জাপানি বিয়েতে শ্বশুর-জামাই পাঞ্জা

জাপানি বিয়েতে শ্বশুর-জামাই পাঞ্জা

জাপানি বিয়েতে শ্বশুর-জামাইয়ের পাঞ্জা এক ব্যতিক্রম ঐতিহ্য। যেন কন্যা ছিনিয়ে নিতে জামাইকে শ্বশুরের কাছে পেশির পরিচয় দিতে হচ্ছে !

জাপান এশিয়ার একটি দেশ হলেও এর ধর্ম-আচার-প্রথা অন্যদেশ থেকে একেবারে ভিন্ন! আধুনিকতায় এদের সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সহনশীলতা ও স্বাধীনতা এসেছে, ঝামেলামুক্ত হয়েছে জীবন, কিন্তু নিজস্বতা হারায়নি।

আধুনিক এ যুগে, বিশেষ করে ১৯৮০ সালের পর থেকে বিশ্বায়নের প্রভাবে নারী-পুরুষ উভয়েই বেশ বিয়ে বিমুখ।এর মূল কারণ জীবন-যাপন ও কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততা, নিজের পছন্দ মত থাকার স্বাধীনতা, সন্তান ও জীবনসঙ্গীকে লালনের আস্থার অভাব, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি । তারপরও প্রতিবছর গড়ে সাত লাখ বিয়ে হয় জাপানে।

বলা হয়, জাপানিদের জন্মহার স্বাভাবিক রাখার জন্য, বিয়ে ও সন্তান গ্রহন আরও বাড়ানো দরকার। বর্তমানে যে হার আছে, এভাবে চললে সাতশ’ বছর পর জাপান নাকি জনশূন্য হয়ে যাবে! তাই পরিবার, সমাজ, সরকার- চারদিক থেকে জাপানিরা বিয়েও সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ পায়।

তবে বহু বিয়ে, সমকামী বিয়ে, ক্ষণিক সম্পর্ক- এসব এখানে অঘোষিত নিষিদ্ধ। কিন্তু ভিন্নজাতির, ভিন্নবর্ণের ও ভিন্নধর্মের মাঝে বিয়েকে এখানে খারাপ মনে করা হয় না, অনেকক্ষেত্রেই আধুনিক ও মুক্তমনা বলে যুগলদের প্রশংসা করা হয়।

জাপানের শহর ও গ্রামে বিয়ের রীতি, তরুণ-তরুণীদের জীবনযাপন ভিন্নরকম। গ্রামের বিয়েগুলো সাধারণত পারিবারকেন্দ্রিক হয়। এদিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ মিল আছে। তবে শহরের সম্পর্কগুলো অনেকাংশে ‘লিভ-টুগেদার’ কেন্দ্রিক। জানা-শোনা দুজন মানুষ একসাথে থাকে, যতদিন না তারা মনে করে একে অপরের সাথে সারাজীবন কাটানো যায়, ততদিন সাধারনত বিয়ে করে না। তবে সন্তান হলে বা নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করে ফেলে।

পশ্চিমা ধাচের ফ্যাশন জাপানি তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় হলেও তারা সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বহুগামিতা’ ও যৌন স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে জাপানিরা বেশ রক্ষণশীল, মানবিক ও ধর্মকেন্দ্রিক। জাপানি তরুণ-তরুণীরা সাধারণত একসঙ্গে অনেকের সাথে সম্পর্ক করে না; যে করে তার কপালে দুঃখ আছে। জানাজানি হলে তার সঙ্গে কেউ সহজে মিশতে চায় না, নিরাপদ মনে করে না।

দিন দিন জাপানের গ্রামগুলোতেও ‘লিভটুগেদার’ বাড়ছে। তবে শহর থেকে এর রূপ কিছুটা ভিন্ন। গ্রামের সম্পর্কগুলো সাধারণত সহজে যৌনতায় গড়ায় না, আর গড়ালে তা বিয়েতে পরিণতি পায়। তাছাড়া বিয়ে বর্হিভূত সম্পর্কে সন্তান জন্মালে তার দায়িত্ব মা-বাবাকে নিতে হয়। বিয়ে না হলেও বাবা-মার পরিচয় পায় সন্তান। বাবাকে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হয়। এক্ষেত্রে শিশু সাধারণত মায়ের কাছেই থাকে।

সারা দুনিয়াতেই বিয়ে হয় ধর্ম বা আইনকেন্দ্রিক। জাপানে ধর্ম যাই হোক না কেন, আইনগতভাবে সিটি অফিসে নিবন্ধন করতেই হবে সবাইকে। আইনের পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মকেন্দ্রিক বিয়েও এখানে জনপ্রিয় ও সর্বজনস্বীকৃত।

জাপানিদের ধর্মবিশ্বাস বেশ জটিল। একজন মানুষ একইসঙ্গে একাধিক ধর্ম পালন করেন। কেউ নাস্তিক হলেও ধর্মীয় আচারগুলোকে সামাজিক ও মানবিক আচার হিসাবে মানেন। অস্বীকার বা বিদ্রোহ করেন না। তাই বিয়ের সময় শ্রাইন বা গির্জায় যেতে কেউ অস্বীকার করেন না।

জাপানি বিয়ের প্রথম পর্ব হয় সাধারত ‘সিন্তু’ ধর্মমতে। এসময় কনে ঐতিহ্যবাহী সাদা জাপানি পোশাক পরেন, আর বর পরেন ধূসর অতনো-কিমোনো। প্রার্থনার আগে বর-কনে দু’জনই বিশুদ্ধ ‘সাকি’ বা ওয়াইন পান করে।

তিনবার গন্ধ নেওয়ার পর ছোট তিন বাটি ওয়াইন পান করে বর ও কনে। জাপানিরা ‘তিন’ সংখ্যাটিকে পূর্ণতা ও সাফল্যের প্রতীক মনে করে। জাপানিদের বিশ্বাস, ওয়াইন পানের পর শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতা আসে, পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদের সাথে উত্তর পুরুষের মঙ্গলযাত্রারও দুয়ার খুলে যায়। এই পর্বে কনের শুভ্রপোশাক শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক বলে মনে করা হয়। দু’পক্ষের মা-বাবা ও আত্নীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে পিনপতন নিরবতায় সমস্ত প্রথা পালন শেষে বর-কনে একে অন্যকে নমঃ করে। জীবন সাথী হিসাবে মেনে নেয়।

