বিদেশ মানেই অন্য জগত, নতুনকে গ্রহন করার জগত। দেশান্তরি হবার পরে – এই জগতের আচার-কালচার ও সভ্যতার সাথে প্রথম জেনারেশন খুব কমই, নেটিভদের মত মেনে নিতে পারে। নতুনকে গ্রহন ও মেনে নেয়া যে কত কষ্টকর, সে বাস্তবতা প্রবাসীদের চেয়ে কেউ বেশী বুঝে না।
সাধারন সত্য – জাপানকে ভালোবাসে না এমন মানুষ খুব কম আছে। যারা জাপানে আসে তারা জাপানের সততা, পারফেকমন, কাব্যিক প্রকৃতি, গাড়ি-বাড়ি ও কিমোনো পড়া নারীর সব ঠিকঠাক দেখেই আসে। কিন্তু জাপানে আসার পর, প্রায় সবার সাকুরা-মমিজি সুন্দর্যে ভাবনায় কালি পড়ে। বেশী দামে, অতি কামে অধিকাংশ বিদেশীর চেহারা ও ধারণা পাল্টে বদলে যায়। অদৃশ্য এই মহাবিপদ দেশান্তরী হবার পর প্রবাসীরা স্বীকার করতে চায় না। ভাবটা এমন- দেশে থাকতে যে দেশকে অতি ভালোবাসা হয়েছে, তাকে তো ঘৃণা করা যায় না। যে মুখ দিয়ে জাপানের প্রশংসাবচনের ঝর্ণা ঝরছে, তাকে তো গালি দেয়া যায়।
আচার-কালচার, ভাষা ও জীবনযাপনের ১৮০ড্রিগী বৈপরিত্যে বিদেশীরা জাপানে এসে কি করে তা শুনলে অবাক হবেন। প্রবাসীদের অদ্ভুত জাপান স্মৃতি শ্রোতাকে হাসাতে বাধ্য করে।
২০১২ সাল থেকে আমি জাপানে নিয়মিত বাস করছি। আত্ন প্রশংসায় যদি করি তবে বলবো – আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক গুণে গুণান্বিত। শুরুতে জটিলতা থাকলেও – ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে ভালো চাকুরি, ব্যবসা-বানিজ্য করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি, প্রতিদিন অজস্র ছালাম পেয়েছি। কিন্ত স্বপ্নের দেশ জাপানে বেটাগিরি দেখিয়ে ছালাম পাওয়া তো পরের কথা, ছালাম দেয়ার মানুষও খুঁজে পাই না। সবুরের বিষয় – জোতসই চাকুরি না পেলেও, সুন্দরী জাপানি বউ পেয়েছি। বউ ছাড়া কেউ জামাই আদর দেখায় না। মূল কারণ- আধুনিক সভ্য জাপানিরা ব্যক্তিসাতন্ত্রতায় বিশ্বাসী, শতভাগ ঝামেলা মুক্ত থাকার চেষ্টা করে। যাকে বাঙালিরা, ‘স্বার্থপরতা’ বলে ব্যাখা দেয়। এই অভিযোগ আমারও ছিল – কিন্তু গভীর ভাবে চিন্তা করে শেষমেষ জাপানিদের ভুল ধরতে না পেরে মেনে নিয়েছি- দে আর রাইট।
বিদেশীরা জাপানে এসে কি করে? বিদেশীরা সুখে-দুখে জাপানে কেমন থাকে এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতার সারমর্ম –
১. আম্রিকান
জাপানে যত বিদেশী আছে, তাদের মাঝে শত্রুজাতি আম্রিকানরা জাপানিদের কাছে সবচেয়ে সম্মান ও আদর-যত্ন পায়। জাপানি সুন্দরীরা বিদেশী বিয়েতে রাজি না হলেও, আম্রিকান শুনলে সাদা-কালো, ধনী-গরীর বাছবিচার করতে চায় না, রাজি না হলেও অন্তত আধারাজি ভাব দেখায়। অন্য বিদেশীদের চাকুরির অভাব হলেও আম্রিকানদের হয় না। জাপানে পা রাখার সাথে সাথে কোন না কোন স্কুল-কলেজে অন্ততঃ ‘ইংরেজী শিক্ষকতা’র চাকুরিটা পেয়ে যায়।
