জাপানি মন ও বাঙালি পণ!
Migrant Soul

জাপানে থাকতে হলে জাপানিদের মত হয়েই থাকতে হয়, হবে।

আমরা যারা জাপানে থাকি, এমন কেউ নেই যে জাপানিদের আচার ও কালচারে আহত হয়নি। আধুনিক জাপানিরা ইউরোপিয়ান ও এরাবিয়ানদের মত তেরা, অহংকারী ও ক্ষতিকারক না হলেও, মারদাঙ্গা বর্ণবাদি না হলেও, অনেকে জাপানিদেরকে বর্ণবাদী বলেন! ‘নীরব রেসিষ্ট’ আখ‍্যা দিয়ে – অনেকে বহুত অপছন্দ করেন।

বিদেশীদের এমন অভিযোগের মুল কারণটি হলো – জাপানিরা এশিয়ান হলেও বাঙালি মনোভাব, সততা ও কালচারে প্রায় পুরোটাই বিপরীত! গুনগত মানে, সততায়, পরিচ্ছনতা, সচেতনতা ও বিনয়ে জাপানি পুরো জাতিটিকে আমার পারফেকশনিষ্ট মনেহয়। শুদ্ধতায় অনেক সূচিবাই গ্রস্থ মনেহয়। যা অনেক সময় হালকা হালকা ভাবে, ছাড় দিয়ে চলা বাঙালিদের মনে আরামের বদলে বেরাম তৈরী করে। যারা জাপানি ভিন্নতাকে বুঝতে পারেন, মেনে নিতে পারেন, তাদের কাছে জাপান স্বর্গের মতো সুন্দর দেশ! আর যারা মেনে নেন না, তাদের কাছে হাবিয়া দোজখ।

অধিকাংশ সাউথ এশিয়ানরা ‘মেইনষ্ট্রিম জাপানি সমাজে’ মিশতে না পারার কষ্টের মাঝে, জাপানিদের ভুল ধরতে না পেরে পদে পদে জাপানিদের বকাবকি করেন। বিশেষ করে অন‍্যদেশ থেকে আসা সেমেটিক ধর্মের বিশ্বাসীরা, অনুসারীরা ‘বিধর্মী, বেলাহেজ, কাফের’ পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করেন না । এরা সবক্ষেত্র ‘সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে। এই আরো বেশী প্রবল হয়েছে ২০০৮ সালে ফেইসবুকিং এর সহজ প্রচার ও প্রসারের ফলে। সবক্ষেত্রে জাপানিদের খুঁত ধরতে গিয়ে, ভুল না পেয়ে হয়রান হয়ে যায়। নিজেদের অসভ‍্যতাগুলোকে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত’ করে গোপন করে রাখেন। ফলত- জাপানি সুন্দরীদের সঙ্গে প্রেম করতে পারেন না। হাতে গোনা কয়েকজন বিয়ে করলেও, ইমরান শরীফের মত মাঝপথে ‘অতি দোষারুপ’ করে, যাত্রাভঙ্গ করেন! আর মনের দুঃখে একা একা নলা-কচলিয়ে হাত দিয়ে সুসি-বিরানী খান। একাকিত্ব কাটানোর জন‍্য সন্ধ‍্যায় মসজিদ, মন্দির আর গুরুদুয়ারাতে ফাকিস্তানি আদলে মাগনা রুটি-পরোটা, নিহাড়ি-বিরানী খান। এরপরও যাদের ভালোবাসাহীনতা মন থেকে না কাটে, তারা কিছু টাকা পয়সা হলেই বকাবকি করতে করতে দেশে চলে যান! বিয়ের মাধ‍্যমে যাদের এজোকেন (স্থ‍ায়ী ভিসা) হযেছে, তারা জাপানি সুন্দরী বউকে ডিভোর্স দিয়ে, পাকা বয়সে দেশ থেকে আরেকটি কচি বা মুটকি বিয়ে করে এনে, আরেক মহা ঝামেলায় যুক্ত হন। মনে মনে বলেন- ‘যার জ্বালা সেই জানে’।

