অতিব্যস্ত ও তুখোড় পেশাজীবি শাহরুখ খানের জীবন থেকে শিক্ষা- ‘আর নয় ব্যস্ততা, সুখের জন্য চাই পিতাপুত্রের সুসম্পর্ক!’
২০০০ সালে আমার জাপানি শিক্ষক ‘টেটসুয়া আমানো সান’ বলে ছিলেন, ‘Busyness’ means ‘loss of time, loss of heart’ and ‘loss of opportunities’
এই বিজনিস মানে ব্যবসা নয়, অতি ব্যস্ততা। কথাটি আমার মনে ধরে ছিল। সে থেকেই আমি ব্যস্ততা নিয়ে সর্তক। আমি নিজেকে সব সময় বুঝানোর চেষ্টা করি,
‘সম্পদ-খ্যাতি, আভিজাত্য -জৌলুস’ মানুষের জীবনে প্রকৃত সুখ আনে না। সুখ আসে ‘সুসস্পর্ক, ভালোবাসা, অন্যকে বুঝা-জানা ও মানা থেকে।
অনেক উদাহরণের মাঝে শাহরুখ খানের জীবন থেকে আমরা বুঝতে পারি, জীবনে ব্যস্ততা কি করুণ পরিনতি ডেকে আনে।
ছেলেকে বাবার সঙ্গে কথা বলতে হলেও নাকি, এপায়ন্টমেরন্ট নিতে হতো। এরিয়ান পুলিশ হেফাজতে বলেছে, বাবা তাকে একেবারেই সময় দিত না। ..
বুঝা গেল ছেলেকে সময় দেয়া ছাড়া সবই দিয়েছেন বলিউড বাদশাহ, ‘শাহরুখ খান। সম্পদ ও জিনিসে ভালোবাসার পরশ থাকলেও, হৃদয় যে থাকে না- প্রিয় অভিনেতা হয়তো সে কথাটি ভুলে গিয়েছিলেন। হয়তো এ কারণেই ছেলে আরিয়ান ‘একাকিত্ব ও ভালোবাসাহীন’ হৃদয় নিয়ে উদ্ভ্রন্তের মত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতো। শেষ মেয় সুখ-শান্তিরর আশায় সব পাওয়ার পরও, শিক্ষা পবার পরও পথভ্রষ্ট হয়ে গেল, ড্রাগ এডিকটেট হয়ে গেল।
আমি মনেকরি, সমাজে শাহরুখ খানের অনেক দেয়া ও পাওয়া হয়েছে। এবার উচিত ছিল- পেশার পাশাপাশি ‘পরিবার, সন্তান ও নিজেকে’ আরো বেশী সময় দেয়া, গুরুত্ব দেয়া, রিলাক্স নেয়া। টাকা বা খ্যতির পিছিনে দৌড়ানো কমানো। কারণ- তার যে পরিমান খ্যাতি হয়েছে, টাকা হয়েছে, মনেহয় কয়েক পুরুষ শুয়ে বসে খেতে পারবে। তারপরও তার কেন যেন সবুর, শান্তি-স্বস্থি ছিল না। চোখ-মুখ ছিল চৌকষতায়, ব্যস্ততায় ভরপুর। কিছু একটা না পাওয়ার বেদনা যেন ছিল তার বাস্তব প্রকাশে।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশী টাকা রোজগারের পক্ষে নই। বেশী ব্যস্ত থাকার পক্ষে নই। যদিও রিমোটে কাজ করায়, অনলাইনে অফিস চালানোয় ব্যস্ততা ছাড়তে চায় না। সকাল আটটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রায়শ কাজ করতে হয়। তবে, আমি ব্যস্ততাকে গুরুত্ব দেই না। আমার শরীর ব্যস্ত থাকলেও, হৃদয়কে গ্রাস করতে দেই না।
আমার এই ব্যস্ততা মুক্তির সহজ কৌশল হলো, আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন-সাধনা সম্ভবের ও প্রয়োজনের সীমার মাঝে রাখা।
বাংলাদেশে থাকতে, মাসে ‘প্রথম শ্রেণী কর্মকর্তা’দের বেতনের সমান রোজগার করতে পারলেই আমি মহাখুশী থাকতাম। তাই ২০০২ সালে সংসার শুরুর পর থেকে, ঢাকায় আমার কোন অভাব হয়নি, ব্যস্ততা গ্রাস করেনি।পাক্কা ১০বছর জামাই বউ মিলে নিয়মিত ঘুরাঘুরি করছি , দামি দামি রেষ্টুরেন্টে খেয়েছি। সবুরের কারণে খামিসামা আমাকে কখনো নিরাশ করেনি, যা চেয়েছি তাহাই পেয়েছি।
অতি দামের দেশ জাপানে, বাড়িতে বসে অনলাইনে অফিস চালিয়ে, ফ্রিল্যান্সিং করে প্রথম শ্রেণীর রোজগার ( ৪-৫ হাজার ডলার) করতে পারি না। অভাব থাকলেও গায়ে মাখি না, সমস্যা থাকলেও সমাধান হয়ে যায়। বউকে মাসে ১-২ হাজার ডলার দিয়েই মাফ চাই।
জাপানে আমার টানাটানি থাকলেও ব্যস্ততা নেই। শুধু ব্যস্ততা আছে ফেইসবুকের মাগনা পোষ্টিং আর কমেন্টেস অকথা-কুকথা নিয়ে। এই ব্যস্ততাও কমানোর সকল কৌশল প্রয়োগ করছি। প্রয়োজন ছাড়া নিউজফিড পড়ি না, স্ক্রল করি না, অন্যের টাইম লাইনে গোয়ান্দাগিরি করি না- ভালো ফল পাচ্ছি।
