জাগো হে পুরাতন প্রীতি

জাগো হে পুরাতন প্রীতি

‘ফুল নেবে না সুবাস’, ১৯৯৩ সালে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ‍্যালয়ে লেখা আমার একটি গল্পের নাম। অপ্রকাশিত গল্পটি আজ পড়লাম! ক‍্যাম্পাসে রুমান্টিক প্রেম আমার নীবব-অন্তর্মুখী জীবনে আসেনি, করিনি! কিন্তু বন্ধুদের তিরিং-বিরিং এর আদলে খারাপ লিখতাম না!
 
আমি লেখালেখি ছেড়েছি, জিওলজি ছেড়েছি। বিশ্ববিদ‍্যালয় শেষে লেখালেখি একেবারেই করা হয়নি! শুধু পড়েছি, প্রতিষ্ঠা আর খ‍্যাতির পিছনে ঘুরছি। আজ বুঝলাম – আত্নার সঙ্গে সম্পর্কিত কোন কিছুই জিৎ করে, জোর করে ত‍্যাগ করা ঠিক না ।
 
লেখালেখি ও বিজ্ঞান, এই দু’টি বিষয় আমাকে অনেক দিয়েছে। সহজে কঠিন সব বিষয় রপ্ত করার অধ‍্যাবসায়ের অভ‍্যাস পেয়েছি এ দুবিষয়ে লেগে থাকার কারণে। কিন্তু গত ২০ বছর, তা স্বীকার করতে চাইনি। এখন প্রায়শঃ মনে হয় মাল্টিমিডিয়ার পাশাপাশি যদি লেখালেখি ও জিওলজি নিয়ে থাকতাম মন্দ হতো না ।
 
তাই বাড়ী ফেরার চিন্তা করছি। ‘সাইন্স জার্নালিজম, পরিবেশ বিষয়ে আরো বেশী কাজ করতে পারলে ভালো হবে। এবার বাংলাদেশ থেকে ‘লালচে রঙচটা’ পুরাতন পান্ডুলিপিগুলো নিয়ে আসেছি । দেখি কিছু করা যায় কিনা! পুরাতন প্রীতি আবার জাগানো যায় কিনা ।
আমার কুতুবগিরি!

আমার কুতুবগিরি!

২০-২৫ বছর আগে, ছাত্র জীবনে সুন্দরী সহপাঠী ও জুনিয়ারদের দেখলে, প্রেমে পড়ার ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতো! অনেক দূর দিয়ে হাটতাম! লুকিয়ে লুকিয়ে কবি কবি ভাব নিয়ে দেখতাম! ভাবখানা ছিল- নারীসঙ্গ সর্বনাশ! স্বরচিত আমার সেই রম‍্য নাটক, লাজুক ও অন্তমুখী চরিত্রে বন্ধুরা হাসতো! এখন আমি হাসি- অনেক জটিল কুতুব ছিলাম।

দিনের সাথে সাথে, আমার সেই কুতুবগিরি চলে গেছে। দেশ-বিদেশের ভিন্ন কালচারের প্রতি ভালোবাসা, নানান জাতের মানুষ সাথে বন্ধুত্ব আমাকে মানুষ করেছে! হাত-পায়ের কাঁপেনি থামিয়েছে! কিন্তু হৃদয়ের কাঁপনি কি থেমেছে? এবার রিইউনিয়নে জাহাঙ্গীরনগরের ক‍্যম্পাসে অনেক পরিচিতাদের দেখা হলো, কথা হলো, ছবি তুললাম! কিন্তু হাত কাঁপেনি!

“যৌবনে “আমি আপনার প্রেমে পড়েছিলাম।..” কপোট্রনিক প্রেমিকাদের একথা বলতে চেয়েও বললাম না! অনুমতির পর, ভালোবাসা মাখা ছবি তোলা দেখে এই পরিচিতা দু’জন হাসিলো । তাদের রহস‍্যময় হাসিতে, আমার বুকের ভেতর কেমন যেন একটা মোচড় দিয়েছিল!…

জাপানে ট্যাক্স দেওয়া ভারি মজার !

জাপানে ট্যাক্স দেওয়া ভারি মজার !