এরপর শুরু হয় নানা পর্বের রিসিপশন। রিসিপশনে বর-কনে দু’জনই দামী ‘কিমোনো’ পরে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি বিয়ের পেশাকের দাম এত বেশি যে, বর-কনে একবার পরার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করতে চায় না। তাই ‘ওয়েডিং হাউজ’ থেকে ভাড়া নেয় প্রায় সবাই।

রিসিপশনের সময় নানা ধরনের কৌতুক করা হয়। বর-কনে প্রতি পর্বে পোশাক পরিবর্তন করে নতুন রূপে হাজির হয়, যা একধরনের রীতি ও বিনোদন। এসময় জাপানিরা সামুরাই আমলের পোশাক পরে মজা করে, তলোয়ার দিয়ে কেক ও কাটে কেউ কেউ।

তবে আধুনিক বিয়েতে পাশ্চাত্য স্টাইল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অধিকাংশ কনের পছন্দ হলিউডের সিনেমার মত ‘ওয়েস্টার্ন লং ওয়েডিং ড্রেস’। জাপানিরা শতকরা ১ ভাগের কম খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হলেও ৬০ ভাগ বর-কনে বিয়ে করে চার্চে গিয়ে। জনশ্রুতি আছে- জাপানিরা তিনধর্মের জাতি। একজন জাপানি জন্মে সিন্তু হয়ে, বিয়ে করে খ্রিস্টান হয়ে, আর মরে বুদ্ধিস্ট হয়ে!

গত কয়েকদশক ধরে এখানে হরেক রকমের বিয়ের রীতি চালু হয়েছে- প্রাকৃতিক বিয়ে, গণ বিয়ে, বিদেশি বিয়ে, ভিন্নজাতিতে বিয়ে ইত্যাদি। কোন কোন যুগল তাদের পছন্দ মত বিভিন্ন ঋতুতে ও প্রাকৃতিক পরিবেশে গিয়ে বিয়ে করেন। সূর্যমুখির খেতে ফুলের আবেশে বিয়ে, সাকুরার হানামিতে (চেরি বা অন্য কোন ফুলের দৃশ্য দেখতে দেখতে) বিয়ে, মমিজির স্পটে (জাপানি ম্যাপল গাছের নিচে) বিয়ে, ঝর্ণার ধারে বিয়ে- বেশ আর্কষণীয়।

জাপানি বিয়ের উপহার দেওয়ার রীতি ও অঘোষিতভাবে বাধ্যতামূলক। তবে বাংলাদেশের মতো থালা-বাসন, ফ্রিজ, টিভি, গয়না নয়! এখানে উপহার মানে টাকা (ইয়েন), আর্কষণীয় নকশাদার ইনভেলাপে মোড়ানো নোট। কেউ দশ হাজারের কম দেয় না।

বর-কনে কাউকে দাওয়াত দিলে ধরে নেওয়া হয় অতিথি ‘স্বামী-স্ত্রী’ দু’জনেই আসবেন। কেউ না আসলে ধরে নেওয়া হয় সে বর-কনের মঙ্গল কামনা করেনি, প্রচণ্ড অভদ্র মানুষ!

‘জবহান্টিং’ বা চাকরি খোঁজার মত বতর্মানে জাপানে ‘স্পাউসহান্টিং’ বা পাত্র-পাত্রী খোঁজা জনপ্রিয়। যেহেতু তরুণ-তরুণীরা বিয়ে করতে চায় না, সন্তান নিতে চায় না, সেহেতু কোন কোন অঞ্চলে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ‘স্পাউসহান্টিং’ ইভেন্ট আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশের মতে কনে দেখার রীতি জাপানেও আছে । তবে একটু ভিন্ন, পিতা-মাতা, আত্নীয়-স্বজন তেমন নাক গলান না, পাত্র-পাত্রীর পছন্দই আসল সিদ্ধান্ত। বর-কনে দেখাকে জাপানে বলা হয় ‘মিয়াই’। ঘটকমশাই বংশ, লেখাপড়া, স্বভাব, চরিত্র মিলিয়ে বর-কনেকে পরিচয় করিয়ে দেন। বর-কনেকে নির্দিষ্টস্থানে বা রেস্টুরেন্টে বসিয়ে চলে যান। বর-কনে খোলামেলা আলাপ করে, একসঙ্গে খায় ও একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করে। ভালো লাগলে ঘটককে বলে। তারপর বিয়ের আয়োজন করা হয়।

যাই হোক, বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথিদের সামানে পেশাদার নৃত্য পরিবেশক দলের সাথে বর-কনে নাচে, নাচে তার বন্ধু-বান্ধবও। শ্বশুরের সঙ্গে জামাই পাঞ্জা লড়ে ! বিশাল কেককাটার পর আগত অতিথিরা মন ভরে পান করে, শত প্রকারের খাবার খায়।

জাপানে প্রথম বিয়ের দাওয়াত খাওয়াটা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত করুণ এক ইতিহাস। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ক্ষুধায় যখন আমি কাতর, তখন খাবার আসলো এক টুকরা ‘সুসি’ (কাঁচা মাছের খাবার রেসিপি)। আমি তো দেখে হতাশ!

ভেবেছিলাম আর খাবার আসবে না, এ খেয়েই আজ থাকতে হবে। ওই সময় বাংলাদেশের বিয়েতে পোলাও-বিরিয়ানি, কোরমা-কালিয়া খাওয়ার কথা মনে পড়ছিল। আমি জানতামনা- জাপানি বিয়েতে একসঙ্গে অনেক খাবার দেয় না। এরপর একটার পর একটা প্রায় দুইঘণ্টা নতুন নতুন আইটেম আসলো। কতক্ষণ খাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

খেতে খেতে হল ভর্তি অতিথি সবাই শিল্পীদের নাচ-গান-কৌতুক দেখলাম। বর-কনে বিনোদন অনুষ্ঠানের পর সবাইকে গেইটে বিদায় দিল। গেইটে আয়োজন করা হয়েছে বর-কনের বেড়ে ওঠা জীবনের উপর ছবির প্রর্দশনী। সবাই একে একে বর-কনের সঙ্গে ছবি তুলছে আর শুভ কামনা জানাচ্ছে। আমিও ছবি তুললাম।

