সব সময়ই জাপানিদের প্রশংসা করতে করতে সব বাঙালিদের মত আমিও অনেকটা হয়রান। বাশার স্যারের পোষ্টের সূত্রধরে আজ বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তা করে নিজের মনে লুকিয়ে থাকা অভিজ্ঞতা গুলো খুঁজে পেলাম।
যারা স্বল্পমেয়াদে টুরিজম বা সেমিনার ভিজিটে জাপানে আসেন, তাদের কাছে জাপানকে স্বর্গ মনে হয়। জাপানিদেরকে এঞ্জেল মনে হবে। স্বল্পভাষিতা মানে বিনয়, গাড়ি-বাড়ি-নারীতে পরিপাটিতা, রোবটের মত সময় সচেতনতা দেখলে – এটা ভাবাই স্বাভাবিক।
২০০৫ সালে আমি যখন প্রথম জাপানি আসি, আসার আগে ভাবতাম ‘জাপান হয়তো হবে – ষ্টারটেক বা গেইম ওর্যাল্ডের মত উন্নত। এসে দেখি, মুক্তাগাছার মারুয়ারীপট্টি, আর গ্রামগুলো মুজাটি গ্রামের মতই।
দ্বীর্ঘমেয়াদে জাপানে থাকলে সবারই অন্যরকম, আসল অভিজ্ঞতা হয়। যে বিষয়গুলো প্রথমে দৃষ্টি কাড়ে, কষ্ট দেয়
১) এরা মহাকিপটা । মরে গেলেও এক ইয়েনও দান করে না, কাউকে ধার দেয় না। নির্দয়, হৃদয়হীন। ভিক্ষা-দান তো পরের কথা; মা-বাবাকেও টাকা দিলেও বলে,
– কবে ফেরত দিবা? আত্নকেন্দ্রিক বললে কম বলা হবে, স্বার্থপর বললে বেশী বলা হবে না।
২) জাপানে প্রকাশ্য ছোট ছোট দূর্নীতি নাই, এটা সত্য। তবে বড় বড় কর্পোরেট ঠিকই দাইন মারে, যার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। অফিসিয়াল সহজ কাজেও মহা ঝামেলাময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে । যা অনেক সময় দূনীর্তির চেয়েও জটিল, বেশী কষ্ট দেয়! যার কারণে ইউরোপিয়ান ও আম্রিকানরা ব্যবসা বা চাকুরি করতে চায় না। জুত পায় না।
৩) এরা প্রিয়জনের সামনে কফি খায়, কিন্তু অফার করে না। এমন চরম স্বার্থপর, অভদ্র, মেনে নেয়া কষ্টকর! খরচ হবে বলে, প্রয়োজনের বাহিরে আড্ডা দেয় না, অতিব্যস্ততা দেখায়। বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে চায় না। শুনেছি ডেটিং এর সময়ও নাকি বয়ফ্রেন্ড , গার্লফ্রেন্ড যার যার বিল, সে সে দেয়। ( ডেটিং এর অভিজ্ঞতা আমার জাপানে নাই, তাই নিশ্চিত করতে পারলাম না, দুঃখিত! )
৪) প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে, প্রিয় বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডও চিনে না।
৫) মারামারি না করলেও, বর্ণবাদ না থাকলেও, ভিতরে ভিতরে এরা বিদেশীদের ঘৃণা করে, অদক্ষ মনে করে, সম্মানজনক কাজে সুযোগ ও নিয়োগ দিতে চায় না, দেয় না। এদের সরকারী অফিসে কোন ইমিগ্রেন্ড অফিসার আজো পাইনি। এমনকি ইন্টারন্যাশনাল- পাবলিক রিলেশন অফিসেও না। যা ইউরোপ-আম্রিকাতে অকল্পনীয়।
সব যোগ্যতা থাকার পরও, সব পরীক্ষা পর হবার পরও নাগরিকত্ব তো পরের কথা এজোক্যান ( স্থায়ী ভিসা) দিতে চায় না। অজানা কারণ দেখিয়ে আবেদন বাতিল করে দেয়। যা কানাডা, আম্রিকা সহ পশ্চিমা ও ইউরোপের মানববান্ধব দেশে অকল্পনীয়।
৬) ভাষার ব্যাপারে এরা ইস্পাত কঠিন। ইংরেজী পারলেও বলতে চায় না। ইন্টারন্যাশনাল হতে চায় না। বিদেশী দেখলে এরা ইংরেজী ভুলে যায়। আসল কথা হলো – বন্ধু হতে চায় না। গাইজিন, মানে বিদেশীদেরকে ঝামেলা মনে করে। ঝামেলা মুক্ত জীবন তো সুস্থ জীবন নয়। পুতুল জীবন আর মানুষের জীবনের মাঝে তফাৎটা এখানেই। অনেকাংশ জাপানি এই সহজ বিষয়টা বুঝতে চায় না । হয়তো এই কারণে এরা, নিজের অজান্তেই চরম একাকিত্বে ভুগে, সব পাবার পরও ভালোবাসাহীনতায় থাকে- দূর্বলচিত্তের জাপানিরা হিরিগিরি, আত্নহনন করে।
৭) সারাদিন বুঝানোর পরও বিকাল বেলায় একই কথা বলে । একেবারেই বদলাতে চায় না। নিজেদেরকে সঠিক মনেকরে। তবে ঝগড়া করে না। বড় জিনিষ দেখতে বা বুঝতে পারে না। ভিশন কম। যোগাযোগে খুবই দূর্বল! আমি বলি- জাপানিদের কমিউনিকেশন- শ্লো মিটিমিটি, হাসিহাসি কমিওনিকেশন। যা একেবারেই আরামপ্রদ না । একটা বললে আরেকটা বুঝে। দ্রুত রেসপন্স না করলেও, সময় মত ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। তাই আমি অনেক জাপানিকে মুক্তাগাছার ভাষায় বলি – ‘মিচকা শয়তান!’