কম রোজগার করি, তাই মাঝে মাঝে বউ রাগ করে । বলে,
– তিনজন ছেলেমেয়ে, ৩-৪ লাখের কম হয় না। আমি বলে দিয়েছি, যা দেই তার চাইতে বেশী দিতে পারুম না। যদি বলেন – টোকিওতে যাবো, টাকা পাবেন, কিন্তু আমাকে পাবেন না।
বউ কাদুকাদু হয়ে বলেছে ,
– ঠিক আছে, আপনার টোকিও তে যাওন লাগবো না। সঙ্গে আছেন , সঙ্গে রাখুন। কম টাকা দিলেও সমস্যা নাই। আমিও তো চাকুরি করি। বাড়িতে বসে আপনি অনেক রোজগার করেন। সবজি ক্ষেতে কাজকাম করে পুষিয়ে দিবেন।
তাই করছি।
টাকা পয়সা না থাকলে আমার খাবাপ লাগে না। কারণ আল্লাহ’র রহমত- আমার কোন লোন নেই। আমার কাছে কেউ টাকা পায় না, আমি বড়-বড়, ধনী-ধনী অনেকের কাছে টাকা পাই। দেয় না। হয়তো আর দিবেও না।
তবে গত মাসে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। পুত্রের নতুন কম্পিউটার দাবী ও আমার না দিতে পারার বেটাগিরি আবেগে।
আমার পুত্র করোনেট এখন ১৬বছর বয়স। এরিয়ানের কাছাকাছি বয়স। ‘বিশ্ববিদ্যালয় যাবে মিউজিজ পড়তে’।
ঢাকায় আমার দুইটা ম্যাক ছিল, একটা পতিত থাকার কারণে- করোনার আগে এনে দিয়েছি। খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার নাকি প্রয়োজন আরো বড় ও শাক্তিশালী। বলে ৩৫ মান দেও < মানে ৩৫০০ ডলার>। আমি বলেছি,
– আমার টাকা তো ঢাকায়। করোনার পর এনে দিব।
– না, অনেক দেরী হয়ে যাবে।এখন দেও!
হঠাৎ শুনি করোনেট লোকাল শপিং মলে পার্টটাইম কাজ নিয়েছে। উদ্দেশ্য কম্পিউটারে টাকা জোগাড়। এত অল্প বয়সে কাজ নিয়েছে শুনে আমি মাইন্ড করেছি। বউ বলে
– কষ্ট নিয়েন না। এটা বাংলাদেশ না, জাপান! সবাই অল্প বয়স থেকেই কাজ করে। কাজের সুযোগ আছে। সমাজিত স্বীকৃতি আছে।
– তার মানে এখনই, ১৮বছর হোক, বা বিশ্ববিদ্যায়ল পাশ করুক।
গতকাল দেখি- হঠাৎ পোষ্টে একটি বিশাল কম্পিউটার বাসায় হাজির। সুন্দরী বউকে বললাম,
– কার?
– করোনেট কিনেছে। নিজের টাকায়। তিন মাসে শোধ করে দিবে।
– তাই নাকি?
– হ, তেরা কথা বলবেন না। এপ্রিসিয়েট করবেন।
– এখন কাজ করলে তো লেখাপড়া ভালো হবে না ।
– আরে না, হবে। জাপানে ক্লাসে এক নম্বর দুই নম্বর নাই। সততা, দক্ষতা ও রোজগার শেখায় জাপানি লেখাপড়ার লক্ষ্য, সেটা হবে।
বউয়ের কথা শুনে একটু আশস্ত হলাম। তবে বাঙালি মন থেকে এখনো পিতার মাতাব্বরি আবেগ ত্যাগ করতে পারেনি।
পরিশেষে সবার প্রতি অনুরোধ রইলো,
– টাকাকড়ি, ধনধৌলত, খ্যাতিসম্মান সবই পরিবার ও নিজের সুখের জন্য। সুখ ও শান্তি নষ্ট করে, অতিব্যস্ত হয়ে, সব পেয়ে সব হারানো কারো ঠিক না। নিজেকে ও সন্তানদের কে প্রয়োজন ও সম্ভবের গন্ডিতে রাখবেন। দেখবেন জীবন ও সংসার সুখ-শান্তিতে ভরে গেছে।
সম্পদ থাকলেও, প্রয়োজনের বাহিরে সন্তানদের টাকা-পয়সাদেয়া ঠিক না। কিন্তু সাউথ এশিয়ান ও উন্নয়নশীল দেশের ধনী মানুষেরা দেয়। উন্নত দেশের মানুষ তেমনটা দেয় না – যেমন ওমাবার মেয়ে রেষ্টুরেন্টে কাজ করে… আমার পুত্র শপিং মলে কাজ করে <যদি আমি তেমন বড় মানুষ না..>
ছেলেমেয়েরা – কোথায়, কখন ও কার সাথে মিশে বিষয়টা বাবা-মা’র নিয়মিত খেয়াল রাখা উচিত। যদি না রাখে তবে তবে হয়তো মাস্তি মাস্তির নামে, ফর্তির নামে – পঁচা বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে মিশে অল্প বয়সেই এটাসেটা করবে! গাজা-চরস, বাবা-ফেন্সিডিল খাবে; যা মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যর জন্য খতিকর। বিনা কারণে হয়তো আপনাদের পকেট খালি করবে, সামাজিক অবস্থানকে অপদস্ত করবে, আইন আদালতে দৌড়াতে বাধ্য করবে।
সবাই আরো সজাগ, সচেতন ও সর্তক থাকবেন।