—————————————————————
বিঃদ্রঃ – লেখাটি বিডিনিউজ২৪ এ (২০ নভেম্বর ২০১৬) প্রকাশিত হয়েছে

জাপানে দৈত্যের নাচ দেখার স্মৃতি

জাপানে দৈত্যের নাচ দেখার স্মৃতি

আমি জাপানে দৈত্যের নাচ দেখেছি- এ কথা শুনলে, নিশ্চিত করে বলা যায়, অধিকাংশ মানুষই আমাকে হয় পাগল বা অতি আলাপী বলবে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী উৎসুকেরা হয়তো শিশুর মতো নানা প্রশ্ন করে বিষয়টাকে পেঁচিয়ে ফেলবে।

কিন্ত কথা সত্যি। আমি দৈত্যের নাচ দেখেছি। দৈত্যের নাচের কথা প্রথম যেদিন শুনেছিলাম আমারও বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছিলাম- এটা কী করে সম্ভব? তাও আবার জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাপানে!

২০১১ সালে প্রথম যখন সাদো দ্বীপে আসি, জাপানি বন্ধুদের কথায় অনুমান করেছিলাম- দৈত্যের নাচ, হয়তো প্লানচেট, জ্বিন হাজির, যাদু-মন্ত্রের মতো কিছু একটা হবে।

এক বন্ধু বললো- বসন্তের শুরুতে দেখতে পারো! এ কথা শুনে আমার গা ছম ছম করেছিল, ভয়ে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

ছোটবেলা থেকেই আমি যাদু-মন্ত্র, প্রাচীন কুসংস্কার পছন্দ করি না। আমার বয়স যখন দশ কিংবা বারো, একবার মুক্তাগাছায় নানার বাড়িতে জ্বিন হাজির দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রথম প্রথম আমি তো বিশ্বাস করতে চাইনি। কিন্তু রাতের অন্ধকারে অদ্ভুত কণ্ঠে জ্বিনকে কথা বলতে শুনে অবাক হয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি না বলে, যখন রাতের মজমার নীরবতা ভঙ্গ করেছিলাম, জ্বিনের আছর পাওয়া লোকটি আমাকে মারতে এসেছিল!

পাহাড়, বন, সমুদ্রে ঘেরা সাদো দ্বীপকে প্রথম থেকেই আমার রহস্যময় মনে হয়। সবকিছুই অন্যরকম- একটু বেশি সরল, একটু বেশি ভালো; যা সন্দেহ জাগায়। যখন জানলাম- সাদো দ্বীপ একসময় নির্বাসনের জন্য ব্যবহার করা হতো, তখন ভয় ও রহস্যের মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। হাজার বছর ধরে নাকি, মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে এই দ্বীপে অনেক পরাজিত রাজা, যোদ্ধা, প্রতিবাদী, বিপ্লবী আর অপরাধীদের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। আজকের সাদোবাসীর জনগণ নাকি তাদেরই উত্তরসূরি।

বসন্তের শুরুতে এক বিকালে কাছের সিন্তু শ্রারইন (দেবালয়) থেকে বিকট ঢোলের শব্দ আসছিল! শব্দটির সঙ্গে পূজার ঢোলের শব্দের মিল পাচ্ছিলাম, কিন্তু বিকট। বন্ধুরা বললো- আজ দৈত্যের নাচ হবে, চল যাই দেখে আসি!

ভয় ও উৎসাহ মিশ্র প্রত্যাশা নিয়ে শ্রাইনের সামনে দিয়ে দেখি, সত্যিই কয়েকটি দৈত্য নাচছে। আমি তো দেখে অবাক। ভয়ার্ত কিন্তু অনুপম নাচ।

নাটুয়াদের পোশাক, ঝাঁকড়া চুল, রাক্ষসের মুখোশ আর দর্শকদের উৎসুক দৃষ্টিতে, নিজেকে মনে হচ্ছিল- রাক্ষসের দেশে আমি এক আমন্ত্রিত অতিথি। চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকের মতো দৈত্যদের উথাল-পাতাল নাচে আমি মুগ্ধ হলেও মন থেকে ভয় কাটছিলো না। দৈত্যের লাঠির মারের ভয়ে দৈত্যের কাছে যাইনি! সঙ্গে থাকা বান্ধবী আশ্বস্ত করলো- বিপদজনক কিছুই হবে না। ভয় পেয়ো না! জাপানি দৈত্য, কিন্তু অনেক ভদ্র!

সাদোবাসী দৈত্যের নাচকে ‘ওনি-ডাইকা’ বা ‘ওনডাইকো’ বলে। জাপানি শব্দ ‘ওনি’ মানে দৈত্য আর ড্রামের তালে তালে নাচকে বলা হয় ‘ডাইকো’। সারা জাপানে প্রায় ৫০০০ রকমের ভূত-পেত্নী-দৈত্যের মিথ আছে। যা শুধু- শিশুদের রূপকথার অংশই না, স্থানীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত। জাপানের প্রায় সব সংস্কৃতি, উৎসব ও আচার কোন না কোন ভাবে প্রাচীন বিশ্বাস, স্থানীয় লোককথা ও মানবিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত।

সারা দুনিয়াতে দৈত্য, রাক্ষস ও অসুরকে যেখানে অশুভতার প্রতীক হিসাবে ঘৃণা করা হয়, সেখানে সাদোবাসী ‘দৈত্য’কে দেখে পুরোপুরি ভিন্নভাবে- সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে। স্থানীয় বিশ্বাস- অশুভ করার সব রকমের ক্ষমতা দৈত্য ও অসুরের আছে। দৈত্যকে খুশি রাখতে পারলে, সে কখনো ক্ষতি করে না।

ফলে সৌভাগ্য ও সফলতা আসে সহজে। এই বিশ্বাসে, সাদোবাসী ফসল কাটা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বসন্তের শুরুতে- পাড়ায় পাড়ায় ওনিডাইকো’র আয়োজন করে। অনুমানিক ৮৭৭ সাল থেকে সাদোতে ওনিডাইকো জনপ্রিয়তার সাথে চর্চা করা হচ্ছে! সাদোতে ১১০টিরও বেশি ওনিডাইকো লোকনৃত্য গ্রুপ রয়েছে! ১৯৩০ সালে পঞ্চম বার্ষিক জাতীয় লোক উৎসবে যোগদানের মাধ্যমে সাদোর ওনিডাইকো সারা জাপানে পরিচিতি লাভ করে।