বিদেশে যাওয়ার পর প্রায় সবারই, বিশেষ করে বাঙালির দেশপ্রেমের মাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে যায়। সবার বেলায় যা হয়, আমার বেলাতেও তাই হয়েছে।

জাপানে আসার পর থেকে দেশ নিয়ে আমার স্বপ্ন ও অভিযোগের শেষ নেই। সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করি ! কেন বাংলাদেশ উন্নত হবে না ! জাপানের চেয়ে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি, জনসম্পদ বেশি, আমরাও তো এদের মতো মানবিক ও কর্মঠ? কী আমাদের সমস্যা! কীভাবে অতিক্রম করা যায়! ইত্যাদি।

জাপান ও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৫০ গুণ তফাৎ দেখে আমি মাথা চুলকাই। নিজের প্রতি নিজে অভিযোগ করে কষ্ট পাই, বাংলাদেশ কী পারবে এই স্কেলে আসতে!

জাপানি ও বাংলাদেশিদের ব্যবসার ধরণ, সেবার মান মাথায় রেখে যখন আয়ের পরিমাণ তুলনা করি, তখন মাথা নত হয়ে যায়। আসলেই এরা অনেকগুণ এগিয়ে।

ধিক্কারে কষ্ট কমে না, পদে পদে মনে হয়- বাংলাদেশের মানুষ, ব্যবসা ও সেবা ঠিকমত বোঝেন না। বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,অথচ অধিকাংশই এটাকে সহজ ও সুন্দর করতে পারেন না। এমনকি করার ইচ্ছাও আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু লাভের অংশ সবাই চায় পুরোটা।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার হলো, যখন আমি সকালে অতি সহজে জাপানি-ট্যাক্স দিয়ে আসলাম ‘সেইভ অন’ নামের একটি বেসরকারি শপে গিয়ে। সিটি অফিস থেকে পোস্টে পাঠানো ফরমে নিজেই নিজের আয়, সহজ অঙ্কে ট্যাক্স হিসাব করে দিয়ে আসলাম।

কেউ ভয় দেখালো না, কোন ঝামেলা নেই। পুরো টাকা সঠিকভাবে সরকারের খাতায় চলে যাবে। সঠিক খাতে, সঠিকভাবে ব্যয় হবে। আমি অবসরে (৬৫ বছর বয়সের বেশি) বিদেশি হওয়ার পরও ইন্সুরেন্স-পেনশনের পাওনা ঠিকভাবে পেয়ে যাব। কোন ঘুষ বা তদবির লাগবে না।

অথচ বাংলাদেশে ট্যাক্স দিতে কতই না ঝামেলা! প্রতিবার যেতে হয় নির্দিষ্ট অফিসে, নির্দিষ্ট অফিসারের কাছে, তাও আবার উকিল বা দালাল-কনসালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে। এই সহজ কাজটি বাংলাদেশে উকিল সাহেবরা কীভাবে গুপ্তভাবে করেন, তা আজও বুঝি না। দেশের আয় ও জনগণের স্বস্তি বাড়ানোর চিন্তায় পুরো প্রক্রিয়াটাই যেন অলস।

আমি বুঝি না ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে অফিসে যেতে হবে কেন? পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বা নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে জাপানের মত সহজে দেওয়া যায় না?

ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়ার পরও কেন বাংলাদেশে ট্যাক্স-পেয়াররা সুবিধা পায় না? শুনেছি বৃদ্ধ বয়সেও নাকি কেউ কিছুই পায় না। প্রত্যক্ষ সেবা না দিয়ে ব্যবসা করার রীতিটা বাংলাদেশের রাখা ঠিক নয়। ‘সেবা ও গ্রহণ’ এই নীতি চালু করতে পারলে আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশে ব্যবসায় সফলতা আসবে।

বাংলাদেশেও আমি ট্যাক্স দেই- উৎস কর। আগে উকিল সাহেবের মাধ্যমে দিতাম। একদিন উকিল মিয়া আমাকে বলে, “স্যার, আপনি এত ট্যাক্স দেন, অফিস থেকে তো সন্দেহ করবে। আপনি বিদেশে থাকেন। হয়তো ভাববে, আপনার অনেক কালো টাকা আছে।”

