবাস। পরিপাটিতা নগর জীবন যেন নিজস্ব চারদেয়ালেই সীমাবন্ধ থাকে। ধনী কেউ মারা গেলে আসল করুণ বাস্তবতাটা ফুটে উঠে, হাসপাতালের কয়েকজন নার্স-ডাক্তারই মৃত্যু সংবাদ জানতে পারে, হাতেগোনা কয়েকজন হয়েতা কাঁদে, দোয়া-প্রার্থনা করে, পারিবারিক আত্নীয়স্বজনদের ছাড়া অন্যদের ধন্যবাদ পায় না বললেই চলে। এ’বিষয়ে জাপানের গ্রামে ও মফস্বলের দৃশ্যটা পুরোই উল্টো, অনেকটা বাংলাদেশের মতো! কেউ ইন্তেকাল করলে সারা শহরে গাড়ী করে দেহ ঘুরানো হয়, সব প্রিয় ও পরিচিতজন কে জানান দেয়া হয়, হাজার মানুষ শোকযাত্রায়, চিরবিদায়ে অংশগ্রহন করে। অন্যজনকে দেয়ার, অপরকে ভালোবাসার উত্তরটা স্পষ্ট হয়ে উঠে বিদায় উৎসবে। আর জনসেবা করলে তো কথায় নেই মিষ্টার রিগানের মত অন্তষ্টিক্রিয়া হয়।
জাপানের জনসেবার ধরণটা বাংলাদেশ ও প্রশ্চাত্যের মত না, এত ঘনঘটা হয় না; মিটিং-মিছিল, সভা-সমিতি, দান-খয়তার কেন্দ্রিক না। পুরোটাই যেন ব্যক্তিগত চর্চ্চা ও সামাজিক অংশগ্রহন কেন্দ্রিক। চাপাবাজি, মোসাহেব, চামচারা জায়গা পায় না, মূল্যায়ন পায় প্রকৃতই ফলোয়ার আর ভালোবাসার সারথীরা।
জাপানের প্রতিটি গ্রামে নিয়মিত ঋতুভিত্তিক উৎসব হয়, মেলার আয়োজন হয়, যা শুধুই মেলা নয়, মানুষের মিলনমেলা। আমি এই মিলনমেলা গুলো পারতপক্ষে মিস করি না। মাসের নিদ্দিষ্ট দিনে, কাজের পোষাক পড়ে খন্তি কোদাল দিয়ে জাপানে রাস্তার ধার পরিস্কার করা একধরনের উৎসব। আমার প্রিয়, উৎসবের আনন্দে কাজ করি। এটা শুধু রাস্তা পরিস্কার নয়, ভালোবাসার প্রকাশ। পিতামাতাকে শুধু রাস্তা নয়, স্কুলও নিদিষ্ট সময় পরপর পরিস্কার করতে হয়। আমি এ সুযোগ গুলো এনজয় করি। অলস কেউ অংশগ্রহন না করলে জরিমানা দিতে হয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের প্রতি দায়িত্বহীনতার গ্লানি বইতে হয়, যা খুবই লজ্জাকর। প্রথম প্রথম আমি বাঙালি শিক্ষিত-সচেতন ব্যক্তিত্বের আবেগে এই ছোটকাজ গুলো করতে চাইতাম না। একদিন বউয়ের ঝাড়ি খেয়েছিলাম- রাস্তা, স্কুল, কলেজের সুবিধা নিবেন, টেককেয়ার করবেন না, এটা তো অন্যায়। একধরনের চিটিং ।
এখন আমি জানি ও মানি, যে রাস্তার সুবিধা আমরা সবাই ব্যবহার করি, তা রক্ষার দায়িত্ব তো সবারই। জাপানে, পরিরেশের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, কমিউনিটি কাজের পুরো বিষয়টা একজন দায়িত্বশীল কমিউনিটি লিডার ও কমিটি’র মাধ্যমে পরিচালিত হয়। অনেকটা বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার চেয়ারম্যানদের মত এদের পদ, এ কাজের জন্য কেউ টাকা পয়সা পায় না, নির্বাচনও নেই। কমিউনিটির গণ্যমাণ্যদের দ্বারা লিডার সিলেকশন হয়, সিটি অফিস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পাবলিক মানির চুরিধারির, তসরুফের সুযোগ নেই, কেউ জনসেবার নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে না, গড়তে পারে না। যে কোন প্রকার অপচয় বা দায়িত্বহীনতার খবর ফাঁস হলে, পদ হারানোর পাশাপাশি মান-সম্মান যায়, নিজের আইডিতে অপরাধের চিহৃ পড়ে। যেহেতু কোন সুবিধা নাই, যে সব মানুষের সমাজ সেবার বাড়তি প্রেম আছে, তারাই শুধু সমাজনেতা হতে চায়, পারে। বাংলাদেশের মত মেম্বার-চেয়ারম্যান হতে অনেক মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। কমিউনিটির কাজ কমিউনিটি করে ফেলে বলে – এনজিও’র রাজত্ব নেই জাপানি সমাজে। গুটিকয়েক যে এনপিও, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানান ভাবে সহযোগীতা করে, উঠে দাঁড়াতে। সাধারণত মানুষ পূর্ণ্যির মানসিকতায় না, দায়িত্বের মানসিকতা গরীবদেশের মানুষকে মুক্তহস্তে দান করে। যারা উন্নয়নসংস্থা চালায়, তারা সমাজে সেনসে, অধ্যক্ষ হিসাবে সম্মানিত হয়।