অঞ্চলভেদে লোকনৃত্য ‘অনিডাইকো’ তিন প্রকারের হয়ে থাকে। ১) আইকাওয়া অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের বৃদ্ধদের নাচ, যাকে মামেমাকিও বলা হয়, ২) কুনিনাকি অর্থাৎ মধ্যঅঞ্চলীয় সাদা-কালো পোশাক পরে দুইটি ড্রাগন বা সিংহের সঙ্গে নাচ আর ৩) দক্ষিণদের ড্রামের বাজনার সাথে বাঁশি বাজিয়ে নাচ। তবে সব নাচেই ড্রামের তালে তালে ড্রাগন ও ওনি’র লড়াই চলে, অবশেষে ড্রামের কাছে এসে ‘ওনি’ নতি স্বীকার করে।

অশুভতা তাড়ানোর জন্য, ঝামেলামুক্ত রাখার জন্য; সাদোর প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানে ও উৎসব শুরু হয় দৈত্যের নাচ দিয়ে। সুস্বাস্থ্য, সৌভাগ্য, সুখ-শান্তি নিশ্চিতের জন্য একে এক ধরনের প্রার্থনা হিসাবে গণ্য করা হয়। উৎসব শুরুর আগে ‘ওনির দল’ ঘরে ঘরে যায়। আর্শীবাদ শেষে গৃহস্থ খাবারের আয়োজন করে, দান করে- মনে করেন দানের মাধ্যমে ওনি’র সন্তুষ্টি ও অকল্যাণ থেকে তার পরিবার ও ভাগ্য রক্ষা পাবে।

সংসারে শিশু থাকলে শিশুদেরকে ড্রাগন আলিঙ্গন করে অকল্যাণ মুক্ত রাখে। অঞ্চল ভেদে অনেক রকমের দৈত্য ও দৈত্যের নাচ আছে। নাচের প্রকার কিছুটা ভিন্ন হলেও ঝাঁকড়া চুল, চকচকে রঙ্গিন পোশাক, বাঁশ পাতা আর লতায় মোড়ানো জাপানি টাইকো ঢোল, মানুষ চালিত ড্রাগন আয়োজনে সবাই একই রকম। প্রাচীন এ লোকনৃত্য অতি জনপ্রিয় হওযার কারণে হয়তো- সাদোর সবচেয়ে উঁচু পর্বত ‘ডনডেন’ (৯৮০ মিটার) ওনিডাইকো ঢোলের বাজনা ‘ডন ডেনের’ নামের সঙ্গে মিলে। সাদো দ্বীপকে অনেকে ‘ল্যান্ড অফ ওনিডাইকো’ বলে।

জাপানের প্রতিটি প্রদেশে কোন না কোন বিশেষ সংস্কৃতি আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিকতায় উন্নত হলেও ক্ষতি করে না এমন ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও আচারকে জাপান ত্যাগ করেনি। জাপানি প্রশাসন স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালনে উৎসাহ ও সহযোগিতা দেয়। হয়তো সেই কারণে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি আজও জাপানে টিকে আছে; ইউনেস্কো স্বীকৃত, বিশ্বখ্যাত ১৩টি ‘কালচারাল হেরিটেজ’ রয়েছে জাপানে।

—————————————————————
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত/ ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

জাপানি বাবুদের স্কুল

জাপানি বাবুদের স্কুল

[fusion_text]

[/fusion_text]

কিন্তু সত্যি, জাপানে প্রতিটি শিশু এক বছর বয়স থেকেই স্কুলে যায়। হাসি, আনন্দ আর খেলাধুলায় বেড়ে ওঠে।

এ শিশুদের জন্য আছে জাপানে বিশেষ স্কুল, নাম তার ‘হুকশু’। যাকে কিন্ডারগার্টেন বা পশ্চিমা ধাঁচের ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ বলা যাবে না। পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল, আমাদের প্রাথমিক স্কুলের মতো। সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক, এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যও।

ভিন্ন ধরনের এই স্কুলে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বাবা-মায়েরা তাদের শিশুকে দিয়ে যান। বিকেল ৪টা-৫টায় বাবা-মা শিশুকে নিয়ে আসে। শিশু সারাদিন স্কুলে নিরাপদে থাকে,তাই বাবা-মাকে শিশু নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হয় না।

স্কুলে শিশু খেলা করে, খাবার খায়, দুপুরের সবাই একসঙ্গে ঘুমায়, গরমের সময় একসঙ্গে জলকেলি করে। একতার সাথে সব শিশু বেড়ে উঠে অনবদ্য বন্ধনে।

শিশুকে সময়মত স্কুলে দেয়ার জনপ্রিয় রীতি যদি কোন পিতা-মাতা না মানলে ধরে নেওয়া হয়, বাচ্চা বা পিতা-মাতার সমস্যা আছে। তাছাড়া ‘হুকশু’ না গেলে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির সমস্যা হয়। আধুনিক জাপানে পিতা-মাতারা শিশুদের নিরক্ষর রাখেন না। এখানে সবাই একশ’ ভাগ শিক্ষিত।

‘হুকশু’ স্কুলে কী শেখানো হয় তা নিয়ে আমার বেশ কৌতুহল ছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকদিন নিজের শিশুকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে জেনেছি। অভিবাদন, প্রশংসা, একতা, অন্যের ক্ষতি না করা, স্বাস্থ্য ও জিনিসের যত্ন নেয়া, নিজের কাজ নিজে করা- এসব শিশুর প্রথম পাঠ এখানে।

আশ্চর্যের বিষয়, শিশুর স্কুল ব্যাগে কোন বই থাকে না ! থাকে দাঁত পরিষ্কারের ব্রাশ, ছোট টাওয়াল, একটি পানি পানের গ্লাস ও রুমাল, ভাতের ‘ছোট টিফিন কৌটা’, চপস্টিক আর একটা ছোট নোট খাতা। বাড়ি থেকে ভাত নিলেও স্কুলে রান্না করা একই রকম সুষম সবজি, তরকারি ও ফলমূল দেয়া হয়।