উকিল সাহেবের কথায় আমার রাগ হয়েছিল। পরে আমার সহকারী বলেছেন,”উকিল সাহেব আপনাকে ভয় দেখিয়ে বাড়তি কিছু আদায়ের চেষ্টা করছিলেন।”

এরপর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে, কর-মেলায় রির্টান জমা দেওয়া শুরু করি। হঠাৎ সত্যিই একদিন এক চাপ-দাড়িওয়ালা অফিসার আমাকে ধরে ফেললো, “এই সাহেব, এত ট্যাক্স দেন কেন? আপনার অনেক টেকা আছে মনে হয়। স্যারেরা তো আপনাকে ধরবো।

এই নেন আমার ভিজিটিং কার্ড, অফিসে আইসেন।চা-নাস্তা খাওয়ার কিছু টাকা দিয়েন, সব ঠিক কইরা দিমুনে। ট্যাক্সের পরিমাণ কমাইয়া দিমুনে।কোন ঝামেলা হইবো না।”

আমি তো শুনে হতবাক ! যিনি আমার কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করবেন,আর উনিই আমাকে বলছেন কমিয়ে দিবেন ! হায়রে সরকারি ব্যবসা, লাভের খাতায় শূন্য।

বাংলাদেশে ১২ বছর কাজ করেছেন, এমন এক জাপানি উন্নয়নকর্মী বন্ধুকে বিষয়টি বললাম।সে বললো, “এখন বুঝেছো জাপান কেন উন্নত? কেন মাথাপিছু ৫০ হাজার আয়, কেন আমরা বিশ্ব ব্যাংক থেকে টাকা নেই না? তোমাদের সরকার তো মানুষের কাজ থেকে টাকা নিতে চায় না।

“আমরা শতভাগ মানুষ ট্যাক্স দেই। পদে পদে উৎসাহ পাই। সহজ সব নিয়ম। মানুষকে সুবিধা না দিলে ব্যবসা ভালো হয় না।”

আমি একটু তর্ক করতে চাইলাম। সে থামিয়ে দিয়ে বললো, “তোমরা যেভাবে চল, তোমাদের দেশের অফিসাররা যেভাবে সেবা দেন, ট্যাক্স নেন, অনিশ্চয়তায় তহবিলে রাখে, সেভাবে চললে জাপান পাঁচ-দশ বছরের মাথায় গরীব হয়ে যাবে। যদি পারো, এ নিয়ে লিখো।”

জাপানি বন্ধুর সেই কথায় এই লেখা লিখলাম। তাকে উৎসর্গ করলাম। একটাই প্রত্যাশা- বাংলাদেশের ভ্যাট-ট্যাক্স প্রক্রিয়া সহজ, সুন্দর ও স্বচ্ছ হোক।

—————————————————————
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত/ ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

জাপানে বাবুর্চি হওয়ার স্বপ্ন

জাপানে বাবুর্চি হওয়ার স্বপ্ন

শরম ও ভয়ের কথা – আমার পুএধন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না। তার জীবনের লক্ষ‍্য দোকানদার হওয়া, পাচক হওয়া! সুন্দর সুন্দর কেক বানাবে, কেক বানানো শেখার জন‍্য ফ্রান্সে পড়তে যাবে । এমন কেক আর খাবার বানাবে, সারা জাপানে নাকি আর কেউ বানাতে পারবে না! রাজবাড়ীতে থেকেও নাকি অর্ডার আসবে।…

আগে ভাবছিলাম সে মজা করেছে। এখন দেখি হাচাহাচা! এই বয়সেই সে রান্না করে, খাবারের বই পড়ে! গত মাসে পড়েছে পৃথিবীর বিখ‍্যাত ১০০০ খাবারের বই! ইয়া বড়, আমি তো দেখে হতবাক! ছেলের ইচ্ছামত মা’ও রাজি! আমার অবস্থা এখন ডাঙ্গায় জ‍্যান্ত পুটি মাছের মত!