ভোর সকালে নিবো’র রাস্তা পরিস্কার করতে পেরে, বাঙালি অহং মাটিতে ঢেলে দিয়ে ভারমুক্ত হয়েছি! শারীরিক পরিশ্রম করে, কয়েকজন নতুন সুনয়নার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, মন শান্তিতে ফুরফুরা, আনন্দে ভরা। দুই সুন্দরীর কাছ থেকে দাওয়াত পেলাম, দেখি না বাড়িতে গেলে কি খাওয়ায়। জাপানি বাড়িতে দাওয়াত মানে, বাংলাদেশের মত পোলাও মাংস না, কিপটেমির জাহির- স্বাদহীন গ্রীণ-ট্রি আর দুই একটা সেমবে, বিস্কুট, সাথে নানান জাতের হালকা আলাপ। এদের আলাপ আমি বেশীক্ষন মনযোগ দিয়ে শুনতে পারি না, বাংলাদেশের দাওয়াতের মত গামলা ভর্তি মাংস, পোলাও, বোরহানি কল্পনা করি, নষ্টালজিয়ায় ভুগি।
জাপানের মত, ঢাকাসহ বাংলাদেশের সকল শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট যদি জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নিবিশেষে সবাই একসাথে নিয়মিত এমন পরিস্কার করতো; কোন প্রকার রাজনীতি, ফান্ড, দূনীতি ও ক্ষমতার ক্যারাবেরা না করতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। শুধুমাত্র সরকার ও এনজিও’দের উপর সমাজ উন্নয়নের চাপটা কমতো।
বাংলাদেশী সমাজের বর্তমান অবস্থাগতি, শ্রেণী প্রখরতা, পুঁজিবাদি চিন্তা ও তীর্যক আত্নসম্মানে তেজ দেখে আমার মনেহয় বাংলাদেশে এখন অসম্ভব। এজন্য প্রথমে বাংলাদেশের দরকার শিক্ষা, সচেতনতা আর অন্যকে নিজের মত সমান মনেকরতে শেখা। অন্যের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ মনেকরা। সমাজটাকে নিজের পরিবারের এক্সটেনশন মনে করা। তাহলে হয়তো দৃশ্যপট, বর্তমান নাটকের অমিমাংসিত কাহিনি বদলে যাবে!
নিবো, জাপান
২৯ মার্চ, ২০২০
Feb 20, 2020 | সাহিত্য
ইংরেজি ও পশ্চিমা সংস্কৃতির দাপটের যুগেও, জাপান সফলতার সাথে সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলন করে সৎসাহস দেখিয়েছে! মাঝে মাঝে মনে হয়, নীরবে জাপানে যেভাবে ভাষা আন্দোলন হয়, তেমনটা তো হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশে। আমরা যেন শহীদ মিনার বানিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছি। লড়াইয়ের পরিবর্তে যেন চলছে আপসরফা, উল্টোরথে যাত্রা, আত্মবিসর্জনের মহোউৎসব। বন্দুক দিয়ে যে বাংলা ভাষাকে, উর্দূ হরণ করতে পারে নি, বিনা যুদ্ধে সেই বাংলা ভাষাকে আজ- হিন্দি ও ইংরেজি দখল করে নিচ্ছে। এ এক কষ্টকর বাস্তবতা!
জাপান পুঁজিবাদী দেশ- সমতা, মুক্ত কালচার ও মুক্ত অর্থনীতিতে বিশ্বাসী হলেও, সংস্কৃতি ও স্বদেশপ্রেমে এরা বেশ রক্ষণশীল। যখন-তখন, যে কেউ এসে ঘাড়ে চড়ে বসবে, তা এরা মেনে নেয় না। অবার বিদ্রোহও করে না, যতটুকু গ্রহণ করলে, নিজস্ব কালচার কলোষিত হবে না, ততটুকুই গ্রহণ করে। যুক্তি সঙ্গত, উপকারী সবকিছুই গ্রহণীয়। এদের গ্রহণের মাত্রাটা লক্ষনীয় ভাবে ধীর ও সুদূর প্রসারি। পুরো ব্যাবস্থাটা যেন চলে, অলিখিত ও অদশ্য এক অভিভাবকত্বে। ভবিষৎ ফলাফলের চিন্তা; সরকার, পরিবার, মিডিয়া ও বিদ্যালয় সব জায়গাতেই স্পষ্ট!