বিশেষ দিনে বিশেষ আয়োজন হলে তা স্কুলের দরজায় রাখা কাচের বাক্সে রেখে পিতা-মাতাকে দেখানো হয়। কোন বিশেষ উৎসব বা ঋতু পরির্বতন হলে তার নমুনাও প্রবেশদ্বারের টেবিলে সাজিয়ে রেখে শিশুদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়। পিতা-মাতাদেরকেও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় উৎসবের আগমন।

জাপানি স্কুলে হয় পিতা বা মাতাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হয়। ড্রাইভার, খানসামা বা অনাত্নীয় কারো মাধ্যমে শিশুকে স্কুলে পাঠানো এখানে অঘোষিত নিষিদ্ধ ! কেউ পাঠায় না। সবাই নিজের শিশুকে নিজেই স্কুলে নিয়ে যায়।

ট্রাফিক কম, প্রত্যেক অঞ্চলে পরিকল্পনামাফিক স্কুল ও সবার গাড়ি থাকার কারণে বাংলাদেশের মতো ভোগান্তি নেই এখানে। আবার কারণ ছাড়া এক অঞ্চলের শিশু অন্য অঞ্চলের স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায় না। ঢাকার মতো অলিতে-গলিতে বাঙলা-ইংরেজি, ভালো-খারাপ স্কুল নেই। সব স্কুল ভালো, সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলেই পড়া ও পদ্ধতি এক।

শিশু অস্বাভাবিক ভালো বা খারাপ কিছু করলে, বিশেষ নির্দেশনা থাকলে শিক্ষক-শিক্ষিকা নোট লিখে দেন। বাবা-মা তা দেখে বিষয়টিতে নজর দেন। স্কুল থেকে শিশুকে বাড়ির কোন কাজ দেয়া হয় না। যা শেখার শিশুরা স্কুলেই শেখে।

জাপানিরা বলে, বাড়ি হলো বিশ্রাম ও ভালোবাসার জায়গা। আর স্কুল হলো শেখার জায়গা।

বন্ধু বা বান্ধবীর কিছু পছন্দ না হলে জাপানি শিশুরা ছোটবেলা থেকেই সরাসরি প্রতিবাদ বা ঝগড়া করে না। কোন কিছু খুব অপছন্দ বা খারাপ লাগলে শিশুরা সাধারণত কাঁদতে কাঁদতে শিক্ষক বা পিতামাতাকে জানায়। শিক্ষক ও পিতা-মাতারা শিশুদের শাসন করে কথায়, গায়ে হাত দেয় না। যেসব পিতা-মাতা বা শিক্ষক শিশুর গায়ে হাত তোলেন, তারা মন্দ মানুষ হিসাবে বিবেচিত হন সমাজে।

কোন শিশু ভুল করলে শিশুকে ততক্ষণ বোঝানো হয়, যতক্ষণ শিশু না বলে- ‘আমি বুঝেছি’। শিশুরা সাধারণত ভুল বোঝার পর কান্না করে, নিজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করে আর সে ভুলটি করবে না।

স্কুলের পাশাপাশি জাতীয় টিভি, ‘এনএইচকে’ একই ধারায় স্কুলে যাওয়ার আগে সকালে এবং স্কুল ফেরার পর শিশুদের জন্য নানা ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে। শিশু-হিরো অ্যানিমেশন, পুতুল নাচ, লোকজ নাচ-গানের অনুষ্ঠান জাপানি শিশুদের প্রিয়।

১৯৬২ সাল থেকে এনএইচকে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে শিশুদের অনুষ্ঠান তৈরি ও প্রচার করে। অনেকে বলেন, জাপানিরা সুশৃঙ্খল ও সৎ হওয়ার পেছনে ‘হুকশো’ ও ‘এনএইচকে’-এর অবদান সবচেয়ে বেশি।

জাপানের শিশুদের মাঝে বাংলাদেশের মতো পিতা-মাতার সামাজিক অবস্থানকেন্দ্রিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই নেই। স্কুলে প্রথম হওয়া রীতির পরিবর্তে এখানে আছে গ্রেড পদ্ধতি। কোন শিক্ষার্র্থী ফেল করে না । ​ ককোন কারণে কোন বিষয়ে শিশু খুব খারাপ করলে, শিক্ষক-শিক্ষিকাকে জবাবদিহি করতে হয়।

আমি তো দেখে অবাক ! এক বছরের বাচ্চারাও স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। যেহেতু শিশু নিজে পুরোপুরি বুঝতে পারে না, তাই বাবা বা মায়ের সঙ্গী হয়ে, কোলে করে শিশু ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

আনন্দের সাথে শিক্ষা জাপানি শিশু-শিক্ষার শুক্তি। শহর কিংবা গ্রাম, সব স্কুলেই শিক্ষাপদ্ধতি এক। প্রকৃতি দেখা, জীবন থেকে শেখা, সুনাগরিক হিসাবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে ‘হুকশু’ স্কুল থেকেই নিয়মিত ভ্রমণ, সংস্কৃতি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

শিল্পচর্চা সব শিশুর জন্য আবশ্যক। আঁকাআকি, নাচ-গান, খেলা, আনন্দ-উল্লাসে প্রতিটি শিশু দক্ষতার সঙ্গে বেড়ে ওঠে। পিতা-মাতা পেশার বা সামাজিক অবস্থানের কারণে কোন শিশুই ভর্তি সুবিধা, অতিরিক্ত প্রশংসা ও অনুপ্রেরণা পায় না।

স্কুলের আচার ও পদ্ধতিতে শিশুর ধনী-গরীব, সাদা-কালো বা ধর্ম-বর্ণের পরিচয় বোঝার কোন উপায় নেই। সবাই সমান। কেউ কাউকে ছোট বা বড় ভাবে না। এ যেন পুঁজিবাদী দেশে সাম্যবাদের চর্চা!