৮) আধুনিক জাপানিরা বাড়িতে দাওয়াত দিতে চায় না। কারণটা অজ্ঞাত। সবচেয়ে বিব্রতকর বিষয় – বিদেশী দেখলেই এরা ভাবে, গাইজিন হয় প্রেম করতে বা লুট করতে জাপানে এসেছে। সবাইকে একই পাল্লায় মাপে।
৯) অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, জাপানিদের মত হয়ে গিয়েও, নাগরিকত্ব পাবার পরও, ৩০-৪০ বছর জাপানে থাকলেও বলে- ‘গাইজিন। (বিদেশী)’! বিদেশী দেখলে ভূতের সঙ্গে তুলনা করে বাচ্চাদেরকে মা’য়েরা ভয় দেখায়। বলে- ‘শিজুকানি, গাইজিন আবুনাই’। ( চুপ কর, বিদেশী- মাইর দিব/ বিপদজন বিদেশী )
১০) অধিকাংশ তরুণ-তরুণীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতে চায় না। একেবারে ভিশন নাই। ১২ ক্লাস পার করেও ভাবে লেখাপড়া শেষ। এবার মাস্তি করার পালা, কাজ করার সময়। সুখী না হয়েও, মনেমনে মনকলা খায়। একটুতেই খুশী হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ব্যয়বহুল এই অজুহাতে, অধিকাংশই লেখাপড়া চুকিয়ে, কামলাগিরি আর লিভটুগেদার শুরু করে দেয়! দেখে লাজুক মনে হলেও, অধিকাংশ শহরে জাপানিদের লজ্জাশরম কম, যা মন চায় তাই করে।
পিএইচডি হোল্ডার আর কনষ্ট্রাকশন ওয়ারকার সবাইকে একই কামলা কাতারে এনে, জীবনের জয়গান, সমতার জয়গান গায়। নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রিদের চেয়ে সভ্য প্রমান করতে চায়। উপরে উপরে এটা সুন্দর দেখালেও, ফলটা হয়ে যায় মাকালফল, দরকাচুরা!
১১) লেখাপড়া বেশী না করার কারণে, রাজনৈতিক সচেতন না হওয়ার কারণে- তিক্ষ্ন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না! জ্ঞান-দর্শনের অভাব, এবং সবক্ষেত্রেই নেতৃত্বের অনুপস্থিতি, আম্রিকাপ্রেম লক্ষণীয়।
এ যেন ঠিক বাংলাদেশের উল্টো । বাংলাদেশ সবাই নেতা হতে চায়, আর জাপানে সবাই কামলা/প্রজা হতে চায়। অন্যের বা সমাজের দায়িত্ব নিতে চায় না। ভাবে সমাজ সেবা – সরকারী অফিসারের কাজ। যা অনেকাংশে আপত্তিকর । ফলত সামাজিক জীবন স্থবীর হয়ে যায়। রাস্তাঘাট উন্নত হলেও, প্রকৃত মানবিক উন্নয়ন কম হয়।
১২) একজন মানুষ শিক্ষিত ও ধনী হলে, চকচকে গাড়িতে চড়লে, ব্রেন্ডের কাপড় চোপড় পড়লে, স্বল্পবাসী বিনয়ী ভাব দেখালেই যে ভদ্র ও সভ্য হয় না, তার প্রমান – জাপানের শহরের মানুষ। আর অশিক্ষিত, দরিদ্র ও অসচেতন হলেও যে একজন মানুষ ভদ্র ও সভ্য হয় তার প্রমান, বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ।
১৩) তবে একটা সত্য- চুরি, ডাকাতি ও বাটপারি হয় না। বিদ্যুৎ যায় না। প্রতি বাড়িতে গরমপানি ও ঠান্ডাপানির ব্যবস্থা আছে। আইন খুব কড়া। হাকিম লড়ে তো হুকুম লড়ে না। তাই সৎ বা অসৎ কেউ আইন ভাঙ্গে না। আইনের ভয়ে যারা অতিচালাক, তারা অতি কৌশলে কোন প্রকার প্রমান না রেখে, আসল কাজটি করে ফেলে। ফলে ভুক্তভোগি হায়হায় করলেও, প্রমান না থাকার কারনে টু-শব্দ করতে পারে না।