আমি বললাম, পাচক কেন হতে চাও। সে বলে – মানুষকে ভালো খাবার খাইয়ে আনন্দ দিতে চাই।

আমি বললাম, তুমি তো গরীব থাকবা। সে বলে,
তুমি তো কিছুই জাননা দেখছি। এটা বাংলাদেশ না জাপান! এখানে ভালো খাবার ওয়ালা বিলিয়নিয়ারও হয়! অনেক সম্মানীও হয়, কেউ ছোট মনে করে না।

পুত্রের আস্থায় আমার টনক নড়লো – সত‍্যিই তো, টনি মিয়ার মত বাবুর্চি  হতে পারলে খারাপ কি? শুনেছি বাংলাদেশে নাকি এক দক্ষ ও ধনী বাবুর্চিকে পাচকগিরি ছাড়তে হয়েছিল বিয়ে করার জন‍্য! কন‍্যাপক্ষের এককথা, ছেলে সব পছন্দ কিন্তু বিয়ে করতে হলে বাবুর্চিগিরি করা যাবে না।

বাংলাদেশে বাবুচর্ির রান্না খাইতে মজা, কিন্তু বিয়া করতে সাজা! কন‍্যাপক্ষ ঘুষখোর, সুদখোর, চোর, বদমাইশের কাছে বিয়ে দিতে রাজী; কিন্তু স‍ৎ, নামী ও দক্ষ বাবুচর্ি’র কাছে বিয়া দিতে রাজী না। সাউথ এশিয়ায় দেশগুলোতে হয়তো একই অবস্থা। কিন্তু জাপানের অবস্থা ভিন্ন। সবাই শিক্ষিত ও ভালো রোজগার করে। সব পেশার মর্যাদা সমান। ছেলে সৎ হয়, বিয়ের সমস‍্যা হয় না।

জাপানি পাবলিক বাথে বিবস্ত্র গোসলের স্মৃতি

জাপানি পাবলিক বাথে বিবস্ত্র গোসলের স্মৃতি

বিনয়ী, লাজুক ও হাস্যোজ্জ্বল জাপানিরাও যে লাজহীন হতে পারে, তা ওদের গোসল সংস্কৃতি না দেখলে বুঝতাম না!

একজন বাঙালির চোখে জাপানিদের গোসল সংস্কৃতির নানা দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম।

পাবলিক বাথে নগ্ন গোসল

২০০৫ সাল। জাপানে আসার আগ থেকেই আমি জাপানিদের গোসল নিয়ে অদ্ভুত সংস্কৃতির কথা জেনেছিলাম। অভিজ্ঞতার জন্য উৎগ্রীব ছিলাম। আমার অতি আগ্রহে ভায়রা ভাই অতানাবে সান, প্রথম সপ্তাহেই নিয়ে গেল ফুকুসিমার ‘পিভন সিটি’র ‘সেন্টু’তে।

ঐহিত্যবাহী পাবলিক গোসলখানা জাপানে ‘সেন্টু’ নামে পরিচিত, যার বাইরের দিকটা দেখতে বেশিরভাগ সময়ই বৌদ্ধদের মঠের মত হয়। তবে ‘পিভন সিটি’র যেটায় আমি গিয়েছিলাম, সেটা তেমন ছিল না। আধুনিক সেন্টগুলো যেমনটা হয়, তেমনটাই! বিশাল শপিং সেন্টারে অত্যাধুনিক সুবিধায় সজ্জিত। কী আধুনিক, কী পুরাতন- বাইরে যাই হোক না কেন, সব সেন্টুর ভেতরের পরিবেশ ও আচার প্রায় একই রকম।

সেন্টুর প্রবেশ ঘরে ঢুকে প্রথমেই কয়েকজনকে নগ্ন দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। লজ্জা পেয়েছিলাম। আমার হাসিও আটকে রাখতে পারছিলাম না।

ভায়রা ভাই অতানাবে সান বলল, “হাসবেন না। এখানে হাসলে মানুষ তোমাকে অভদ্র ভাববে।”

অনেক কষ্টে হাসি চাপলাম। সে আমাকে সব কাপড় খুলতে বলল। ইতোমধ্যে সে সব খুলে ফেলেছে। জলজ্যান্ত একজন বয়স্ক নিকটাত্মীয়কে ন্যাংটো দেখে লজ্জায় যেন আমার জান যায়!