হুকশু স্কুলের প্রতিটি উপাদান ও আয়োজন শিশুদের আনন্দ, চিন্তা ও দক্ষতার উন্নয়নের পাশাপাশি চরিত্র গঠনের অনুকূল। কোন কিছু ভুল প্রমাণিত হলে সেই সময়েই তা পরিবর্তন বা সরিয়ে ফেলা হয়।

‘হুকশু’তে আমার সব ছেলে-মেয়েরা গিয়েছে। আমি দেখেছি, এ এক দারুণ পদ্ধতি। এসব স্কুলে নারী শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। সবাই শিশুযত্নের ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত । মায়ের মতই শিক্ষকরা শিশুর যত্ন নেন, শিক্ষা দেন। হৃদয়ের বন্ধন এমন দৃঢ় হয় যে ​ ​

স্কুল পরিবর্তনের বা বিদায়ের সময় শিশুও তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদে।
আমি যখন সকালে আমার শিশুকে স্কুলে নিয়ে যাই, সবসময় দরজায় একজন শিক্ষককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তিনি অভিভাবক ও শিক্ষার্থী, দুজনকেই ‘শুভ সকাল’ বলেন। নেতিবাচক শব্দ স্কুলে একেবারেই ব্যবহার করা হয় না। সততা, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়া হয় পদে পদে।

আদর্শের যে আচরণ আমরা শিশুকে শেখাতে চাই, তা শিশুর সামনে প্রতিদিন চর্চা করে জাপানি স্কুলে শিশুর অভ্যাসে পরিণত করা হয়। আনন্দের সঙ্গে স্কুলে সব ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে খেলে। গড়ে উঠে একই পরিবারে সদস্যের মতো ভালোবাসার বন্ধনে।

এ স্কুলে শিশুরা সাধারণত ছয় বছর পর্যন্ত যায়, এরপর প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ইতোমধ্যে ‘হুকশো’ স্কুলেই শিশু নিজের শরীরের যত্ন নেয়া, অন্যকে ভালোবাসা, লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা শিখে ফেলে।
গত পনের বছরে পিতা-মাতা তো পরের কথা, জাপানি শিশুদেরকেও রুক্ষ স্বরে ঝগড়া করতে দেখিনি। এ যেন এক অসম্ভবের দেশ! ঢাকার মত, এখানে পিতা-মাতার স্কুলের সামনে মজমা বসিয়ে, ঝাল-মুড়ি খেয়ে সময় নষ্ট করেন না, পাহারা দেন না।

গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই স্কুলের পরিবেশ ও শিক্ষাপদ্ধতি প্রায় একই রকম। সরকারি, বেসরকারি সব স্কু্লকেই জাতীয় শিক্ষানীতি ও অনুমোদিত পাঠপদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।

স্কুলে অঘোষিত কোন ব্যবসা বা আয়ের সুযোগ নেই। সব হিসাব ও পরিকল্পনা উন্মুক্ত ও স্বাভাবিক। ঘোষণার বাইরে সবকিছুই বেআইনি ও দণ্ডনীয়। কেউ সীমা অতিক্রম করে না সাধারণত। যদি কখনো কিছু ঘটে, মিছিল মিটিং ছাড়াই- শুধু অভিযোগের ভিত্তিতেই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়।

‘হুকশু’তে প্রতিটি ছেলে-মেয়ের জন্মদিনের কেক-পার্টি আয়োজন করা হয়। বিষয়টি প্রথম শুনে আমার বেশ অন্যরকম মনে হয়েছিল। প্রতিটি ছেলে-মেয়ের জন্মদিন যদি পালিত হয়, তাহলে তো প্র্রতিদিনই কারো না কারো জন্মদিন থাকবে। তারপর খোঁজ নিয়ে দেখি, প্রতি সপ্তাহে একবার সাপ্তাহিক ‘শুভ জন্মদিন’ আয়োজন করা হয়। ওই সপ্তাহে জন্ম নেওয়া সব শিশুর জন্মদিন একসঙ্গে পালন করা হয়। মূল উদ্দেশ্য- শিশুদেরকে বিনোদন, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেওয়া।

মনোবিজ্ঞানের মতে, শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে পাঁচ বছরের রেকডিং-এর ওপর ভিত্তি করে। এসময় নাকি শিশু যা দেখে-শুনে ও বুঝে তার উপর ভিত্তি করেই শিশুর চরিত্র, ভাবনা, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। হয়তো বৈজ্ঞানিক এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই জাপান সরকার শিশু শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের শিশুরা সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকে। ধনী শিশুদের কিছু সুযোগ থাকলেও বড় হয় ‘কাজের মানুষের’ কোলে, আর গরীর শিশুদের শিশুকাল কেটে যায় ঘোরাঘুরি করে। ফলে সারাজীবন শিক্ষাহীন শিশুকালের খেসারত দিতে হয়।

জাপানের মতো বাংলাদেশের শিশুদের জন্য ‘হুকশু’ স্কুলের মতো স্কুল হলে কতই না ভালো হতো! ধনী-গরীব সব শিশু সমান সুযোগ, শিক্ষা ও মর্যাদায় বড় হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা, সব শিশুকে শিক্ষার আনন্দের বৃত্তে আনা হোক আমাদের ব্রত।

—————————————————————
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত / ১১ নভেম্বর, ২০১৬

ট্র্র‍‍্য‍্যাম্প হিলারীর জয় পরাজয়

ট্র্র‍‍্য‍্যাম্প হিলারীর জয় পরাজয়

আমার ১২ বছরের পুত্র – করোনেট হিলারীর ভক্ত! কষ্টের সাথে সে বলছে.
– বাবা, এটা তো কথা ছিল না ! সব জরিপ আর টিভি সব সময়ই বলছিল – হিলারী, হিলারী, হিলারী, হিলারী….হঠাৎ ট্র্র‍্য‍্যাম্প!? কেন?”