বিনয়ী-শিক্ষিত আম্রিকানরা শিক্ষকতা প্রেফার করলেও; হাঙ্কিপাঙ্কি হিপ্পি ফুর্তিবাজ আম্রিকানরা বেছে নেয় অঘোষিত ‘প্লেবয়গিরি’। অনেকে শোবিজ ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দেয় ‘জাপানিজ গার্লফ্রেন্ড ওয়ানটেড’। ধারাবাহিক ভাবে গার্লফ্রেন্ড বানায়, টেষ্টের পর টেষ্ট চালায়। জাপানি সুন্দরীরাও ক্ষণিকের প্রেমিক জানার পরও আম্রিকান ডান্ডার জন্য লাইন ধরে। জাপানে আম্রিকান পোলাদের ভাত গরম থাকলেও, আম্রিকান মাইয়ারা তেমন পাত্তা পায় না। তাই অধিকাংশই আমেরিকান সুন্দরী- হয় সঙ্গে করে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আসে, না হয় নিজ দেশের কারো সাথে লিভ-টুগেদার করে। তবে দামী চাকুরি না থাকলে বেশী দিন জাপানে টিকতে পারে না। জিনিষের অতিদাম ও রক্ষণশীল কালচারের ছুতা দেখিয়ে দ্রুত জাপান ত্যাগ করে।
২. ফাকিস্তানি
ফাকিস্তানিরা জাপানে এসেও ফাঁকিবাজি ছাড়ে না। প্রথম যাত্রাতেই এসেই এনিয়ে বেনিয়ে, সুন্দরী-অসুন্দরী, নাকবুচা-দাঁতউঁচা বিচার না করে, একজন জাপানি নারীকে বাগায়। বিয়ে করে। মুসলমান বানায়। কাউকে না পেলে, প্রয়োজনে কোন বুড়ি জাপানিকে টাকার বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট ম্যারিজ করে। উদ্দেশ্য- ভালোবাসা বা সংসার করা হয় নয়, ঝামেলামূক্ত স্থায়ী ভিসা পাওয়া, এজোকেন নেয়া। এজন্য অনেকে নাকি ২০-২৫ লাখ ইয়েন বিনয়োগ করতেও কার্পণ্য করে না। বিবাহসূত্রে ‘এজোক্যান’ মানে স্থায়ী ভিসা হওয়ার সাথে সাথে, অধিকাংশ ফাকিস্তানি -জাপানি বুড়ি-সুন্দরীকে তালাক দিয়ে দেয়। দেশে গিয়ে আরেকটা পর্দাশীল পাক্কা মুসলমান কচি বিয়ে করে আনে। অথবা দেশে পালিয়ে রাখা ‘জুসি হিজাবী বউ’কে জাপানে নিয়ে আসে।
ব্যবসা হিসাবে পুরাতন গাড়ির বেচাকেনা বা নানারুটির ব্যবসা শুরু করা।- ফাকিস্তানিদের কমন কাজ। যাতে রেষ্টুরেন্টে ভালো বিক্রি হয়- সেজন্য, ইন্ডিয়ানদেরকে হিন্দু বলে ঘৃণা করলেও, রেষ্টুরেন্টে নামের আগে হিন্দু টাইটেল লাগায়। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ‘তাজমহল’ বা ‘সম্রাট’ দেয়। হিন্দি ও উর্দূর ভাষা বলায়, উচ্চারণে একই হওয়ার কারণে সহজ-সরল-সৎ জাপানিরা বুঝতে পারে না। একটু কমদামে বড় বড় নান খেতে ‘নামান্তে নামাস্তে’ বলে রেস্টুরেন্টে ঢুকে।