গোসলের জন্য নগ্ন হওয়া স্বাভাবিক, এমন ভাব করে অতানাবে সান দ্রুত পাবলিক বাথে গোসলের নিয়মগুলো জানালেন আমাকে। জলটঙ্গিতে কাপড় পরে ঢোকা নিষেধ, জাম্প দিবে না, গা ধোওয়ার সময় অন্যের গায়ে পানি যেন না যায়, ব্যবহার শেষে পানির কল বন্ধ করে দেবে…!

তিনি বললেন, তোয়ালে ব্যবহার করতে পার। তবে পানিকে অপরিষ্কার করা যাবে না। তোয়ালে রাখতে ঝামেলা হলে, মাথার চান্দিতে রেখ। এতে মাথাও গরম হবে, মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে।

পরামর্শ দেওয়া শেষ হতে না হতেই আমার হাতে একটি ‘সাদা ধবধবে’ ছোট তোয়ালে ধরিয়ে বলল, “কাপড় খুলে বান্দাই বক্সে রাখ। চাবিটা হাতে বেঁধে রাখো, নইলে পরে খুলতে পারবে না।”

হাসি আর হতভম্বতার এক অদ্ভুত অনুভূতির মাঝে কাপড় খুলে সেন্টুতে ঢুকেই দেখলাম, পনের-বিশজনের মত হবে, সবাই উলঙ্গ! ঘর ভর্তি ন্যাংটো মানুষ, সবাই গভীর মনোযোগে গোসল করছে। কেউ কারো বিশেষ অঙ্গের দিকে তাকাচ্ছেন না অবশ্য।

আমি ছাড়া কেউ বিশেষ অঙ্গটি তোয়ালে দিয়েও ঢাকেনি! অতানাবে সান আগে আগে, নিজে করে আমাকে দ্রুত বুঝিয়ে দিচ্ছিল, কীভাবে গোসল করতে হয়।

আমি এখনো সহজ হইনি, তাই কৌশলে আস্তে আস্তে বলল, “লজ্জা পেলে তোমার ‘ওটা’ টাওয়াল দিয়ে একটু ঢেকে নাও। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিয়ো না তুমি নতুন, তুমি লজ্জা পাচ্ছো। জানলে বাকিরাও লজ্জা পাবে।”

নতুন দেশের নতুন সংস্কৃতি, মেনে নিয়ে সাহস বাড়ালাম। গা ধোওয়ার পর, অতানাবেকে অনুসরণ করে জলটঙ্গিতে নামলাম। অনেক গরম পানি, ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস! প্রথমে সহ্য করতে পারিনি। কতোক্ষণ বসার পর গা সয়ে গেল।

অতানাবে বলল, “তুমি তো গরম দেশের মানুষ, গরম পানিতে গোসল কর না! গরম পানিতে গা চুলকায়, কিন্তু চুলকাইও না। মুতু আসলে পানিতে মুতু করে দিও না! এটা সবার পানি, অপরিষ্কার যেন না হয়।”

পানিতে ‘মুতু’র কথা শোনার সঙ্গে সত্যিই আমার প্রস্রাবের বেগ পেল। ভাবলাম, “শালা-আমাকে আন্ডারমাইন করছে না তো ?”

কোমর পানিতে সাঁতরিয়ে সে দেখিয়ে দিল। সঙ্গে আরও দুটি ছোট জলটঙ্গি আছে। একটির পানি ঠাণ্ডা, একেবারেই জিরো ডিগ্রি।

অতানাবে বলল, “খুব গরম লাগলে ওখানে গিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নিয়ো।”

অতি গরমের পর অতি ঠাণ্ডার স্পর্শ নিলাম। যেন আকাশ-পাতাল অনুভূতি! মনে হলো, ‘আমি পূর্ণ থেকে শুন্য’।

পাশের অন্য আরেকটার জলটঙ্গিতে লাল পানি দেখে ভাবলাম ময়লা পানি।

জিজ্ঞাসা করলাম, “ঐটার পানি লাল কেন?”

উত্তর পেলাম, ওটা ‘রেড ওয়াইন ওয়াটার’। ‘ওয়াইন’ বলার সঙ্গে আমার মাথা চক্কর মারলো! পানিতে গরম চান্দি ঠাণ্ডা হয়ে গেলো! দো’টানায় পড়ে গেলাম, ওয়াইনে গা-টা ভিজিয়ে নরকবাসী হমু না তো?