জাপানবাসী হওয়ার পর থেকে, অন্য আট-দশটা বিদেশির মতো আমাকেও ভাষার কারণে, সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে, ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি, বাংলাভাষার প্রতি আমার বিশেষ আবেগ ও টান থাকার কারণে; দীর্ঘ প্রবাস জীবনেও জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি দক্ষভাবে রপ্ত করতে পারি নি! যা আমাকে প্রায়শই পীড়া দেয়! জাপানিদের সবকিছুই ভিন্ন, সরল, একরোখা, নিয়মবদ্ধ ও রক্ষণশীল বলে; গ্রহণে ও রপ্ততায় আমার মাঝে মাঝে অনাগ্রহ জাগে, বিরক্তি লাগে।
নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতি জাপানিদের প্রেম; মহাকবি আব্দুল হাকিম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্রপাধ্যায় সহ, যেসব বাঙালি মনীষী সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনে রক্ত-মাংস-আবেগ মিশিয়ে কাজ করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়। আমার আস্থা বেড়েছে- সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করা গেলে; স্বদেশপ্রেম, বাংলাদেশের উন্নয়ন, উন্নত চিন্তা ও সু-সভ্যতা কেউ আটকে রাখতে পারবে না।
পৃথিবীতে যত গুলো দেশ উন্নত ও স্বনিভর্র হয়েছে, প্রতিটি দেশই মাতৃভাষাকে ভালোবেসে, সর্বস্তরে প্রচলন করেই বড় হয়েছে। নিজস্ব ভাষা প্রচলন নিয়ে, যেসব জাতি শুভঙ্করি করেছে, আপসরফা করেছে, তাদের কেউ কেউ অর্থনীতিতে উন্নত হলেও, আত্মমর্যাদার দৈন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। ধার করা ইংরেজিতে সভ্য- হংকং, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশের বদ-নসিব দেখলে ভয় জাগে; বাংলাদেশ ভিনদেশি ভাষা- ইংরেজি, আরবী, হিন্দির প্রতাপ থেকে কি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে? নাকি আধা মরার মতো, কোন রকমে টিকে থাকবে?
জাপান সহ, উন্নত প্রায় সব দেশেই একমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা! অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বহুধা বিভক্ত, অন্তত ৮ থেকে ১০ ভাগে বিভক্ত! বর্তমান শিক্ষাধারায়- বাংলা নিয়ে নয় বরং ইংরেজি শিখাতেই অভিভাবকদের চিন্তা বেশি! ভাবগতি- ইংরেজি না শিখলে সন্তান নাকি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। এমন চিন্তাতে অতিরিক্ত ইংরেজি প্রীতির কারণে, সিংগাপুরে ‘সিংলিশ’ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। নতুন এই সিংলিশ নিয়ে, বর্তমানে সিংগাপুরের সরকার ও সুশীল সমাজ বেশ চিন্তিত! নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা ধরে রাখতে মরিয়া।
মাত্র কয়েক দশকে নিজ ভাষায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি চর্চ্চা করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপান আজ উন্নয়নের শিখরে। জাপানের দ্রæত উন্নয়নধারা দেখে, ১৯৬২ সালে বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিম্মিত হয়েছিলেন। ‘আধুনিক বিজ্ঞান এবং মানবের ভবিষ্যৎ অভিমুখ কী হবে’, এ শিরোনামের এক জাপান সম্মেলনে; ইংরেজি জানা জাপানি বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিক্ষকদের জাপানিতে বক্তব্য দিতে দেখে অবাক হয়েছিলেন। নিজ ভাষায় সঠিক ভাবে বুঝে, আত্মস্থ করে, সমাজ ও জীবনে প্রতিফলনের; জাপানিদের সেই ভালোবাসা আজও অটুট আছে।
অতি প্রয়োজন ছাড়া জাপানিরা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় কথা বলে না। লেখায় বিদেশী শব্দ গুলোকেও আলাদা করে রাখার জন্য ’কাতাকানা’ বর্ণের চালু করেছে বহু পূর্বে। নিজের ভাষার চেয়ে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া অন্যায়। বিদেশিদের সাথে ইংরেজি বললেও, জাপানিরা নিজেদের মাঝে সবসময়ই, জাপানিতে শুদ্ধভাবে কথা বলে। ভালো ইংরেজি জানাকে – আমার যেখানে মেধা ও শিক্ষার মাপকাঠি মনেকরি, জাপানিরা সেখানে ভাবে দেখে না। উল্টো ওভারস্মাট, ভাগা মানে বোকা মনেকরে!
জাপানে- আধুনিক টয়লেটের বোতাম থেকে শুরু করে, পণ্যের বিজ্ঞাপন, সরকারি ফরম, নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য, টিভি অনুষ্ঠান সবই নিজের ভাষায়। টুরিস্ট আসার সম্ভবনা আছে, এমন জায়গা ছাড়া কোথাও জাপানিরা ইংরেজি বা অন্য ভাষার ভার্সন রাখতে নারাজ। ঔপনিবেশিক ইংরেজি ভাষার আন্তজার্তিক বিস্তার- ফ্রান্স, জার্মান, রাশিয়া, চীন ও অ্যারাবিয়ান রাষ্ট্রগুলোর মতো; জাপানিদের ভুগিয়েছে, কিন্তু টলাতে পারে নি। ভাষা আন্দোলনে যে জাতি হাল ছেড়েছে, উন্নয়নের সাথে সাথে ভাষা-সংস্কৃতি-সম্পদ, জাত-মান-কুল সবই সেসব জাতির গেছে। এককথায়, যে সব দেশে ইংরেজি প্রীতি ও বিদেশপ্রীতি যত কম; সে সব দেশ তত বেশি জাতীয়তাবাদী ও স্বদেশপ্রেমিক! ধনে ও গুণে উন্নত! ফলে জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া, ইরান ইত্যাদি রাষ্ট্র ভাষার আত্মমর্যাদার কারণে- বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির আজ বিশেষ ফ্যাক্টর।
শুনতে খারাপ শোনায়, তবুও বলতে হয়- বিদেশপ্রীতি, লন্ডনস্মৃতি, নিউয়র্কগীতি আমাদের কপাল খেয়েছে। ফলে আমরা আজো হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে এগুচ্ছি! আস্থার সাথে দৌড়াতে শিখি নি! হয়তো এ’কারণেই- নিজের দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে, অন্যদেশের জন্য, আমরা উৎপাদন করতে চাই! বড়ই নিঃস্বার্থ ও অভাগা জাতি আমরা!