এর মাঝে অবশ্য পড়ায় মসজিদ থাকলে বিশাল অঙ্কের দান করে, মসজিদ কমিটিতে স্থান নেয়ার সবরকমের চেষ্টা করে । আর ‘বুদিষ্ট-সিন্ত’ অধ্যুষিত শহরে মসজিদ না থাকলে, ভাঙ্গাচূরা হলেও একটি মসজিদ বানায়। সোয়াব কামাইয়ের স্বপ্নে বিভোড় থাকে। পদে পদে হারাম-হালাল জাহির করে। সন্ধ্যার পর কোন জাপানির মাগনা দাওয়াত পেলে বারেও যায়, রেডওয়ানও পান করে, মাতাল হয়, তখন অবশ্য হারাম হালাল বাছবিচার করে না।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে; পাকিস্তানি নাম শুনলেই জাপানিরা চোখ বড় করে করে দেয়। ফাকিস্তানি সুপিরিওরিটি কম্পেক্স মাখা গরম ধর্মকথা শান্ত হয়ে শুনে, সায়োনারা দেয়। পুলিশ ও ইমিগ্রেশন ফাকিস্তানি বুঝলে দুইবার কাগজ চেক করে। তবে ফাকিস্তানীরা যে চরম ইমেজ ক্রাইসিসে থাকে- সেটা তারা বুঝতে চায় না, মানতে চাড় না । গাঢ় তেরামি করে নিজের পঙ্কিল পথেই চলে।
ভালোমন্দ সব জাতিরই আছে। জাপানি ফাকিস্তানীদের একটা চরম ভালোদিক আছে, মসজিদ ভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের শান’ দেখানো। একে অন্যকে শুধু পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে না, ব্যবসাতেও সহযোগীতা করা। যা ধরতে গেলে প্রবাসী বাঙালি সমাজে নাই বললেই চলে।
৩. ভারতীয়
আম্রিকানদের পরই জাপানে ভারতীদের কদর বেশী! তবে জাপানি সুন্দরীদের কাছে না – জাপানি আইটি ব্যবসায়িদের কাছে। আম্রিকান পোলাদের মত, ভারতীয়রা প্লেবয়ের সুযোগ পায় না। কারণটা স্বার্থপরতার সাথে যুক্ত। অধিকাংশই ইন্ডিয়ানরা ‘জাপান ও জাপানি’দের আপনজন মনে করে না, সুপার ইগোতে থাকে। ধনী ক্লাইন্ট মনে করে। ভারতীয়দের জাপানের আসার মুল উদ্দেশ্যে- ইয়োগা রেস্টুরেন্ট, প্রোগ্রামিং, মাল কামাই ও আইটি আউট সোসিং ব্যবসা। মুলত এরা এদারকে মাল ওদার বিক্রি করে বাড়তি কামাইয়ের সদাচেষ্টা করে। ভারতীয়দের সততা নিয়ে জাপানিদের সন্ধিহান হলেও, নানান জাতের নান ও পালক-পনিরের কুয়ালিটি নিয়ে জাপানিরা প্রশ্ন করে না। আমিকা ও থাইল্যান্ডের পরেই সবচেয়ে বেশী জাপানি ভারত ভ্রমণ করে ।
৪. বাংলাদেশী
বাংলাদেশীদের অবস্থান অনেকটা ভারতীয় ও নেপালিদের মাঝামাঝি, ফাকিস্তানিদের কাছাকাছি। স্থায়ী ভিসা ‘এজোক্যান’ হওয়ার পর দেশে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে। এ বিচ্ছেদের মূল কারণ – বাঙালির পুরুষতান্ত্রিক মান ও নিজ ধর্মের প্রতি অতিটান। শুনেছি পূর্বে বাংলাদেশী যুবকরা জাপানি সুন্দরীদেরকে কাছে জনপ্রিয় ছিল। নিজেরা কামলাজাত বলে কামলা-দামলা সুন্দরী বিচার করতো না। বাংলাদেশী পারিবারিক মূল্যবোধকে বিশাল গুরুত্ব দিত। হলি আর্টিজান বিভৎস সন্ত্রাসের পর থেকে বাংলাদেশকে আরবদেশের কাছাকাছি গোড়া মনে করে। বউ পিটানো, গৃহদাহ, তালাক ও স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটি রেশারেশি জাপানিরা ভালো চোখে দেখে না। বাংলাদেশীদের সাথে প্রেম-পিরিতি যেন দৃশ্যত এড়িয়ে চলে, তারপরও অনেক প্রেমের বিয়ে ও শর্তযুক্ত কন্ট্রাক্ট ম্যারিজ হয়। তবে লিভ টুগেদার হয় না বললেই চলে। এ’ব্যাপারে জাপানিদের চেয়ে বাঙালি নর-নারীর স্বর্গ হারানোর ভয় কাজ করে ।
