ছোট বেলা থেকে আমার একটা ভদ্রবাতিক আছে, সব কিছুকে বিজ্ঞান, যুক্তি ও নান্দিকতার সাথে মিলানোর চেষ্ঠা করি। আমি মোটাসোটা লাজুক মানুষ, তাই আমার বুদ্ধিও একটু মোটা – আসল জায়গায় হাত দেই তবে প্রতিবাদী, সংশয়বাদী এক কথায় গোড়া নাস্তিক বা আস্তিকদের মত একরোখা হতে পারি না। একটু নন্দ দুলালের মত হেলেদুলে চলতে ভালোবাসি । ফলত আমার চিন্তা-চেতনা খুনসুটি থাকলেও গাঢ়ে ত্রাস ও রুখতা ভর করতে পারে না।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে বুঝলাম, আমার ম্বভাবটা সনাতনি ও সেকেলে হলেও নিরাপদ। যার সারমর্ম- ধর্ম ও দর্শন ছাড়া যাবে না। কারণ আমি এখনো মনেকরি ‘ধর্ম-কালচার, দর্শন-মিথ’ সত্যের মন, অদৃশ্য রুপ। মন ছাড়া সত্যের দেহ, মানে দৃশ্যমান সত্য- বিজ্ঞান মৃত।
এক কথায় ধর্ম-দর্শন প্রমানহীন সত্যের প্রস্তাবনা, আর বিজ্ঞান হলো সত্যের প্রমানযুক্ত প্রস্তবনা। এ বিষয়ে আমি প্রিয় বিজ্ঞানী আইনষ্টাইনের সাথে একমত,
‘ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান ল্যাংড়া, আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধত্ব’।
বিজ্ঞানীদের ও আমার ধর্মটা অবশ্যই মোল্লাতান্ত্রিক আচারে , বাতাসা-প্রসাদ, পূজো-হরিবল, ওয়াজ-মহফিলে সীমাবদ্ধ নয়। হৃদয় থেকে হৃদয়ে, ভালোবাসায়, প্রকৃতিক নিয়মে সারা মহাজগতে উদ্ভাসিত, আলোকিত।
দর্শন, ধর্ম ও বিজ্ঞান প্রেমিক হওয়ার কারণে আমার দিনের অধিকাংশ সময়ই অজান্তে অলাভজনক চিন্তায় ব্যয় হয়। ক্লাইটের কাজ করার পরে যা সময় পাই, তার পুরোটা ব্যায় হয় ‘টুকিটাকি পড়া ও লেখালেখিতে’, একটু এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে ছবি তোলতে। শিল্প, দর্শন ও উন্নয়ন- আগ্রহের বিষয়ে কোথায় নতুন তথ্যের আঁচ পেলে – জানার জন্য আমি উৎগ্রীব হয়ে যাই।
তুখোড় ব্যবসা সফল সালাফি ‘জাকির নায়েক’কে নিয়ে একটি পোষ্টের সূত্র ধরে জানলাম – ‘আদম ও ইভের’ কাহিনি আক্ষরিক সত্য না, প্রতীকি সত্য। খ্রি. পূ. ২৫০০-৩০০০ সালের দাপট- আক্কাদিয় জাতির লোককথা, নৈতিকমিথ ( Research link: https://bit.ly/3EAs0SF ) থেকে নেয়া। এই মিথের উপর ভিত্তি করেই ইহুদী বাইবেল ( ওল্ড টেষ্টামেন্ট – মানে তাওরাত ও যবুর ) এর প্রথম অধ্যায়- ‘জেনেসিস’ রচিত। যার মুলস্তম্ভ এক ইশ্বরবাদী সকল সেমেটিক ধর্মের।
মিথ মানে লোককথা, রুপকথা। তাইতো আদম ও ইভের মিথের কোন ঐতিহাসিক ও জিওলজিক্যাল প্রমানিক ভিত্তি নেই। থাকা সম্ভবও না।
মিথ, ধর্ম, দর্শন নিয়ে এত ঘটাঘাটি করি তারপরও ১৯৮১ সালে আদম হাওয়া’ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা- ‘THE MYTHICAL RELATIONSHIPS BETWEEN: ADAM AND THE MYTHS OF ANCIENT MESOPOTAMIA’ বহু বছর পর
হাতে পেলাম। তাই একটু রিগ্রেট ফিলিং হয়েছে।