নিজের দেশের মানুষের পূর্বে, টাকার জন্য বিদেশিদেরকে কাপড় পরানোর জন্য মরিয়া থাকি! নিজের দেশের টাকা অন্যদেশের ব্যাংকে রেখে শান্তি বোধ করি। সরকার ও এনজিও- প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে, বাঙালির জন্য বাঙালি হয়ে ইংরেজিতে রির্পোট লিখি! দেশে ভালো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও; ছেলে-মেয়েদেরকে বিশাল খরচে দেশান্তরি করি, বিদেশে পড়াতে ভালোবাসি।
আমার এক বৃটিশ বংশদ্ভ‚ত অস্ট্রেলিয় সাংবাদিক কৌতুক করে বলেছিলেন,
– সিরাজ, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করে। কিন্তু রির্পোট বাংলায় না লিখে, ইংরেজিতে লিখে কেন? ইন্টারভিউ নিতে গেলে, বাংলায় কথা না বলে, গুরুগিরি করে ইংরেজিতে কথা বলে কেন? উদ্দেশ্য- বাংলাদেশ, কাজ বাংলাদেশের মানুষের জন্য, শুনবে ও পড়বে বাংলাদেশের মানুষ! অশুদ্ধ ইংরেজি না বলে, শুদ্ধ বাংলায় বললে কি দোষের? পৃথিবীর মর্যাদাবান কোনো নন-ইংলিশ দেশে তো এমনটা দেখি না!
অস্ট্রেলিয় সাংবাদিকের কথায় আমি কষ্ট পেলেও, হতাশা বুঝতে দেই নি। শুধু বললাম,
– তোমরা চাবি মাইরা দিসো ছাইড়া। আজো রোবট-পুতুল চলতাছে। মনেহয় আরো কিছুদিন চলেবে, তবে বেশীদিন থাকবে না! দিন বদলাচ্ছে।
নিজস্ব ভাষাপ্রেমের ঘাটতির কারণে – প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আমরা গাছেরও হারাই, তলারও হারাই। তবে, আমি আশাবাদী- এইদিন থাকবে না! হৃদয়ে থাকা স্বদেশ প্রেম জাগলে আমাদেরকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। পরির্বতন আসবেই।
অনেকে হয়তো আমার সঙ্গে ভিন্নমত হবেন। ইংরেজি যদি না শিখি, আন্তর্জাতিক ব্যবসা যদি না করি, তবে তো আমরা আরো পিছিয়ে পড়ব। কথাটা সব উন্নয়নশীলদের ক্ষেত্রে সত্য! কিন্তু নিজেদের সতিত্ব বিসর্জন দিয়ে, নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ত্যাগ করে- ‘জাতে উঠার মিথ্যা মানসিকতায়’, হিতে বিপরীত করার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে ।
ব্যবসা করতে হলে, বিজ্ঞান শিখতে হলে, নাগা-সন্যাসী হয়ে মাতৃভাষা ত্যাগ করে- ইংরেজি শিখতে হবে, এ ধারণা ভুল। সুন্দর ইংরেজি না জেনেও, জাপানিরা আজ ৩৩০ টির অধিক বহুজাতিক কোম্পানীর মালিক! দুনিয়াব্যাপী দাপটের সঙ্গে ব্যাবসা বাণিজ্য করছে। ফ্রান্সের প্যারিস হয়ে গেছে বিশ্ব সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। প্রবল ইংরেজিপ্রীতির পরও, আমাদের ঘরে বলতে গেলে একটি বহুজাতিক কোম্পানীও নেই! বিজ্ঞানে বিশেষ কোনো আবিষ্কার নেই। আমাদের মাথাপিছু আয়, এখনও বার্ষিক ২ হাজার ডলারের নিচে! আমাদের ইংরেজি প্রীতি, ইংরেজ শাসনের স্মৃতি কী দিয়েছে? আমি মনেকরি- এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার, পথ বদলে জাপানিদের মতো নিজপথে চলার।
জাপানিরা স্বদেশি, পাশাপাশি আন্তর্জাতিকতাবাদী! কোনো পণ্য বানালে, বিদেশে বাজারজাত করার পূর্বে, চিন্তা করে নিজের দেশের প্রয়োজন ও বাজার নিয়ে। নিজের দেশে যে পণ্য ও কোম্পানী ব্যবসা সফল হয় না, তা আন্তর্জাতিক বাজারেও জনপ্রিয়তা পায় না। ভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ও অন্য ভাষায়, কথা বলার বিপক্ষে আমি নই। দ্বিতীয় ভাষা শেখার কৃতিত্ব আছে। তবে নিজের দেশে- নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে বাংলার পরির্বতে অদ্ভুত উচ্চারণে, স্টাইল করে, জটিল মানসিকতায় ইংরেজি বলার বাহাদুরিকে- আমি বোকামি মনে করি! নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মেরে, উল্লাস করা মনে করি।
কষ্টের কথা- প্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার পরও, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও, বাংলা সর্বস্তরে চালু হয় নি আজও। এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, আমাদের সমাজিক ও জাতীয় সমস্যা। বাংলাদেশে অফিস, আদালত, বিদ্যালয়সহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাকে নানান ভাবে অবহেলা করে! গর্বের সঙ্গে ইংরেজির ব্যবহার করে! সাংবিধানিক রীতি ও প্রেরণাকে অমান্য করা হয় অহরহ! এজন্য কোনো নাগরিক বা অফিসারকে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু জাপানের অফিস, আদালত, বিদ্যালয়সহ কোথায়ও জামাই-আদরে ইংরেজি ব্যবহার করা হয় না। কারণ ছাড়া ইংরেজি বা অন্য ভাষা ব্যাবহার- অলিখিত অপরাধ, নিষিদ্ধ!
বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শাসনামল ১৯৭৫ পর্যন্ত অক্ষুণœ ছিল। ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পাঠ-জটিলতা সম্পর্কিত দ্বিতীয় ঘোষণাপত্রে, রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলার পরিবর্তে ‘ইংরেজি ভাষা’ কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এরপর থেকে শুরু হয় সর্বত্র ইংরেজিতে পরিপত্র জারির রেওয়াজ। উত্থান হয় ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্বদানকারী নব্যএলিট শ্রেণীর। এই এলিটরাই চার দশক ধরে- বাংলা ভাষার উপর, গোপনে ও প্রকাশ্যে অত্যাচার করছে। যার নগ্ন কুফল- ভুল বাংলা লেখাকে দোষের মনে করেন না! বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক, বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে বক্তব্য দিয়ে নিজেদের প্রজ্ঞাবান মনে করেন। অথচ পাঠক, শ্রোতা সবাই বাঙালি; বাংলা ভাষা ভাষী, কেউ ইংরেজ নন!
বিদেশি ভাষা ব্যাবহারে জাপান ও বাংলাদেশের চিত্র পুরাই যেন ভিন্ন, উল্টো! জাপানে দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করতে হলে- জাপানি জেনে, জাপানিদের মতো হয়েই করতে হয়। নতুবা গুড বাই! কিন্তু বাংলাদেশে, একজন ইংরেজি জানা বিদেশি- বাংলা না জেনেও, বিশাল দাপটের বড় অঙ্কের বেতনে সারাজীবন কাজ করতে পারে। কোনো সমস্যা হয় না। তার মোসাহেবের অভাব হয় না। বাংলাদেশে বাসকালে কোন বিদেশি- বাংলাভাষা শেখার কোনো চাপ বা প্রয়োজনবোধ করেন না। কিন্তু জাপানে, একজন বিদেশী প্রয়োজন বোধ করেন প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। ভাষা জানা ও বুঝা ছাড়া – কাজ তো পরে কথা, জাপানের আধুনিক টয়লেটের সাইনও বুঝা কষ্টকর। সঠিক জিনিস সঠিক ভাবে কেনা দুরূহ। টোকিও, ওসাকা ও বড় বড় শহর ছাড়া, জাপানে ইংরেজির রেওয়াজ নেই। সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে, রেষ্টুরেন্টের মেনু- সবই জাপানি ভাষায় লেখা।
****
এক সকালে আমি ছোট পুত্র ‘কওন’কে ইংরেজি শেখাচ্ছিলাম। বড় পুত্র ‘করোনেট’ বলল,
– বাবা, তুমি ওকে ইংরেজি শেখাচ্ছো কেন? ওকে হয় বাংলা শেখাও, না হয় জাপানি শেখাও। বড় হয়ে সে হয় বাংলাদেশে, না হয় জাপানেই কাজ করবে। ইংল্যান্ড বা আমেরিকাতে তো কাজ করবে না! অন্যভাষার আগে নিজের ভাষা শিখতে হয়।
– ইংরেজি শেখার আগে নিজের ভাষা ভালো করে শিখতে হয়, তোমাকে কে বলেছে।
– স্কুলে, সেনসে (শিক্ষক) বলেছেন- নিজের ভাষা প্রাণের ভাষা, এই ভাষায়ই একমাত্র প্রকৃত আনন্দ, আসল বুঝ পাওয়া যায়!