আর ব্যবসা হিসাবে গেম্বারের , মানে বাসাবাড়ি নির্মান ও মেরামত করা বাঙালির প্রধান ব্যবসা। বাব্লল ইকোনোমির স্বর্ণযুগে – নির্মান শ্রমিক হিসাবে আসা বাঙালির অবস্থান এখনো সুদৃঢ়। আশির দশকে নাকি বাঙালিদের জন্য জাপানে অনএরাইবাল ভিসা ছিল। এখনকার সিঙ্গাপুর-মালেশিয়ার মতে ঝাঁকে ঝাঁকে নাকি বাঙালি যুবকরা জাপানে আসতো।
অল্প শিক্ষিত কিন্তু ধনী হওয়ার কারণে অধিকাংশ বাঙালি বেশী বেশী বেটাগিরি করে। মিথ্যা ইমেজ সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা করে। কেউ কেউ ডবলষ্ট্যান্ড চালায়- জাপানে কামলাগিরি করে, দেশে গিয়ে বলে ‘গ্রুপ অফ কোম্পানি’র মালিক।
‘মুখে মধু অন্তরে বিষ’ এই মিথ্যা আবেগ প্রবাসীদের মাঝে চরম। আত্নকেন্দ্রিকতা, অঘোষিত স্বার্থপরতা, দেশী ভাইবোনের লেজটেনে ধরা দুই একদিন প্রবাসী পাড়ায় আনাগোনা করলেই স্পস্ট হয়ে যায়। শুনেছি – মানুষ সুবচন পড়ে শিখে, কিন্তু বাঙালি জাপানিদের জীবন সুবচনের বাস্তব উদাহরণ দেখেও শিখতে চায় না। দেশ থেকে যে অনুর্বর মেধা-মগজ, ভাব-গতি নিয়ে আসে, সেটা বদলায় না, বরং কৌশল করে আরো পাকায়।
পণ্য ও সেবার গুণগত মান কম থাকার কারণে, জাপানিদের পছন্দমত নিজের প্রডাক্ট-উৎপাদন না থাকার কারণে, চরম কড়াকড়ি আইনে বাংলাদেশী ষ্টাইলে টাকা রোজগারের ফন্দিফিকিরের জন্য, প্রবাসী ব্যবসায়ীরা জাপানি ব্যবসায়ীদের মতো ধনী-মানি হতে পারে না, সৃজনশীলতা দেখাতে পারে না।
যাদের জাপানি স্থায়ী বউ আছে, দেশে বেটাগিরি দেখাতে গিয়ে অনেক টাকা পাঠায়। ফলে জাপানে অভাবগ্রস্থ থাকে। জামাই হিসাবে নিজে টাকা না দিয়ে, জাপানি বউকে বিশাল ধনী মনেকরে সংসার চালাতে বলে। রাজি না হলে জামাই-বউ মারামারি, ধরাধরি করে। অনেক সময় সংসার ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গামন ও ভাঙ্গা সংসার নিয়ে অনেকে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে লাভ হোটেলে যায়, পিঙ্ক হোটেলে রিপু ঠান্ডা করে। উৎভ্রান্তের মতো ভালোবাসার খোঁজে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়। ভালোবাসা, সুখ-শান্তি পায় না। ধর্ম আসক্তিরা জাপানি সুন্দরী বিধর্মী গালি দেয়। আর উদারপন্থীরা বলে – জাপানিদের মানসিক রোগ আছে, জামাইয়ের মন ও পছন্দ বুঝে না। জামাই এক ঘুষি দিলে, বউ তিন লাথি দেয়।
জাপানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার কারণে অধিকাংশ বাংলাদেশী জাপানের সুশীল সমাজের সাথে মিশতে পারে না। সততা, ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতার কারনে মেইনস্ট্রিমে অবদান রাখতে পারে না। ফলত আপনা-আপনি আলাদা হয়ে যায়।