১৪) আর তেমন বেশী কিচু খারাপ নাই। আমি মনেকরি উপরের বিষয়গুলো জাপানিরা অতিক্রম করতে পারলে, জাতীয়তাবাদিতার বদলে আন্তর্জাতিকবাদ চর্চ্চা শুরু করে, বাহিরে অন্তরে সমান করলে, জাপানির সত্যিকারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হবে। এরা যা চায় তা করতে পরে। লক্ষনীয় বিষয়- গত কয়েক দশক ধরে এদের মাঝে চায়নাফোবিয়া কাজ করছে, আর আম্রিকান লাভুলাভু কাজ করেছে! যা ক্লোডওয়ার সময়ের রেশারেশির চেয়েও ক্ষতিকর, মারাত্নক।
১৫) সংক্ষেপে যদি বলি- দৃষ্টিকটু বিষয় গুলো হলো
– লাভ হোটেল, পিঙ্ক হোটেল, সিঙ্গেল মাদার, সিঙ্গেল ফাদার, পুরুষ পতিতা (আমি পুরুষ বা নারী সব রকমের পতিতাবৃত্তির রিরোধী), কথায় কথায় তালাক আর একদিনের পরিচয়েই ফুলশয়্য খুবই দৃষ্টিকটু বিষয়। ব্যক্তিস্বতন্ত্রনা, আইন ও স্বাধীনতার কারণে এই বিষয়ে কেউ মুখ খোলে না।
১৬) সমাজনীতিতে নিজের বিষয় গুলো সচেতন মানুষের পক্ষে মানা কষ্টকর..
– এরা প্রতিদিন চাইনিজ স্যুপ খায়, চাইনিজ কাঞ্জিতে লিখে, চাইনিজ জিনিষ না হলে বাজারের ব্যাগ ভরে না, তারপরও বলে – চায়না খারাপ।
– মাথার উপর দুইটা বোমা মেরে, প্রায় ৩ লাখ মেরে ফেলেছে, তারপরও বলে আম্রিকা জিন্দাবাদ। আব্বা হুজুর জিন্দাবাদ।
– রাশিয়ার তেলগ্যাস না হলে চলে না, তারপরও বলে ইউক্রেন শ্রেষ্ঠ। জুসি ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি সরব ও পক্ষ নিলেও; ইয়েমেন, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগান ইত্যাদি যুদ্ধে, শুধু জাপান সকার না- পুরো জাতির মুখে কুলুপ ছিল।
– এক অদ্ভদ ব্যবস্থা। নিজের দেশের মানুষকে বেকার ভাতা বা প্রয়োজনীয় ভাতা দেয় না, কিন্তু অন্য দেশে দান করে, অযথা আম্রিকান সৈন্য পালে। ( কারোনার সময় জাপানিরা আড়াই বছরে,মাত্র ১৫ দিনের খরচ সহযোগীতা পেয়েছে। অথচ কানাডা-নিউজিল্যান্ড সহ ইউরোপের গরীব দেশের মানুষেরাও সারা বছর আপদকালীন ভাতা পেয়েছে। এদের সরকার অতীব ধনী, কিন্তু মানুষকে কার্যত অতীব গরীরবানা হালে চলতে বাধ্য করে। )
– এরা পশ্চিমাদের মত হতে চায়, কিন্তু ইংরেজী শিখে না। আন্তজার্তিক হতে চায় না। লেখাপড়া করতে চায় না। আমার মনেহয়- দর্শনশাস্ত্রে হয় এতের আগ্রহ নাই, না হয় বুঝে না, বা বুঝতে দেয়া হয় না। এরাবিয়ানদের মত – ‘প্রশ্ন’ করাকে এরা অপছন্দ করে। অঘোষিত অপরাধ মনেকরে। প্রতিবাদ ও সমালোচনা করলে এরা অল্পতেই কাতর ও পাথর হয়ে যায়।
বি.দ্র; যাইহোক, আমার আসছে ‘জাপান স্মৃতি, বাংলা প্রীতি’ বইয়ে এ বিষয়ে একটি অধ্যায় লিখবো । বিষয়গুলোকে আশাকরি সবাই গঠনমূলক দৃষ্টিতে দেখবেন। কোন কিছু ভুল বললে বা লিখলে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসাবে নিবেন। বেয়াদবি নিবেন না
———
সাদো, জাপান
১২ জুলাই, ২০২২