বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আমার ও আব্বার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর ‘হিটলার মার্কা’ বা ‘চার্লি চ্যাপলিন মার্কা’ মোছ থাকলেও, চরিত্রে হিটলারি বা কৌতুকের ছিটেফোঁটা ছিল না। শান্ত ও সিরিয়াস মানুষ ছিলেন। তাঁর সরলতা ও সততা মুগ্ধতার সাথে দেখিয়ে আব্বা আমাকে বলতেন,
– দেখছ, কত ভালো মানুষ? কত সরল মানুষ? এমন মানুষ হইতে হব। তাহলে জীবন স্বার্থক…
আব্বার কথায়, বিচারপতির সরলতায় অনেকটা আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। নিজের অজান্তেই অতি সরল হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলাম। হৃদয়ে বিশ্বাস লালন করতে শুরু করেছিলাম- সৎ ও সরল মানুষের কষ্ট হলেও, শেষ পর্যন্ত সিনেমার নায়কের মত জয়ী হয় ও হবেই।
২০০১ সাল পর্যন্ত আমার অতি সরল পথে চলার ব্রত গোড়াদের মত বহুত বলবৎ ছিল। এরজন্য আমি অনেকের কাছে প্রিয় সাহাবুদ্দীন আহমদের মত হাসির পাত্রও হয়েছিলাম। যদিও আমার পূর্ণ আস্থা ছিল – আমার সরলতা হাসির বিষয় না।
মহাকালের সরলতার মহাযাত্রায়, কয়েকজন ‘দয়াল বাবা, কলা খাবা’, মাগনা কুতুবের পাল্লায় পড়ে মাইনকাচিপায় ছিলাম। তবে নিজের প্রতি, নিজের সরলতার বিশ্বাস বিশ্বাস হারাতাম না। অতি আস্থার সাথে পথ চলার পর যখন বুঝলাম পেটে ভাত জুটবে না, আরো বেকার থাকতে হবে, মানুষের কাছে হাত পাতার অবস্থা হবে, তখন পথ একটু বদলিয়েছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় পাশের ৫ বছর পরও চাকুরি-বউ-প্রেমিকা কোন কিছু ছুটছে না, তখন একটু হতাশা হযেই, বৈষয়িক ও কৌশলী হতে শুরু করেছিলাম। শেষমেষ খানিকটা সফল হয়েছি। জাপানি বউ-পোলাইপান পেয়েছি। এখন আমি নিজেকে বেশ চালাক মনেকরি, যদিও প্রায় সব মানুষ এখনো আমাকে সরল ও বোকা মনেকরে।
যাইহোক আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সাহাবুদ্দীন আহমদের জীবন থেকে বুঝলাম,
অতি সরলতা ও অতি সততা সব সময় ভালো না। অনেক সময় হীতে বিপরীত হয়। জীবনের মুখোমুখি হয়ে, জয়ী হতে হলে আমাদেরকে কৌশলী হতে হয়। বুদ্ধির চর্চার করতে হয।
আমি এখন মনে করি – চাতুরতা মন্দ হলেও, অন্যের ক্ষতি না করে, কৌশলে নিজের হিস্যা আদায় ও অবস্থান ঠিক রাখা মন্দ না।
মহামতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রয়াণ দিবসে, আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন শোকবার্তা নেই। বিষয়টা আমার দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। অথচ তিনি চরিত্র ও কর্মগুণে তিন-তিনবার দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছিলেন। আজকে তচ্ছতার কারণটা আমাদের সবার জানা। তার অতিসততার কারণে – চতুর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের অনেক ক্ষতি করেছিল।
আমরা সবাই জানি তিনি সৎ ও সরল ছিলেন। কিন্তু এটাও আমরা বুঝেছি, অতি সততা অতি সরলতা মাঝে মাঝে দেশ ও দশের অকল্যান ডেকে আনে। তার অতি সততার সুযোগে সুবিধাবাদীরা একতার বদলে দেশকে বিভাজিত করেছিল, দূনীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছিল।
মহাত্না সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রয়ানে আমি দুঃখিত। তার সততা ও অবদানে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তার ৯২ বছরের জীবনে জাতিকে যা দেবার তার চেয়ে অনেক বেশী দিয়েছেন। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। সরলতার প্রতিককে, ‘প্রিয় স্রষ্টা’ খামিসামা – অবশ্যই অদৃশ্য ভালোবাসার জগতে অপার শান্তি দিবেন, পুরুস্কৃত করবেন।