সেপারেশনের এই ইমেজ ক্রাইসিসে জার্নালিজমে লেখাপড়া না করা, কমিটমেন্টহীন সবজান্তা সাংঘাতিক সাংঘাতিক ‘সাংবাদিক’ রয়েছে সারা জাপানে, বিশেষ করে টোকিও অঞ্চলে। যারা সংবাদের চাইতে বেশী প্রপাগান্ডা প্রকাশে ওস্তাদ। হলুদ সাংবাদিকতা ও সংবাদের নামে অন্যকে ছোট করা, ঘাপটি মেরে দলীয় রাজনীতির প্রচার করা যাদের মুল কাজ।
স্বদেশীদের মাঝেই এটাসেটা করে বড়ত্ব দেখায়। একাকিত্তে ভোগে। কন্ট্রাক্ট ছাড়া কাজ করে । ধার বা পাওনা নিয়ে ঘুরায়, ছেচড়ামি করে। নিজের বেটাগিরি বাজায় রাখার জন্য আসলে না, মুখে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের গল্প বলে। নিজেকে বিরাট গুরুত্বপুর্ণ দাবী করে। ওস্তাদি ফলানো জন্য নিজের এলাকার নামে সমিতি থাকার পরও, আবার সমিতি বানায়। স্বঘোষিত সভাপতি হয়।
আওয়ামী, বিএনপি ও জামাত ইত্যাদি দলের দলীয় অলাভজনক কোন্দল সৃষ্টি করে। নিজেই নিজেকে নেতা ঘোষনা করে। গ্রুপিং-লবিং করে নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য- সব রকমের চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাফল হয় শুন্য।
বাঙালির এমন কর্মে- ভিতর থেকে অযথা সময়-শক্তি ও টাকা খরচের পাশাপাশি; জাপানে ধনী-মানি-গুণী হওয়ার অপূর্ব সুযোগ হাতছাড়া করে। ব্যবসা হিসাবে অধিকাংশ বাঙালির ‘হালাল ফুড’, ‘পুরাতন গাড়ি’ ও পুরাতন কম্পিউটার, পুরাতন মোবাইলের ব্যবসা করে। নিজেদের ভাইভাদরদের খিচুরি খাওয়ানের জন্য ক্ষুদ্র রেস্টুরেন্ট বানায়, সাহিত্য-বই লিখে নিজের পান্ডিত্য জাহির করে, অনলাইনে এটা সেটার বিজনিস করার ব্যার্থ চেষ্টা করে। ইদানিং অবশ্য ফেইজবুক ও ইউটিউব কেন্দ্রিক অনলাইন ব্যবসায় প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে জনপ্রিয় হয়েছে। এ’ব্যাপারে জাপান প্রবাসী বাঙালি বঁধূরা বেশ এগিয়ে। কেউ কেউ আব্রু নষ্ট করে, অনলাইনে রুপ দেখিয়ে শাড়ি পড়ে, লাইভ করেও দিনে একটা শাড়ি বিক্রি করতে পারে না।
আর বাঙালি অবিবাহিত নারী জাপানে সাধারনত আসে না। যারা মনবসু স্কলারশিপ নিয়ে আসে, তারা সাধারনত প্রবাসীদের সাথে তেমন মিশে না। বলে – লেবার কালচার। লেখাপড়া শেষ দেশে চলে যায়। কম সচেতন যে সব বাঙালি নারী স্থায়ীভাবে জাপানে থাকে- তারা শো-বিজ, পর্দা ও গয়না জাহিরের সাথে সাথে বিনোদনের এটাসেটা করার চেষ্টা করে। জামাই-বউ নায়ক-নায়িকা সেজে মিউজিক ভিডিও বানায়। ফেইসবুক ও ইউটিউবে তুমুল প্রচারণা চালায়। করোনার কারণে অবশ্য বাঙালি ভাবীদের নানান পদের ভর্তা-পিকনিক আয়োজনে ভাটা পড়েছে।
