বিমান বন্দরে লাগেজ প্রেম
বিমানবন্দরে ল‍্যাগেজ প্রেম

আমি গুণে মহামতি হলেও – পদে, দাপটে ও অর্থে নিতান্তই দরিদ্রজন। তাই বিমান বন্দরে ভিআইপি গেইট দিয়ে এখনো বিমানে চড়তে পারি নাই, পথটাও জানি না, লবিং-টবিং করে কিভাবে এই জাতে উঠতে হয়, বুঝতে পারি না।

সেই কারণে, বডিং-ইমিগ্রেশন পার হওয়ার জন্র প্রতিবারই বহু নিরক্ষর প্রবাসীর সাক্ষাৎ পাই। অনেকের ইমিগ্রেশনের ফরম পূরণ করে দিতে হয়। ভুল করা প্রথম অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপদ বিদেশযাত্রার জন‍্য এটাসেটা যেচে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হয়।

কেচালটা হয় তখনই, যখন – বিমানে করে ঢাকায় আসা-যাওয়ার সময় কেউ তার ল‍্যাগেজে নিতে অনুরোধ করে।ভারি ভারি উপহারে বস্তাবোজাই করা, ক্লান্ত প্রবাসী যখন তার বাড়তি ব‍্যাগটি আমার নামে এন্টি করার অনুরোধ করে, তখন মায়া লাগে।

কিন্তু আমি বরারই, আবেগ কন্ট্রোলে রাখি। জাপানি সুন্দরি বউয়ের পরামর্শে – এসব ক‍্যাচালে রাজি হই না। এরজন‍্য আবেদনকারী সাধারন যাত্রী হলে তেমন মাইন্ড করে না। তবে অনেকের বুলিং এর শিকার হই । বিশেষ করে চোরাচালানী ধাচের যাত্রীদের, ল‍্যাগেজ পার্টির কর্মীদের – যাদের কমন বুলিং ,

– বাঙালি একটা বেইমানের জাত। বিদেশীরা হেলপ করতে পারে, দেশিভাই, দীনিভাইয়েরা হেল্প করে না। ছোটলোক, বাঙাল কখনো মানুষ হইবো না। ছোট একটা ব‍্যাগ নিতে অসুবিধা কি? কাপড় নষ্ট হয়ে যাবো? নিজের লাগেজ কম, তারপরও রাজি হয়। …

যে যতই বকাবকি, ঝকাঝকি – বুলিং করুক না কেন। নিজের আত্নীয় ছাড়া, ব‍্যাগ খুলে দেখে নেয়া ছাড়া – লাগেজ নিতে রাজি হবেন না।

কারণ – ব‍্যাগটি আপনার নামে এন্ট্রি হবার পর, সেটি আর ঐ ব‍্যক্তির থাকবে না, আপনার হয়ে যাবে। ওখানে কোন মাদক, বা চোরাচালানের সোনাদানা, হিরা-জহরত, সেক্সিটয়, ড্রন, কসমেটিক্স ইত‍্যদি জিনিষ থাকলে, সেটার জন‍্য আপনি ফেঁসে যেতে পারেন । অবৈধ জিনিষ ধরা পড়লে, আপনাকে জেলে যেতে হতে পারে, ঐ ব‍্যক্তিকে নয়।

সুতরাং বিমানের বডিং নেয়ার সময বা বিমান বন্দরে ঘুরাঘুরি সময়- অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আগলা পিরিত পরিতাজ‍্য।

আমি এমন অপরাধীর খপ্পরে বহুবার পড়ে ছিলাম। কেউ ঘুষ চাইলে বা ভয় দেখালে দিবেন না। প্রয়োজনে সিনক্রিয়েট করবেন। এয়ারপোর্ট পুলিশের সহযোগীতা নিবেন। এদের সবচেয়ে বেশী উৎপাত হয় চায়নার গুয়ানজু, সাংহাই, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর আর মধ‍্যপ্রাচ‍্যের রোডগুলোতে। আমি মধ‍্যপ্রাচ‍্যের রোডে যোগাযোগ করি না। তবে মালেশিয়ার আর চায়না রোডের অবস্থা যা ইচ্ছা তাই।

এখন বুঝেছি- প্রতিবারেই বহু অনুরোধের পরও রাজি না হয়ে মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। একবার তো চীনে গোয়ানজু’তে একদল চোরাচালানি আমাকে পারলে মারতে আসে। তারপরও রাজি হয়নি। পরে জেনেছি- এরা লাগেজ পার্টি । চায়না থেকে অবৈধভাবে মোবাইল ও ইলেকট্রনিক্স আনে। অনেকবার বলার পরও যখন আমি রাজি হয়েনি তখন বলে,
– আপনি ঢাকায় যান, দেইখা লমু। বিমান বন্দর পার হইতে দিমু না । সবখানে আমাগো লোক সেট করা আছে।