আমি ১২ বছরের পুত্রের সচেতনতা দেখে হতবাক! আর ছাত্র-জীবনে তুলনামূলক ভাবে ছাত্রভালো হবার পরও; শুধু ইংরেজি কম জানার কারণে স্যারদের অনেক বকা খেয়েছি। আজ বুঝি – স্যারেরা যেভাবে ইংরেজি শেখান, সেটা কঠিন পথ! সন্দেহ হয় – ইংরেজির শিক্ষকরা হয়তো সঠিক ইংরেজি জানত না। এ ব্যাপারে জাপানে একটি কৌতুক আছে,
– জাপানিজ ইংলিশ টিচার কেননট স্পিক ইংলিশ!
বাংলাদেশে, খেই হারনো অনেক শিক্ষিতজনের আশঙ্কা- বিজ্ঞান ও সভ্যতা ইংরেজি কেন্দ্রিক হওয়ায়, বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষা ও সভ্যতা চর্চা সম্ভব না! ভালো চাকুরি পাবে না! সম্মান ও রোজগার দুই দিকেই পিছিয়ে পড়বে! জ্ঞানী-গুণী হওয়ার পথ বন্দুর হবে! হয়তো এই অপপ্রচারের কারণেই, চারদিকে শিক্ষিত পরিবাররের শিশুদের ইংরেজি স্কুলে পড়ানোর হিরিক। শহরের পিতা-মাতারা আজকাল, শিশুদের বাংলামাধ্যমে পড়াতে চায় না। ভাবে – বাংলা মিডিয়াম পিছিয়ে পড়া সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থা!
শিশুরা ‘আব্বা-আম্মা’র বদলে ‘মাম্মি-ডেডি’ বলে ডাকুক, এটাই যেন বাংলাদেশে অথাকথিত সভ্যতার সাধারণ প্রবণতা। জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, স্পেনে- ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতাপ নেই। আছে নিজ ভাষায় মানবিক চরিত্র ও প্রফেশনাল দক্ষতা শেখার দারুন প্রেম। স্কুলে ইংরেজি বিষয় থাকলেও, ইংরেজি মাধ্যম বলতে প্রতাপশালী তেমন কোনো কিছু নেই। এসব উন্নতজাতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বাঙালিদের মতো, এক বাক্যের কথায়, দুই-তিনটে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে না! নিজেকে- শিক্ষিত ও বাবু-সাহেব বলে জাহির করতে শরম পায়।
“যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না. নয় বিজ্ঞান বোঝেন না”Ñসত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিখ্যাত এই উক্তি সবার জানা! বাংলা ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা করে যে বিশ্বজনীন হওয়ায় যায়, বাঙালি তিন বিজ্ঞানী- জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, এবং প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভাবনা ও কাজ জানলে তা বুঝা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে- প্রথম বর্ষে ‘ইংরেজি’ কম জেনে, বিজ্ঞান পড়ার করুণ ভুক্তভোগী আমি। ১৯৯০ সালে ভু-তত্ত¡ বিজ্ঞানে ভর্তির পর আমি ‘শিলাবিদ্যা’ নামে একমাত্র বাংলা বই পেয়েছিলাম, আর বাকি সব বই ছিল ইংরেজিতে। বাংলা মিডিয়ামে পড়া, মফস্বলের শিক্ষার্থী হঠাৎ ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ার কুফল, আমি প্রথমবর্ষে পেয়েছিলাম! বিজ্ঞান বুঝার ও পরার পরও, শুধু ইংরেজি কম জানার কারণে, ভালো নম্বর পাইনি, প্রথম ও দ্বিতীয় হতে পারি নি।
বাংলায় পড়তে চাইতাম, বাংলায় পরীক্ষা দিতে চাইতাম। কিন্তু শিক্ষকদের অলিখিত মানা ছিল। আমার বাংলাপ্রীতির কারণে একজন শিক্ষক, আমার উপর অতিরুষ্ট হয়ে বলতেন,
– শাহজাহান সিরাজ, বিজ্ঞান কি বাংলা সাহিত্য? বাংলায় লেখতে চাও কেন? ইংরেজিতে না লিখলে আরও কম নম্বর পাবে, পাশ করবে না!