জাপানে প্রফেশনাল বাঙালি যারা আছেন, তারা সারারনত ঝামেলা ও দালাদলি থেকে মুক্ত থাকার জন্য, নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, মেইস্ট্রিম প্রবাসীদের সাথে লেনদেন ও মেলামেশা করতে চান না।
৫. ইউরোপিয়ান
ইউরোপিয়ানদের মাঝে জাপানে ইটালিয়ানদের সবচেয়ে বেশী কদর। তারা মুলত আসে- পিৎজা রেষ্টুরেন্ট দিতে, পাচক হিসাবে। আর ফ্রেন্সরা আসে দামি ফ্রাশন ও পারফিউমের ব্যবস্যা করতে। ফ্রেন্সরা একটু রয়েসহে চলে, বেশ ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করার চেষ্টা করে। ফ্যাশনের জগৎ হাতে নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু জাপানিদের খুতখুতে স্বাভাবের কারণে তেমন জোত করতে পারে না। জাপনিদের কুয়ালিটি ফ্যান্সের মত হলেও, জাপানিদের ষ্টাইলটা ভিন্ন ও ইউনিক। কিন্তু ইউরোপের চেয়ে কম দাম বিক্রি করতে হয়।
ডাচরা এক সময় জাপানের ঔষধের বাজার দখল করে থাকলেও, জাপান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত হবার পর থেকে ডাচদের অবস্থান নড়বড়ে। আর এরাবিয়ানরা ঢুকতে পারে না, খুব কম আসে, ব্যবসার জন্য আসলেও তারা জুব্বা ও অতিপর্দা পোষাকের কারণে তেমন পাত্তা পায় না।
দুবাইয়ের ‘বূর্জ খালিফা’ হওয়ার পর থেকে ‘টোকিও টাওয়ারে’ এ্যারাবিয়ান টুরিস্ট কম। কথিথ আছে – ‘ইসলামিক মিলিটেন্সির’ উন্থানের পর থেকে আরব দেশ ও ‘বিশেষ মুসলিম’ দেশ থেকে আসা ভ্রমনকারীদের ভিসায় অদৃশ্য কড়াকড়ি ও বাড়তি চেকিং এর সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে।
আইন ও নৈতিকতায় করাকরি থাকার কারণে ধর্মের আদলে ব্যবসায় তেমন জোত জাপানে করা যায় না। এখানে রামদেব, জাকির নায়েক, রাম রহিম সিং, সৎগুরুর মত মহামতির সৃষ্টি হয় না। কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান ও পশ্চিমা অন্যন্য দেশের মানুষ মুলত ক্ষনিক সময়ের জন্য আসে টুরিষ্ট হয়ে, খৃষ্টীয় নানান ডিনোমিননের মিশনারী হয়ে। এ ব্যাপারে মরমন ও জিহোবা ধর্ম প্রচারকরা দীর্ঘ দিন থাকে। তবে জাপানিরা সেমিটিক মতবাদগুলোকে তেমন পাত্তা দেয় না। মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা কালচার নিজেদের মত ফিল্টার করে, ক্রিসমাস ছাড়া নিরানন্দ ধর্মকে আলাদা করে একপাশে রেখেছে।
৬. ফিলিপিনো, ইউক্রেনিয়ান ও রাশিয়ান সুন্দরী
ফিলিপিনোর ইউক্রেন ও রাশিয়রা সুন্দরী নারীদের প্রভাব জাপানে বেশ প্রবল। এর মুলত আসে বিনোদন, শোবিজ, ডিসকো ডেন্স, বারের ষ্টুয়ার্ড ও দেহ ব্যবসা করতে। ইউক্রেন ও রাশিয়ান সুন্দরীরা সারা দুনিয়ার মত জাপানের ক্লাব কালচারকে মজিয়ে রেখেছে, দখল করে আছে। বিনোদন ও যৌন সেবায় রাশিয়ানরা বেশ সুনামি, তবে নিজের আভিজাত্য বজায় রাখে । এ ব্যাপারে ফিলিপিনোদের অবস্থান যা ইচ্ছে তাই। টাকার জন্য ক্লাইন্টের সাথে অযথা টালাটলি ডলাডলিতে দ্বিধা করে না।