এরচেয়ে বড় অসভ‍্যতা কি হতে পারে, শুধুমাত্র ভিসার জন‍্য একজন জাপানিকে বিয়ে করে । শরীরিক সম্পর্ক থেকে মেসি জামাই সেজে অভিনয় করে। ভিসা পওয়ার সাথে সাথে নানান প্রকার অত‍্যাচার করে ঘর থেকে বের করে দেয়। কোন বিদেশী যদি কোন বাঙালি সুন্দরিকে এমনটি করে – তবে বাংলাদেশী সমাজ, মানুষ ও আইন তা মেনে নিবে? কিন্তু জাপানি মুক্ত কালচারে বিশ্বাসী বলে, ব‍্যক্তিগত বিষয় বলে মেনে নেয়।

জাপানি সরকারের পক্ষ থেকে অনেক আয়োজনের পারও, বিদেশী ও জাপানিদের অবস্থান বৈপরিত‍্য তেমনটা কমানো যায়নি। কারণটা জন‍্য জাপানি প্রশাসন ও আগত প্রবাসী দুই পক্ষই বেশ বিরক্ত। জাপানিরা বুঝাতে পারে না – জাপানে থাকতে হলে তোমাকে জাপানি হয়েই থাকতে হবে। আর বিদেশীরাও নিজেদের সত্ত্বা, এমনকি টোকিতে লাল গালিচা পার্টিতেও শাড়ি-সালোয়ার কামিজ পড়েন। দেশে নিজেদের সংস্কৃতিতে ‘পদদলিত’ করলেও, বিদেশে নিজস্ব অভ‍্যাস, রীতি-কালচার ত‍্যাগে করতে চান না – কারণ আসলেই রহস‍্যময় ও অজানা। মহাবিপদ জেনেও অধিকাংশ বিদেশী বেসিক পরিবর্তনে আগ্রহী নন। যারা আগ্রহী তাদের সংখ‍্যা খুবই নগণ‍্য!

জাপানে থেকে, জাপানে খেয়ে, জাপানে পড়ে – জাপানী হতে চান না, না বদলানোর দোষে জাপানিদেরকে গাওড়া বলা গালিবাজের সংখ‍্যা প্রবাসে কম নয়। হোষ্ট দেশে থেকে, হোষ্ট দেশকে সম্মান না করার কুকর্মটি অনেকটা হাস‍্যকর! সুবিধা নিবে কিন্তু এপ্রিসিয়েট করবে না, এটি কি ঠিক? বাংলাদেশকে পছন্দ করে না, তার জনগোষ্ঠী ও কালচারকে বকাবকি করে এমন বিদেশীদের কি বাঙালিরা মেনে নিবে? ইউরোপ আমেরিকার সংস্কৃতিকে বাঙালি সাদরে গ্রহন করলেও, জাপানিদেরটা ভালো হবার পরও গ্রহন করতে চায় না, কারণটি অদৃশ‍্য। দৃশ‍্যমান ভিন্নমত থাকার পরও আমাদের তুলনায় জাপানিরা বিদেশীদেরকে উদারভাবেই গ্রহন করে ও করছে। অথচ আমরা যেন তা মানতে ও বুঝতে চাই না।

আমিও পূর্বে জাপানিদের নিয়ে অভিযোগ করতাম; এখন বিষয়টি বুঝি! আসলে জাপানিরা বদলায় না, এটা বলা ভুল। যেটুকু বদলানো দরকার সেটুকুই বলায়। কিন্তু বদলানো প্রক্রিয়াটি খুব ধীর, সুস্থির ও হিসাবের ফরমূলাতে সীমাবন্ধ- যা বিদেশীদের অসহ‍্য লাগে। অনেকে বলে – জাপানিরা আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় বন্দি জাতে, এদের মুক্তি দরকার।
অবজেক্টিভলি চিন্তা করলে বুঝা যায় – আসলে জাপানিদের বদলানো সুযোগ নেই- শুরু থেকে এরা নিজেদেরকে বদলিয়েই এত উন্নত হযেছে। আমরা যেমনটা চাই, তেমন করে বদলালে এদের ইউনিকনেস চলে যাবে। এরা আগের মত হিংস্র, সাম্রাজ‍্যবাদী ও পশ্চিমাদের মত ‘কৌশলি, লোভি, শট ‘ হবে । নষ্ট হয়ে যাবে।