এই থ্রেটটির পর আমি আসলেই ভয পেয়ে গিয়েছিলাম। রিসিপশন গেইটের কাছে আমার ভাই ও অফিসের লোককে আসতে বলেছিলাম, যাতে কোন বিপদ না হয়।

চোরাচালানিরা বহুত চালাক। যাতে মানুষ সন্দেহ না করে, তাই এদের দলে নায়িকাদের মত জুসি সুন্দরী থাকে। এরা দলে বেঁধে থাকে। একজন ধরা পড়লে, সবাই এক হয়ে রক্ষা করে, উল্টো ফাপড় লয়।

২০০১ সালে এমনি এক মহাবিপদে পরেছিলাম। এটা ছিল দ্বিতীয় বিদেশযাত্রা- সিঙ্গাপুরেে। তখন একটু হাবাগোবা ছিলাম। প্রায়ই আমাকে গছিয়ে দিয়েছিল – বলেছিল ,

– আপনার তো ল‍্যাগেজ কম, নিয়ে যান, আপনার বাসায় থেকে আমার লোক গিয়ে ব‍্যাগটা নিয়ে আসবে। আপনাকে দুই’শ ডলার দিমু। কোন ঝামেলা হবে না।

আমি রাজি হয়নি। সাম্ভব‍্য অনেক মহাবিপদের পথ অতিক্রম করে আলহামুল্লিল্লাহ, বুঝেছি – কত বিপদ থেকেই না রক্ষা করেছেন খামিসামা।

জাপান প্রবাসীদের বলি – জাপানে আসার সময় হয়তো অনেক বলবে এর ভিতর কিছু মশলা আছে। নিয়ে জান। আমার তো ৩০ কেজি পার হয়ে গেছে।

আমার সোজা অনুরোধ- রাজি হবেন না। জিনিষটা খারার মশলা – নাকি পান করা আসল মশলা, মানে ‘হিরোইন টিরইন’, গাঁজা-চরশ তা কি করে বুঝবেন?

কেউ হয়তো বলবে-
– আমার ভাই অসুস্থ মানুষ। এখানে তার বছরের ঔষধ আছে। একটু নিয়ে নেন, একটু উপকার করেন।

অতি আবেগ সৃষ্টি করলেও রাজি হবেন না । ঔষধটা রোগের নাকি, দেওয়ানা হওযার ঔষধ; মানে ইয়াবা-বাবা হবে না, এর নিশ্চয়তা কি?

এখন কোন জুসি সুন্দরীও যদি অনুরোধ করে, সোজা চাষাবুষার মত বলে দেই ,
– এত ল‍্যাগেজ আনছেন কেন? এনেছেন, এখন ভারতি চার্জ-জরিমানা দিয়ে নিজের নামে নিয়ে যান । আমাকে গছাবেন না। আমি আপনার দায়িত্ব নিতে পারবো না, দুঃখিত।

এই বলে কেটি পড়ি। বেশি কথা বললে, আরো দুইটা কথা শুনিয়ে দেই,
– এত অসচেতন হওয়া ঠিক না । একজন মানুষের ২০-৩০ কেজি’র বেশী জিনিষ বিদেশ থেকে আনা-নেয়া করতে হয় না। তাই এয়ারলাইন্স গুলো এই নিয়মজারি করেছে। আপনার বেশী জিনিষ দরকার হলে শীপ-পোষ্টে নেন। এয়ারলাইন্সে নিতে হবে কেন? এত তাড়া কিসের? একটু ধীরে নিলে ক্ষতি কি

যাইহোক; বন্দরে বা বিমান বন্দরের আগলা পিরিত পরিতাজ‍্য।

বিমান বন্ধরে আরেকটি মহাবিপদের কথা বলি। সঙ্গে থাকা ব‍্যাগ-ল‍্যাপটপ, অপরিচিত, এমনকি ট্রেনজিটে একই এয়ারলাইন্স আসা কারো কাছে দিয়ে বা মুভিংকার্টে রেখে কখনো টয়লেট যাবেন না। নিজের জিনিষ নিজের সঙ্গে রাখবেন। এতে লজ্জার কিছু নেই। কফিশপে গেলেও দামি ল‍্যাপটপ আর ব‍্যাগটা ভারী হলেও কাঁধে ঝুলিয়ে রাখবেন। ।

এতে আপনার জিনিষ নিরাপদ থাকবে। কোন কিছু হারানো ভয় থাকবে না। আগলা পিরিত ওযালা যদি আপনার ল‍্যাপটপ, প্রিয় পার্সপোট-টিকেট লয়ে চম্পর্ট দেয়ে, তখন ‘হায় হায়’ করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।

সর্বোপরি, নিরাপদ হোক আপনার বিদেশযাত্র, সেই কামনাই রইলো।

বি.দ্র.: ছবিটি তুলেছিলাম মালেশিয়ার কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট

October 26, 2022