আমার ভাবনা ভেঙ্গে অতানাবে বলল, “ওইখানে সাবান ও শ্যাম্পু আছে, যত পার ব্যবহার করতে পারো। যতোক্ষণ চাও গোসল কর, কেউ কিছু বলবে না। বিল একই, ৫৫০ ইয়েন। তবে তসরুফ করো না।”

৩০-৪০ মিনিট গোসল করে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। জলটঙ্গি থেকে উঠে সাবান-শ্যাম্পু মাখলাম। পাশের একটি রুম দেখিয়ে অতানাবে বললো, “ওটা হিটিং রুম।”

গা ধোওয়ার পর ক্লান্তি ও প্রশান্তিতে গরম পানিতে আর নামতে মন চাচ্ছিলো না। হিটিং রুমে ঢুকেই তো আমি পালাই পালাই! দেখি ‘সীল মাছের মত’ বুড়োরা সারি সারি শুয়ে আছে। শরীর নিশ্চল!

কেউ কেউ আয়েশ করে টিভিতে ঘোড়দৌড় দেখছে। পাশে কয়লার চুল্লির তাপে সবার ঘাম ঝরছে। আমিও একটু শোওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ইতোমধ্যে আমারও ঘাম ঝরতে শুরু করেছে!

আমি যেন আর পারছিলাম না। হিটিংরুম থেকে বের হতেই মনে হলো, আমার দশ কেজি ওজন কমে গেছে। শান্তিতে মন-প্রাণ উড়ছে। কোন দুঃচিন্তা নেই, অভাব নেই, অভিযোগ নেই। আমি যেন এক নবপ্রাণ যুবক!

হেঁটে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেন্টুর আশপাশ দেখলাম। কিন্তু লিঙ্গের উপর টাওয়াল রাখতে আমি ভুলিনি। ‘মাউন্ট ফুজি’র বিশাল ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং সেন্টুর দেয়ালকে দিগন্তের রূপ দিয়েছে।

দেয়ালের গা ঘেঁষে বুদবুদ করে যেদিক থেকে পানি আসছে, সেখানে চকচকে রঙে আঁকা মাছগুলো যেন সাঁতরাচ্ছে।

‘মিরয়ো’ পেইন্টিং আর মাছের দেয়াল এমনভাবে মিশে গেছে যে পানিতে নেমে মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই মনে হল, পুরো সেন্টু যেন একটি বিশাল অ্যাকোয়ারিয়াম! আমি ‘মাউন্ট ফুজি’র ধার দিয়ে বয়ে যাওয়া অনাবিল সাগরতীরে গোসল করছি।

জাপানে সব সেন্টুতেই বাগান থাকে। কাঁচের দেয়াল দিয়ে গোসলের সময় বাগান দেখা যায়। ছোট ছোট পাথর আর গাছ দিয়ে তৈরি। গোসল শেষে হাতে বাঁধা কাঠের অদ্ভুত আদি-চাবি দিয়ে বক্স খুলে কাপড় পরলাম।

বের হওয়ার পথে রাখা বিনামূল্যের ‘গ্রিনট্রি’ খাওয়ার পর মনে হলো, শরীরের ভেতর ও বাইরের সব ময়লা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আজ যেন আমার নতুন জন্ম হলো!

গোসলের অনন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে অতানাবের কাছ থেকে জেনে নিলাম, জাপানি গোসল নিয়ে চমৎকার সব তথ্য।

সে গর্বের সাথে জানাল, পঞ্চম শতাব্দীতে যখন এদেশে বৌদ্ধধর্মের চর্চা শুরু হয়, তখন থেকেই জাপানিরা এভাবে গোসল করে। প্রথম দিকে বুদ্ধিস্ট-মঙ্করা পবিত্র হওয়ার জন্য এভাবে গোসল করত। নারা প্রদেশে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত বৌদ্ধ মঠ টডিজিতে আজও সেন্টু রয়েছে।

১৯০০ সাল পর্যন্ত মেয়ে-ছেলেরা একসঙ্গে গোসল করতো। জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পর পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চিয়ান ধর্মের অনুসারীরা ছেলে-মেয়ের একসঙ্গে নগ্ন হয়ে গোসল করাকে ভালোভাবে নেয়নি।