শুধু জাপান নয়, সারা পৃথিবীতে ফিলিপিনোরা প্রমান করেছে- তাদের রুপলাবণ্য, রুমান্টিক হাসির ফাঁকে লুকিয়ে থাকে প্রাগৈতিহাসিক লুসিফারের সাপ। টাকার জন্য এরা সব শপে দিতে রাজি। হয়তো এ কারণেই বহু সংখ্যক ফিলিপিনো সুন্দরী জাপানে থাকার পরও, দেখতে অনেক ক্ষেত্রে জাপানিদের চেয়ে সেক্সি হবার পরও, জাপানি বুড়োরাও এদের বিবাহ করতে চায় না। এদের মুল উদ্দেশ্য স্বার্থ হাসিল করা, দেশে টাকা পাঠানো আর ফুসরত পেলে স্বজনপ্রীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করা।
আমি বারে বা পাচিংকো (জুয়ার ঘর, কেসিনো) তে যাই না। বারের মালিক বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি – তার সঙ্গে কাজ করে রাশিয়ানরা সবচেয়ে এলিগেন্ট। চুক্তির বাহির একটুও এদিক-সেদিক করে না। এমনটি বাড়তি বকশিসও নিতে চায় না। কিন্তু ইউরোপ থেকে আগত অন্যান্য দেশের ললনাদের বেলা অকল্পনীয়।
৭. চাইনিজ ও অন্যান্য
চাইনিজরা জাপানে আসে মূলত টুরিষ্ট আদলে ব্যবসা দখল করতে। মার্কেট রিসার্স করতে। সব জিনিসের দাম কম দিয়ে জাপানের পুতুল বাজার থেকে শুরু করে গৃহস্থলীর ১০০ ইয়েন শপের পুরোটাই চীনাদের দখলে। তবে চাইনিজরা অন্য দেশে কুয়ালিটির হেরফের করলেও জাপানে হেলাফেলা করে না। স্থায়ী ও বিশাল বাজার হাত ছাড়া করতে চায় না।
আর অন্যান্য দেশ থেকে আসা বিদেশীদের অবস্থা জাপানে গরপরতা একই রকম। ইদানিং চাইনিজ শ্রমিকদের পাশাপাশি ভিয়তেনামি শ্রমিকদের চাহিদা জাপানে জনপ্রিয় হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মাঝে – নেপালি ও শ্রীলঙ্কানদের জাপানে ভিসার কড়াকরি নেই। এরা বেশ শান্ত স্বভাবের, অপরাধে যুক্ত হয় না । ইমিগ্রেশন এই দুই দেশের মানুষদেরকে বেশ আদরযত্ন করে। নেপালিরা মুলত নির্মানকর্মী ও রেস্টুরেন্ট চাকুরী করে। নিজেরা রেষ্টুরেন্ট দিলেও ‘ইন্ডিয়ান রেক্টুরেন্ট’ বলে, ইন্ডিয়ান খাবার বিক্রি করে। কারণ নইলে জাপানিরা রেস্টুরেন্ট ঢুকে না।
সবোপরি তলে তলে জাপানিরা কালচারে ‘অহিংস ভাবে’ এমন কিছু রেখেছে, যা অদৃশ্য। এই অদৃশ্যতার সাথে বিদেশীরা কলকাঠি নেড়েও নিজেদের ভাগে আনতে পারে না।
নেটিভ ইংলিশ দেশে বিদেশীদের খাওয়া-দাওয়া, হাগা-মুতা, লেখাপড়া-চাকুরি, প্রেম-বিয়েতে তেমন ঝামেলা না হলেও; নন আলফাবেটিক ভাষার দেশ- জাপান, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, আরব, ফাকিস্তান, ফ্রান্স, জার্মান, রাশিয়া ইত্যাদিতে মহা ঝামেলায় পড়ে। আর এই ঝামেলা শুরু হয় – ভাষার জটিলতা, খাওয়া-দাওয়া ভিন্নরীতি থেকে। ভাষা ও খাবার যে সংস্কৃতিকে কত গভীর করে, তা জাপানের মত নন-আলফাবেটিক ভাষার দেশে না গেলে বুঝা যায় না।