শেষে কোনো পথ না পেয়ে, বিজ্ঞানের চেয়ে ইংরেজি শেখায় বেশি মনোযোগী হয়েছিলাম! অবশেষে শেষ রক্ষা হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গত বিশ বছরেও ভু-তত্তে¡ বাংলায় বই লেখা হয় নি, অনুবাদের কোন প্রকল্প নেয়া হয় নি। হয়তো এখনো বাংলায় বিজ্ঞান পড়ানোর মানসিকতা তৈরি হয় নি! উল্টো বোধহয় গেøাবালাইজেশনের প্রভাবে আরো ’বাংলায় বিজ্ঞান চর্চ্চার’ সম্ভব নয় এই মটিবেশন বেড়েছে।
অথচ আমার পুত্র ‘করোনেট’ জাপানে পড়ে। বিজ্ঞানের বই, দর্শনের বই, ইতিহাসের বই, কোনোটাই তাকে ইংরেজিতে পড়তে হয় না; জাপানি ভাষায় পড়ে! ইংরেজি না বলা, ও না পারার কারণে তাকে ভোগান্তি পোহাতে হয় না। জাপানে স্কুল ও পাড়ার লাইব্রেরির ৯৯% ভাগ বই জাপানি ভাষায়। বিদেশি লেখক ও বিশ্ব-ক্লাসিক ছাড়া, জাপানে ইংরেজি বই নাই বললেই চলে।
শুরু থেকেই বাংলা ভাষার উপর অনেক অত্যাচার ও নিপীড়ন হয়েছে! এখনও হচ্ছে- প্রকাশ্যে ইংরেজি, গোপনে হিন্দি ভাষার, উর্দূ ভাষার আর আরবী ভাষার যন্ত্রণা। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অর্জন অনেক। কিন্তু চর্চায় ব্যর্থতা প্রচুর। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষাপদ্ধতিতে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের চেয়ে বৈষম্য কম নয়! সু² বিচারে দেখলে বুঝা যায়- এখনকার মতো বৈষম্য যেন তখনও ছিল না।
আমাদের প্রিয় ভাষা আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা ছিল, বাংলা ভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে সেই ভাষা নেই। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলেও বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত ছিল; অন্য ভাষার প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে- আজ সেই প্রতিবাদও নেই, সেই সচেতনতাও নেই।
’না পেয়ে, পাওয়ার মিথ্যা স্বস্তি’, এ একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়! বাংলাদেশে যে তরুণসমাজ মাতৃভাষার জন্য সোচ্চার হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল, সেই তরুণ সমাজ এখন আপস করে, নিজ ভাষাকে অবহেলা করে বিদেশমুখী! এই করুণ বাস্তবতা একান্তই কাম্য নয়।
পৃথিবীতে ৮,৬৩৭টি ভাষা আছে। প্রতিনিয়ত ছোটভাষা গুলো আক্রান্ত হচ্ছে, লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বড় বড় ভাষার দাপটে। নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে না শিখলে, শুদ্ধ ভাবে না চর্চা করলে, হয়তো বাংলা ভাষাও স্বকীয়তা হারাবে, যেমনটা হারিয়েছে বলিভিয়ার ভাষা! বলিভিয়ার মানুষ একসময় কথা বলত ‘আয়মারা’ ও ‘কয়ছুয়া’ ভাষায়। খনিজ তেল ও সিসার লোভে স্প্যানিশরা বলিভিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করল! খনিজের সাথে সাথে, ভাষা-সংস্কৃতিও দখল করে নিল। জাতে উঠার জন্য বলিভিয়ানরা, স্প্যানিশ ভাষাকে আবেগের সাথে গ্রহণ করল। ফলে স্প্যানিশ, আয়মারা ও কয়ছুয়া ভাষার মিশ্রণে বলিভিয়ায় সৃষ্টি হলো অদ্ভুত এক জগাখিচুরি ভাষা। বলিভিয়ার ১ কোটি মানুষের মধ্যে, এখন মাত্র ১০ লাখ মানুষ নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে, বাকিরা কথা বলে খিচুরি ভাষায়।
বাংলা ভাষা নিয়ে একই শঙ্কা আছে। ইংরেজি, হিন্দির ও আরবী উৎপাত কমাতে না পারলে, ভয়ের বিষয়- বাংলাও হয়তো একদিন খিচুরি ভাষা হয়ে যাবে। এসএমএসের মাধ্যমে, ফেইবুকের মাধ্যমে, এফএম বেতারের মাধ্যমে, বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে জগাখিচুরি যে ‘বাংলিশ’ বলা প্রচলন করা হচ্ছে, বাঙালিকেও হয়তো বলিভিয়ার দুর্ভাগ্য বরণ করতে হবে।
সম্প্রতি আরেক নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। নারী-শিশুরা, হিন্দি সিনেমা-সিরিয়ালের মাধ্যমে, হিন্দির দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ছে। অনেকে বলেন, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলে বাংলার যতটা বিকৃতি হয় নি, স্বাধীন বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি বিকৃতি হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৫০টির মতো ইলেকট্রনিক গনমাধ্যম রয়েছে। আমি কারণ খুঁজে পাই না, প্রত্যক্ষ আয়-রোজগার, বিনোদন ও ব্যাবসার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পরও- কেন অন্য দেশের, অন্য ভাষার অনুষ্ঠান আমাদের বাজার দখল করে নিবে? দেশীয় অনুষ্ঠানের নিম্ন মানের কারণে, সরকার ও জনগণের অসচেতনতার কারণে, মিথ্যা আবেগ সৃষ্টি করে; দইয়ের পরিবর্তে ঘোল খাইয়ে শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশিচক্র! ফলত- আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির বারোটা বাজাচ্ছে, পদে পদে আহত, নিহত হচ্ছে আমাদের অহংকার!