আমরা জানি জাপানিদের জীবন, সংস্কৃতি, আচার-আইন যথাসম্ভব রিক্স-ফ্রি ভাবেই সাজানো! পরিবেশে ভূমিকম্প, সুনামি ও দূর্যোগ কবলতা, জীবনে দারিদ্রতার প্রবলতা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবন্ধতার কারনে – আদিকাল থেকেই জাপানের সবাই নিরাপত্তা সচেতন। যে কোন সময় অপ্রত‍্যাশিত ঘটনা ঘটে যেতে পারে, তাই তারা সব সময় আতঙ্কগ্রস্থ থাকে। তাই ‘সেইফ জোনে’ থাকা জাপানিদের সাধারন পছন্দ। অযথা ঝামেলা যেন জীবনকে কষ্টময় না করতে পারে – তাই তারা কঠোরভাবে আইন মানে, সাবধানে পা ফেলে, একতাবদ্ধ থাকতে পছন্দ করে। যা অন‍্য দেশে, এমনকি উন্নত ইউরোপ আমেরিকাতেও অকল্পনীয়।

লক্ষণীয় ‘বিদ‍্যুৎ ও যোগাযোগে’ এত উন্নত হবার পরও; জাপানের প্রায় সকল বাড়িতে দূর্যোগ মোবাবের প্রস্তুতি হিসাবে কাঠের সংগ্রহশালা থাকে। বছরের পর বছর কাট ব‍্যবহার হয় না, তবুও তারা কাঠ রাখে, বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করে। মূল কারণটা হলো – ভুমিকম্প হলে যাতে, খাদ‍্য, শীত, রান্না ও অন্ধকারের প্রকোপে মরতে না হয়।

‘রিক্স-ফ্রি’ ভাবনা ও সংস্কৃতির কারণে- এরা পশ্চিমাদের মত দিল দরিয়া নয়। ‘স্বর্গের মিথ‍্যা লোভে’, দান-খয়রাত তো পরের কথা – এরা ডিজিট‍্যাল কয়েনও ব‍্যবহার করে না, বুড়োরা নগদ টাকা পছন্দ করে, অযথা আগলা পিরিত করে কাউকে বাড়িতে ঢুকায় না, দাওয়াত দেয় না, অপচয় করে ফুটাঙ্গি দেখায় না! রিক্স-ফি থাকার জন‍্য, রিক্স-ফি রাখার জন‍্য গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে হোটেলে রাখে। ইমিগ্রেশনেও কানাডা-আমেরিকার মত বিদেশীদের দুইহাতে গ্রহন করে না। নেটিভ জাপানিদের মত না হলে নাগরিকত্ব বা পাসপোর্টও দিতে চায় না।

এভাবে খুঁজলে জাপানের প্রতিটি ঘটনা ও আচারের পিছনে- নিরাপত্তা ও নিরাপদে থাকার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। এই মুলকারণটি বুঝে, অবজেক্টিভলি জাপানকে গ্রহন করলে – নিশ্চিত বাঙালির জাপানবাস সুখি ও সুন্দর হয়ে যায়।

কিছুদিন আগে ‘রিও’ নামের এক তরুণ জাপানি বন্ধুর সঙ্গে, ‘বিদেশীদের সম্পর্কে জাপানিদের ধারনা-ভাবনা’ নিয়ে আলাপ করছিলাম। সে বলল – কিছুদিন আগে পরীক্ষামূলকভাবে টোকিওতে একটি কোম্পানী শুধু বিদেশীদের দিয়ে একটি বিভাগ চালু করেছিল! দ্রুত সেই কোম্পানিটি লসে পড়েছিল। বিদেশীদের নিম্নমানের সেবা, হেলাফেলা আচরণ, চুরি ও অযথা এটাসেটার করার কারণে কোম্পানিটি সেই বিভাগটি বন্ধ করে দিতে বাধ‍্য হয়েছিল। তাহলে বুঝ – জাপানিরা কেন বিদেশীদের প্রতি আস্থা রাখতে পারে না।

যতই দিন যাচ্ছে আমি জাপানকে গভীরভাবে বুঝতে পারছি, মেনে নিচ্ছি, আমার জাপানবাস দিনদিন সুখময় হচ্ছে। কি শান্তি ঘরে ঘরে।
লিঙ্কের ভিডিও দেখলে জাপানিদের মাইনসেট সহজে বুঝা যায়।
https://youtu.be/dGIMF0tHDnQ

March 17, 2023