আমি জিওলজি পড়া, ধর্মীয় স্বাধীনতা বিশ্বাসী একজন সর্বধর্মীয় ভক্ত, মানবাধীকার ও মিডিয়া কর্মী। জিওলজিক্যাল টাইমস্কেলে পৃথিবীর ৪.৫ বিলিয়নের বছরের ইতিহাস প্রমানিত। প্রধান প্রজাতির প্রায় সকল জীব ও প্রানের অস্তিত্ব ফসিল ও নানান উপায়ে প্রমানিত হয়েছে। জিওলজি বা আরকিওলজিতে অপ্রমানিত ‘ইডেন গার্ডেন’ নিয়ে প্রশ্ন করে, আমি মাঝে মাঝে ঘেমে যাই। উত্তরের কোন কুলকিনারা পাই না।
– যে আদম ও হাওয়াকে পৃথিবীর প্রায় ৪০০-৫০০ কোটি সেমেটিক বিশ্বাসীরা প্রথম মানব বা মানবী বলে মান্য করে , তারা কি আসলেই ঐতিহাসিক বাস্তব চরিত্র? এ প্রশ্নের উত্তর যদি মিথ্যা হয়, তবে সংখ্যা গরিষ্ঠ সেমেটিকদের বিশ্বাসের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবে। হয়তো এ কারণেই আব্রাহামিকরা বিষয়টা নিয়ে তেমন ঘাটাঘাটি করে না।
প্রমানিত না হলেও – আবেগগত ও সাইকোলিক্যাল দৃষ্টিতে- আমি
বাবা আদম, মা হাওয়া ও ইডেন গার্ডেনের মহানাটককে মানি, পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা আলোচনায় যত্রতত্র ব্যবহার করি। আমাদের পারিবারিক সম্পর্কে ইডেন গার্ডেনের সমরুপ খুঁজে পাই।
সংসারের কর্তাকে আদম, কর্তীকে ইভ, আর ঝামেলা সৃষ্টিকারী তৃতীয় পক্ষকে লুসিফারের ভূমিকাতে বিচার করলে, জটিল অঙ্কটা সরল হয়ে যায়। গন্দম ফলকে যদি ‘প্রিমেরাইটাল বা এক্সটা মেরাইটাল সেক্স’ গন্য করা হয়, তবে তো মানবের পতনের কারণটা বুঝা যায়। তবে গডের পজিশন রুপক ও বাস্তবে একই। কারণ তিনি সর্বব্যাপি, সয়ম্ভু, নিরাকার, পরম ভালোবাসার আধার।
যাইহোক আদি এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত অনেক আলোচনা করা যেতে পারে। আমার ‘বুঝ ও দর্শন’ অন্য আরেকটি প্রবন্ধে তুলে ধরবো।
সর্বোপরি আমার প্রস্তাব – ধর্মীয় সত্যের নামে অনেক মিথ্যা আমাদের জীবন, সংসার ও বিশ্বকে আদি-অজগরের মতে আষ্টেপিষ্টে গ্রাস করে আছে। যা অনেক সময় আমাদেরকে অন্ধ ও বিবেকহীন করে দেয়। তাই কোন কিছু বিশ্বাস ও আচার হিসাবে পালনের আগে আমাদেরকে অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে। প্রমানিক বা অপ্রমানিক যেভাবেই সঠিক মনে হোক না কেন – অন্যের ও নিজের জীবনের জন্য ক্ষতিকর কোন কিছু গ্রহন করা যাবে না। প্রচার ও প্রসার করা ঠিক হবে না। অযথা সম্পদ, শক্তি ও সময় না করাই শ্রেয়।
যেই আদম-হাওয়া আক্কাদিয় জাতি মিথ, তাকে যদি ‘শ্রীলংকার’ আদমশৃঙ্গের শ্রাইনে খুঁজে বেড়াই – সেটা যেমন সঠিক সত্য হবে না, আবার প্রতিকী গল্পকে বাস্তব বলাটাও ঠিক হবে না।
কল্পনাও অনেক সময় বাস্তবের চেয়েও বাস্তব হয়। তাইতো কবিগুরু বলেছেন।
“….নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি-
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ …”
—
Art Credit: Wiki Pedia
Artist: Peter Paul Rubens, Jan Brueghel the Elder
Year: c. 1615