আমি বললাম, একটু চিন্তা কর ! কতক্ষন ভেবে সে বললো
– ট্র্রাম্প সফল ব‍্য‍বসায়ী মানুষ তো, সে ষ্ট‍্য‍াটিজি জানে, অনেক ধযর্র্‍্য‍্য আছে, সম্ভবত ট্র্রাম্পের ধয‍্যর্র্ের ফল! আর জয় নিশ্চিত জেনে হিলারীর ভিতর মনেহয় অহংকার ঢুকেছিল, তাই পতন হয়েছে! বাবা , এই ঘটনার সঙ্গে খরগোশ আর কচ্ছবের গল্পের সাথে কি মিল আছে? …

আমি বললাম, তা মনে হয় না! দু’জনেই অনেক প্র্রচার করেছেন। লক্ষনীয় – হিলারী শিবির মানুষকে আশা-স্বপ্ন দেখানোর চেয়ে, দেশ-সমাজ গঠনে রাজনৈতিক প্র্রতিশ্র্রুতি দেয়ার চেয়ে – ট‍্য‍্যম্পকে মন্দলোক ও ভিলেন বানিয়ে হাসাহাসিতে ব‍্য‍্যস্ত ছিলো। আর ট‍্য‍্যম্প নীরবে তা মেনে মানুষকে ‘গ্র্রেট আমেরিকার স্বপ্ন’ দেখিয়েছেন। আমার মনে হয় সাধারন পাবলিক তোমার হিলারী-ওয়ালাদের ভাব-গতি পছন্দ করেনি! উনার হাসি সুন্দর হলেও – মন্ত্র্রীর থাকার সময় শান্তির পক্ষে কিন্তু তেমন কাজ করেননি! বরং তলে তলে অনেক যুদ্ধ ও অশান্তির ফন্দি করে মানুষ হত‍্য‍্যায় মদদ দিয়েছিলেন! হয়তো মানুষ তা বুঝে ফেলেছে! যদিও মিডিয়া তাকে হিরো বানিয়ে অনেক হৈ হৈ করেছে, আসলে ভিতরের ঘটনায় ছিল ভিন্ন!
আমার ব‍্যাখ‍্য‍্যা শুনে – পুত্র আমার দিক করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাইলে, কতক্ষন!

লেখালেখির কষ্টযাত্রা

লেখালেখির কষ্টযাত্রা

লেখালেখির ইচ্ছা ও অভ‍্যাস আমার স্কুল জীবন থেকেই। কেন এই আবেগটি আমার জীবনে এসেছিল তা আমি জানি না। ছেলে-বেলা থেকেই নিয়মিত পত্রিকা পড়া, বই-ম‍্য‍াগাজিন দেখলে ঘাটাঘাটি করা, কাগজের ফেরিওয়ালা কাছ থেকে সের ধরে পুরাতন বই কিনে পড়া, লাইব্রেরীতে যাওয়া ছিল আমার অভ‍্যাস। হয়তো সেটারই ফল! তরুণ বয়সেই বেশ কয়েকটি উপন‍্যাস ও গল্প লেখা হয়েছিল। এরপর অনেক কবি-সাহিত‍্যিক, প্রকাশক ও পত্রিকায় পিছনে ঘুরেছি – প্রকাশ করার জন‍্য। বন্ধুদের সহয়োগীতায় কিছু কিছু প্রকাশও হয়েছিল। কিন্তু আস্থার পথ পাচ্ছিলাম না – লেখালেখিকে পেশা হিসাবে নেবার ।

১৯৯৫ সারে বিশ্ববিদ‍্যালয়ের পড়া শেষ করা পর – বিজ্ঞানের বাহিরে না-পড়া সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস, উন্নয়ন, মিডিয়া, কমিউনিকেশন ইত‍্যাদি বিষয়ের গভীরে হাত দিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম – অনেক শেখার বাকি, অনেক জানার বাকি। তাই লেখার চেয়ে, বই পড়ার পর নোট নেয়ার অভ‍্যাস হয়ে গিয়েছিল আমার। আজ আমার বুকসেলফ বইয়ের পাশাপাশি নোটবুকের দখলে। ২০১০ সালে আবিস্কার করলাম, গত ১৫ বছর কেন আমি সাহিত‍্য রচনা করিনি? আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়, অথচ ১৫ বলার মত কোন কাজই করা হলো না। হৃদয়ের গহীন শুন‍্যতা বোধ করে ছিলাম! নিজের প্রতি নিজেই অপরাধী হয়ে গেলাম! ১৯৯১ সালে লেখা প্রথম উপন‍্যাস ‘আশার আলো’ প্রকাশ করলাম ২০১২ সালে! প্রকাশকের পিছনে ঘুরে ক্লান্ত না হয়ে, নিজেই যেহেতু ওয়েব সাইট ও ব্লগ বানাতে পারি, ব্লগিংকেই বেছে নিলাম – প্রকাশের বিকল্প পথ হিসাবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমার আমার শত শত পোষ্টিং বিভিন্ন ব্লগে! নিজেও সবগুলোর ঠিকানা জানি না! আমার ব্লগের পোষ্টিংগুলো সাধারন হলেও – আমি সব সময়ই চেষ্টা করি নতুন তথ‍্য, আনন্দ ও প্রেরণা দেবার।

গত সপ্তাহে বিডি নিউজের সহকারী সম্পাদক তন্ময় ইমরান আমার পোষ্টিং পড়ে বললেন – আপনার লেখাগুলো ভালো । প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি বিডিনিউজে লিখেন – পাঠকের গ্রহন করবে। সেই প্রস্তাবের জবাবেই – ‘জাপানে কাঁচা মাছ খাওয়ার স্মৃতি’ লিখলাম । আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে ।

এখন থেকে নিজস্ব ও নতুন ধারায় নিয়মিত লেখালেখি করতে চাই। মনের ভিতর অনেক তথ‍্য, অভিজ্ঞতা, ভাব, আশা ও দর্শন গিজগিজ করেছে। বের করা দরকার – নইলে হৃদয় শান্ত হবে না।

জাপানে কাঁচা মাছ খাওয়ার স্মৃতি

জাপানে কাঁচা মাছ খাওয়ার স্মৃতি

জাপানিরা কাঁচা মাছ খায় ! এ কথা শুনলে যিনি জাপানে আসেননি, নিশ্চিত তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। হয়তো বলবেন, কাঁচা খাওয়াতো আদিম স্বভাব!