গোঁজামিল ও অদ্ভুত ভাড়ামী থেকে আমাদের নাটক, গান, অনুষ্ঠান ও চলচিত্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। সৃজনশীলতায় স্বশক্তিতে দাঁড়াতে হবে। চেনাবাহিনী ও কেনাবাহিনীর গ্রাস থেকে- শিক্ষা, মিডিয়া, ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার সময় এখন।
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা মিলিয়ে আজ ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। দিন দিন বাংলা ভাষার শক্তি কমে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমি নতুন কোনো শব্দ তৈরি করছে না। নানান ছুতা-নাতায় পরিভাষা তৈরি হচ্ছে না। অথচ আইসল্যান্ডের ‘আইসল্যান্ডিক’ ভাষায় মাত্র তিন-চার লক্ষ মানুষ কথা বলে। কম্পিউটার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত সব শব্দ আছে তাদের ভাষায়! আধুনিক প্রযুক্তি ও বিশ্বসংস্কৃতির কারণে নতুন শব্দ আসলেই, ওরা আইসল্যান্ডিক অর্থ বের করে। আর জাপানি ভাষায়, সব শব্দ লেখা হয় ‘কাতাকানা’ বর্ণে! কাতাকানা দেখলেই মানুষ শব্দটি বিদেশি বুঝে যায়, আর জাপানি লিখনে অর্থ না থাকলে, মানুষের নামই রেজিস্ট্রেশন করা হয় না। অথচ এব্যাপারে আমার কতই না দরিদ্র, অনেক ক্ষেত্রে হীনমন্য!
প্রযুক্তি নির্ভর একবিংশ শতাব্দীতে তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীন। প্রযুক্তি ও আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমের দোষ দেওয়া অন্যায়। মানসিকতা সঠিক পথে থাকলে, সুফল অবশ্যম্ভাবী। জাপানি তরুণ-তরুণীরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মোবাইল চেট করে। অথচ তাদের হৃদয়- ইংরেজি দখল করতে পারে নি। উল্টো তারা উদ্ভাবণ করেছে ‘ইমিকন’ (ইমোজি) নামে সাংকেতিক মোবাইলটেক ভাষা, যা আজ সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয়।
শব্দ গ্রহণ ও তৈরির ব্যাপারে, জাপানে আমার আছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমার প্রথম পুত্রের নাম রেখেছিলাম ‘করোনেট’ যার অর্থ ‘স্রষ্টার মুকুট’ বা ’রাজ মুকুট’ ! জাপানের সিটি অফিসে নাম রেজেস্ট্রি করতে গেলাম। অফিসার গ্রহণ করলেন না, বললেন,
– এ নামের জাপানি অর্থ নাই। গ্রহণ করার যাবে না। একটা অর্থ বের করতে হবে, না হয় – অন্য নাম দিতে হবে।
শেষে শ্বশুর মশাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে নামটা একটু পরির্তন করে- ‘করোনেট্টো’ রাখলেন! জাপানি অর্থ বের করলেন, গ্রহণীয় হলো। এভাবে জাপানের প্রতিটি নাম, প্রাতিষ্ঠানিক চালুনি হয়ে সমাজে প্রচলিত হয়। নিজস্ব বিশুদ্ধতা রাখা হয়। বাংলায় এমন ব্যবস্থা চালু করা গেলে কতই না ভালো হবে।
১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো কাজই বাংলায় হয় না, ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। ইংরেজি এক রাজভাষা, তাহা অর্থ উপার্জনের ভাষা।” কিন্তু এ লেখার দেড়শ বছর পরও আমরা একই বাস্তবতায় অবস্থান করছি। ইংরেজি এখন আর আমাদের রাজভাষা নয়, তবু ওই প্রবণতা কেন বিদ্যমান?
আমরা যেন – জাতিক ও আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্রের খপ্পরে আজ! বাংলার অবস্থা খুবই শোচনীয়। বাংলা একাডেমির বই নিজের তৈরি ‘প্রমিত বানান রীতি’ মানতে চায় না! বোর্ডের স্কুল পাঠ্য বইয়ে বানান ভুল করা অমার্জনীয় অপরাধ! তারপরও অহরহ ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছকৃত ভুল হচ্ছে। পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র-রেডিও-টিভিসমূহে, বাংলা ভাষার নানা মাত্রিক ভুল ব্যবহার সৃষ্টি করছে বহুমুখী বিভ্রান্তি। এই নৈরাজ্যের সময় মনে হচ্ছে- বাংলাকে দেখভাল করার কেউ যেন নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে ১৯১৫ সালে লিখেছেন, ‘উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে। পশ্চিম হইতে যা কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান কারণ, এই শিক্ষাকে তারা দেশী ভাষার আধারে বাধাই করিতে পারিয়াছে। অথচ জাপানি ভাষার ধারণা শক্তি আমাদের ভাষার চেয়ে বেশি নয়। নতুন কথা সৃষ্টি করিবার শক্তি আমাদের ভাষায় অপরিসীম। বাংলা ভাষাতেই আমরা উচ্চশিক্ষা দিব এবং দেওয়া যায়, এবং দিলে তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে।’
বাংলা নিয়ে কারো হীনমন্য হওয়া উচিত না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের মতো সুসাহিত্যিক, হাজারো মনীষী সৃষ্টি হয়েছে প্রিয় বাংলা ভাষায়। আসুন আমরা সবাই নিজ ভাষাকে ভালোবাসি, প্রাণের কথা জাপানিদের মতো, প্রাণ দিয়ে নিজের ভাষায় বলি। বাংলাকে শ্রদ্ধা করি। স্বদেশ প্রেমে বলিয়ান হয়ে সর্বস্তরে বাংলা প্রচারে মনোযোগী হই।