বলত, “জাপানিরা গোসলে অসভ্য, শরম ছাড়া।”

পাশ্চাত্যের এই সমালোচনায় জাপান সরকার ১৯০০ সালে নারী-পুরুষ একসঙ্গে গোসল বন্ধ করে দেন। নারী-পুরুষ একসঙ্গে গোসলের হাজার বছরের অভ্যাস ভুলতে জাপানিদের ২০ বছর লেগেছিল।

১৯২০ সাল থেকে নারী-পুরুষের গোসলখানা আলাদা হয়ে যায়। এখন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে গোসল করে না। তবে ছোট বাচ্চারা বাবা-মায়ের সঙ্গে গোসল করে।

পূর্বে জাপানের সেন্টুকে মনে করা হত ‘সোশ্যাল ফোরাম’। লোকাল কমিউনিটি’র ‘ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড’।

ইদো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) জাপানি সমাজে সামুরাই, কৃষক, শিল্পী ও ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণি বৈষম্য থাকলেও গোসলখানায় ছিল সবাই এক। স্বর্গের মত। ভেদাভেদ ভুলে সবাই একসঙ্গে গোসল করতো, মিষ্টি খেত, খেলা করতো, মনখোলা কথা বলে গড়ে তুলতো সামাজিক বন্ধন। আদিতে নর-নারী একসঙ্গে সেন্টুতে গোসল করার সময় জীবনসঙ্গী বাছাই করতো। বিয়ের আগে একে অন্যের শরীরটা দেখে নিত, ভাব করতো।

জাপানে প্রতি শহরেই আছে সেন্টু! সারা জাপানে প্রায় এক হাজার আটশ’টি সেন্টু আছে।

আধুনিক বাড়ি ও হোটেলগুলোতে সেন্টু বানানোর কারণে ঐতিহ্যবাহী সেন্টুর সংখ্যা কমছে। মানুষ বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা আগের মত সেন্টুতে যেতে চায় না। প্রাইভেসি রক্ষা করে চলে।

পাশ্চাত্যের প্রভাবের সাথে সাথে খরচ কমানোর জন্যও বাসাতে গোসল করে অনেকে। আরাম ও বিনোদনের সব সুবিধা আছে আধুনিক সেন্টুগুলোতে। বার, ম্যাসেজ চেয়ার, রেস্টুরেন্ট, গেইম, মিউজিক শো, শপিং এমনকি ড্যান্সিং ক্লাব এবং গেস্টরুমও।

বাড়িতে গোসল

২০০৫ সালে প্রথম যেদিন জাপানে আসি, শালিকার সঙ্গে সরাসরি বাসায়!

বাড়িতে আসতেই স্ত্রী বললো, “গোসল করে আসেন। তারপর একসঙ্গে খাবে।”

সে গোসলখানায় নিয়ে বাথটাব দেখিয়ে বলল, “শাওয়ার দিয়ে গা ধোঁওয়ার পর বাথটাবে আয়েশ করেন।”

আমি জানতাম, জাপানি বাথটাবের পানি গরম হয়। কিন্তু এত গরম আমি কখনও কল্পনা করিনি। বসার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো আমি সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

আমি হাউমাউ করে উঠলাম, “আপনারা কী আমাকে সেদ্ধ করার জন্য এত গরম পানি দিয়েছেন নাকি?”

বউ বললো, “এভাবেই তো জাপানিরা গোসল করে।”

জাপানিরা সাধারণত দিনে গোসল করে না। প্রতি রাতে গরম পানিতে গোসল করা জাপানিদের রীতি। সারাদিন পরিশ্রমের পর, গরম পানিতে গোসল করে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রশান্তিলাভকে জাপানিরা খাবারের মতই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

বাড়িতে এভাবে গোসলকে বলা হয়, ‘ওহুরু’। ধনী-গরীব সব বাসাতেই ‘ওহুরু’র জন্য বাথটাব আছে।