ধর্মীয় বর্ণবাদ জাপানিদের পক্ষ থেকে না হলেও, বিদেশীরা বিশেষ করে খৃষ্টান ও মুসলিমরা যত্রতত্র করে। নৈতিকতায় ভুল না ধরতে পারলেও, অনেকে কাফের বলে গালি দেয়। তবে জাপানিরা সরাসরি কনফ্রিক্টে জড়ায় না। কালচারাল প্রেকটিসের মাধ্যমে টিপে টিপে নিজেদের আচার-ব্যবহার, ভাবনা-মতবাদ, ঐতিহ্য-সৃজনশীলতা বিদেশীদের মাঝে ঢুকিয়ে দেয়। কেউ যদি জাপানের ধরনকে মেনে নেয়, তবে তার কোন সমস্যা হয় না । আর কেউ যদি মেনে না নেয়, তবে তাকে শেষমেষ ‘গুডবাই’ দিতে হয়। আবেগ জনিত অনেক ব্যর্থতা ও কষ্ট নিয়ে বিদায় নিতে হয়।
সর্বোপরি – আসলেই জাপানে বিদেশীদের অনেক অপ্রত্যাশিত ঝামেলা পোহাতে হয়। জাপানিদের কালচারাল ইউনিকনেস অনেকটা আরবদের মত। তবে জাপানিদের ঝামেলটা গ্রহন করা যায়, এ্যারাবিয়ানদেরটা গ্রহন করা কষ্টকর। জাপানিরা আর যাইহোক, এরাবিয়ানদের মত বিদেশীদের সরাসরি ঘৃণা করে না, মারামারি, মিসকিন বলে বকাবকি করে না। ‘গাইকোজিন আবুনাই’ বা ‘হেন্ন গাইকোজিন’ বলে বিদায় নেয়।
একথা সত্য জাপানিরা একরোখা, তবে ভালো ও সৎ। আধুনিক জাপানিরা অন্যদেরকে ব্যবহার করে না, ধান্দাবাজি এদেশে কম। নিজেদের কাজ নিজের করে। বাড়িতে খানসামা, আয়া-বুয়া কালচার জাপানে নেই। হয়তো এক কারণে ফিলিপিনো, তামিল, বাংলাদেশী ও ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয় হলেও, জাপানে শূন্যের কোঠায়। যত যোগ্যই হোক না কেন, জাপানির ভাব – বিদেশীরা তাদের মত যোগ্য না, কাজটা সঠিক ভাবে করতে পারবে না। বিদেশীরা না থাকলে জাপানের জীবনযাপনে তেমন ক্ষতি হবে না। জাপানিদের এই মনোভাবটা হয়তো বিচ্ছন্নতার যুগ – ‘সাকুকু যুগ (১৬০৩-১৮৬৮, ২৬৪ বছর ) এর অভ্যাস থেকে এসেছে। আড়াইশো বছরের বেশী সময় জাপানিরা সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও আজ স্বনির্ভর।
যারা জাপানি স্থায়ী বা দীর্ঘদিনের জন্য আসতে চান, তাদের প্রতি আমার পরামর্ম সেই প্রবাদের মতই – ‘When in Rome, do as the Romans do’ যখন তুমি রোমে থাকবে তখন রোমানদের মত থাকো! যখন তুমি জাপানে থাকবে, তখন জাপানি হয়েই থাকবো। কারণ অদৃশ্য ও অহিংস পথে জাপানিরা হাসিমুখে নিজের কাজ নিজেরা করে চলে। কখনো নিজেদের পছন্দের পথ থেকে সড়ে না, সরবে না। সুখের পথটা আসলেই সহজ ও সুন্দর হয়ে যায়, যখন আগত দেশান্তরি বিনাপ্রশ্নে জাপানিদের মত হয়ে যায়।
জাপানে সুন্দর জীবন যাপনের সহজ সূত্র – জাপানে আসার আগেই জাপানি ভাষা ও কালচার শেখা, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়া ও জাপানের এসেই একটি প্রফেশনাল কোর্স বা ডিগ্রি করা। এই তিনটি কাজ যে করবে না – জাপানে তার ভোগাক্তি বাড়ে বিনা কমবে না।
সাদো, জাপান
৩ ডিসম্বর, ২০২১