জাপানিরা পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জাতিদের মধ্যে একটি। এটা কী করে এই আধুনিক যুগেও তাদের দ্বারা সম্ভব ? সত্যিই তাই, জাপানিরা কাঁচা মাছ খায়। এটা তাদের জনপ্রিয় খাবারের একটি, যার নাম ‘সুসি’ বা ‘সাসিমি’।

২০০৫ সালে আমি যখন প্রথম জাপানে আসি, সেদিন আমিও কাঁচা মাছ খাওয়ার কথা শুনে হতভম্ব হয়েছিলাম। খাবার টেবিলে যখন মাছের ডালা রাখা হলো, আমি বুঝতেই পারছিলাম না এগুলো কাঁচা মাছ। ভিনেগার মাখানো ভাতের সঙ্গে সুন্দর করে কেটে- ফুলের মতো রক্তলাল মাছের টুকরোগুলো সাজানো হয়েছিল। দেখে আমি অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম।

জাপানি বন্ধুরা যখন খাওয়ার অনুরোধ করলো, তখন আমি ইতস্তত করছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, মাছের কাঁটাগুলো হয়তো আমার মুখে বিঁধে যাবে, জিহ্বা ক্ষত-বিক্ষত হবে, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরবে।

কাচুমাচু করে চপস্টিক দিয়ে একটি সুসি মুখে দিতেই আমার ধারণা পাল্টে গেল। কী সুস্বাদু ! কাঁটা নেই, তুলতুলে নরম ! স্বাদে সারা মুখ ভরে গেল। এমন মজার খাবার যেন আমি কখনো খাইনি। ভাবছিলাম এ খাবার আমার অনেক আগেই খাওয়া উচিত ছিল।

উল্লাস নিয়ে এরপর খেতে খেতে জাপানি বন্ধুদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘সুসির’ উপর নানা প্রশ্ন। এটা কি মাছ দিয়ে তৈরি করা হয় ? এটা কি কোনো ভাবে রান্না করা হয় ? কাঁচা হওয়ার পরও কাঁটা নেই কেন ? কতদিন ধরে এই খাবার জাপানিরা খায় ? কেন খায়… ইত্যাদি।

এরপর থেকে আমি যখনই জাপানে আসি, সুসি খেতে ভুলি না ! যখনই জাপানি বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে, কি খাবে ?

আমি চোখ বুজে বলে দেই, সুসি ! মজার কাঁচা মাছ। আমার সুসিপ্রীতি দেখে বন্ধুরা প্রফুল্লের হাসি দেয় আর বলে, “তুমি তো দেখছি জাপানি হয়ে গেলে, শুধু সুসি খেতে চাও।”

সুসি মাছের নাম না ! খাবারের নাম ! মাছের নাম, জায়গার নাম, মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টের ব্রান্ডের নাম অনুসারে সুসির নাম ভিন্ন হয়। যেমন-চিরাসিজুসি, মাকিজুসি, ওরামাকি, ওসিজুসি, মাগুরো, নিরিজুসি ও ওকুরা ইত্যাদি।

হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ স্লাইস করে কেঁটে, ভিনেগার মাখানো গুহানের (ভাত) সঙ্গে মাছ দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা হয় এই সুসি। মাছের প্রকারের উপর এর স্বাদ নির্ভর করে। সুসি বানাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় বিশেষ প্রজাতির ‘স্যামন মাছ’, যা নরওয়ে থেকে আসে। আর সবচেয়ে সুস্বাদু, জনপ্রিয় ও দামি সুসি’র নাম ‘মাগুরো’।

সুসি সাধারণত নওড়ি (সামুদ্রিক হাইড্রিলা শৈবাল সবজির পাতা), সযোসচ, ডাইকন (মুলা) ও ওসাবি (এক ধরনের অতি ঝাঁঝালো আচার) বা আদা-বাটা দিয়ে খাওয়া হয়।

সুসি’র মাছ বিশুদ্ধ পানির মাছ। তাছাড়া প্রজাতিগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত। তাই কাঁচা হলেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না। জাপানের প্রতি শহরেই আমাদের বিরিয়ানীর দোকানের মতো নামকরা সুসির রেস্টুরেন্ট আছে, যা ‘সুসি বার’ নামের পরিচিত।

খাদ্যসহ জাপানের প্রায় সব সংস্কৃতিতেই নিজস্ব ধারা, আধুনিকতা ও স্টাইল আছে। সুসি বারে গেলে জাপানি হরেক রকমের খাবারের সমারোহ দেখে সহজে উচ্চমানের খাদ্য শিল্প বোঝা যায়। কাঁচা মাছের পাশাপাশি সবজির সজ্জা, অর্ধসেদ্ধ মাংস ও ডিম দিয়েও ভিন্ন স্বাদের সুসি তৈরি করা হয়।

সুসি খাবার সাধারণত বাড়িতে বানানো হয় না। কারণ খাবারের চেয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে মাছ কাটাতেই নাকি এর স্বাদ। তাছাড়া বাড়িতে বানানোর চেয়ে রেস্টুরেন্ট বা দোকান থেকে কিনলে খরচ কম হয়।

জেনে ভালো লেগেছিল যে জাপানিরা নাকি খাবার খাওয়ার আগে দেখে। দেখাতেও নাকি স্বাদ আছে। কোনো খাবার দেখতে সুন্দর না হলে জাপানিরা খেয়ে তৃপ্তি পায় না।

সুসি খাওয়ার সময় সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম কাঁচা চিংড়ীর সুসি খেয়ে। যে চিংড়ি আমি বাংলাদেশে খালি হাতে স্পর্শ করলে তিনবার হাত ধুঁই, সেই চিংড়ি জাপানে কাঁচা খেয়ে আনন্দিত হই। সত্যিই‍, পরিবেশ ও সংস্কৃতির অভিযোজন মানুষকে আনন্দের সাথে ভিন্নতাকে নিতে শেখায়।

প্রাচীনকাল থেকেই সহজে প্রাণিজ প্রোটিনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাগরঘেরা জাপানে সুসি জনপ্রিয়। কথিত আছে খৃস্টপূর্ব পাঁচশ’ শতাব্দী পূর্বে চীনে কাঁচা মাছ-মাংস খাওয়ার রীতি চালু হয়েছিল, যা পরে জাপানে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জাপানে এ সংস্কৃতি উত্তরোত্তর আধুনিকতা লাভ করেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘মুরোমাচি যুগ’ থেকে জাপানে সুসি অভিজাত্য লাভ করে। ‘ইদো যুগ’ থেকে তা আধুনিকতা পায়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পায়। পাশ্চাত্যে স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৮৩ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ‘সুসি’ শব্দটি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে।

বর্তমানে জাপানের পাশাপাশি আমেরিকা, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে জাপানি ‘সুসি’ জনপ্রিয় একটি খাবার। বিখ্যাত সব রেস্টুরেন্টে খাদ্য তালিকা বা মেন্যুতে সুসি’র নাম থাকে।

_____________________________________
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত / ২৮ অক্টোবর, ২০১৬