ওনসেনে গোসল

জীবন্ত আগ্নেয়গিরির দেশ জাপান। সারা জাপানে ১১০টির মত জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। এসব আগ্নেয়গিরির গা ঘেঁষে রয়েছে হাজারেও বেশি ‘হটস্প্রিং’ মানে উষ্ণ প্রস্রবন। এসব হটস্প্রিংকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত সব ‘ওনসেন’।

প্রতি বছর ১৩ কোটিবার পর্যটকগণ এসব ওনসেনে ঘুরতে যান। বিশাল ব্যবসা ও জনপ্রিয়তা।

এক ছুটিতে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম। নানা-শ্বশুরের বাড়িতে সবাই বেড়াতে যাব। অ্যাডভেঞ্চারের জন্য সিনকানসেন (দ্রুতগতির রেলগাড়ি) বা বাসে গিয়ে নিজের গাড়িতে করে যাব।

পরিকল্পনা ছিল প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাবো এবং পথের কোন এক বিখ্যাত ওনসেনে সবাই গোসল করবো। তাই হলো, পথে কয়েক ঘণ্টার জন্য গাড়ি থামিয়ে গোসল করে নিলাম।

এভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ‘হটস্প্রিং’য়ে গোসল করা অভিজ্ঞতা হয়েছে কয়েকবার।

পৃথিবীতে বসে স্বর্গসুখে গোসলের অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। দেখে অবাক হয়েছিলাম, বিজ্ঞানে উন্নত দেশ, জাপানের সব ওনসেনেই কেমিক্যাল ও কৃত্রিমতা পরিহার করা হয়।

সাবান, শ্যাম্পু, খাবার এমনকি কাগজের প্যাকেটও হয় প্রকৃতিনির্ভর ‘অরগানিক’। এই সংস্কৃতিকে দর্শনার্থীরা সেবার গুণ মনে করে, প্রশংসার চোখে দেখে।

একেক অঞ্চলের হটস্প্রিং-এর পানিতে একেক ধরনের খনিজ থাকে। প্রকৃতি সৌন্দর্যও ভিন্ন, নিজস্ব অনাবিল।

সালফার, আয়ন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ২০ প্রকারের খনিজের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় ওনসেন ও প্রাকৃতিক স্পা সংস্কৃতি, আকর্ষণীয় পযর্টক, হোটেল আর রিসোর্ট।

জাপানিদের বিশ্বাস ‘হটস্প্রিং’র মিনারেল রক্ত সঞ্চালনের জন্য উপকারি। জাপানি এমন মানুষও আছে, শুধু গোসলের জন্য সারাদেশ ঘোরেন।

অভিজ্ঞরা বলেন, জাপানি গোসলের অপর নাম শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি, আত্মিক শুদ্ধতা।

জাপানিরা গোসলে তৃপ্ত হলে বলে, ‘গকুরাকু, গকুরাকু’, যার অর্থ ‘স্বর্গীয়’।

প্রতিটি বাড়িতে ‘আহুরু’ থাকলেও মানুষ প্রতি মাসে অন্তত একবার সেন্টু’তে যান। সৌখিন, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্তরা, সিনিয়র সিটিজেনরা দলবেঁধে ওসসেন ট্যুরে যায় প্রায়ই। গোসলের পেছনে ব্যয় করেন বড় অঙ্কের টাকা ও সময়।

জাপানি ভাষায় ‘সেন্টু’ মানে আশার প্রতীক, আরামের প্রতীক। আরাম হলেও আমার ব্যারাম লাগে। পদে পদে ‘ট্যাকা’। তাও আবার বাংলাদেশের দশগুণ। উন্নতমানের প্রাকৃতিক ‘ওনসেন’-এ শুধু একবার গোসলের জন্য লাগে তিন হাজার থেকে আটত্রিশ শ’ জাপানিজ ইয়েন (২ হাজার থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা)।

জাপানিরা বাড়ির গোসলখানাকে বলে ‘ওহুরু’, পাবলিক বাথকে বলে ‘সেন্টু’ আর প্রকৃতি ‘হটস্প্রিং’র গোসলখানাকে বলে ‘ওনসেন’। কিন্তু সব জায়গাতেই বিবস্ত্র গোসল।

—————————————————————
বিঃদ্রঃ – লেখাটি বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত/ ২৭ নভেম্বর, ২০১৬