ইউনূস আমাদের ফাষ্টবয়! - Shahjahan Siraj
ইউনূস আমাদের ফাষ্টবয়!

বিশ্বখ‍্যাত ও বিলিয়নিয়ার না হতে পারার আমার বেদনা ইউনূের সঙ্গে দেখার পর বরফের মত গলে গিয়েছিল!

গত ঈদে মুক্তাগাছার গ্রামে ‘স্বপ্নহীন শিশু’ ফটোষ্টরি নিয়ে কাজ করছিলাম। গ্রামের পথে গভীর মনোযোগে শিশুদের ছবি তোলার সময়- একজন পিছন থেকে আমার কাঁধে টোকা দিয়ে বলে,
– এই মিয়া ক‍্যামন আছো?
আমি বললাম – ভালো!
আমার তাকানোতে চিনতে পারিনি বুঝে তৎক্ষনাৎ বললো,
– চিনতে পারো নাই! আমি ইউনূস, তোমার সঙ্গে স্কুলে পড়তাম!

সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল! খুব ভালো ছাত্র ছিল ইউনূস, সবসময়ই বেশী নম্বর পেত। শিক্ষক জিজ্ঞাগা করার সাথে সাথে সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিত!
ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে ইউনূস আমার ঈর্ষার পাত্র ছিল। ভিতরে ভিতরে প্রতিযোগীতা করতাম! – ইউনূসের চেয়ে ভালো ছাত্র হইতেই হবে। হলামও!

৬ষ্ট-৭ম শ্রেণীতে আমার রোল নন্বর ছিল ১৭! আমি দ্রুত এগিয়ে যাই! এসএসসিতে হয়ে যাই- এক নম্বর! প্রতিযোগীতার ফল আমি পেয়েছি! কিন্তু ইউনূস এগুতো পারলো না! দারিদ্রতা, পিতার অসুস্থতা, জমি নিয়ে চাচার সঙ্গে মামলা – অমর্ত‍্যসেনের ‘ষ্টেট অফ ফাষ্ট বয়’ বিশ্লেষন ইউনূসের জীবনে ব‍্যর্থ হয়েছে!

জিজ্ঞাসা করলাম,
– এখন কি কর?
– ক্ষেতে মুজর দেই! জমিজমা মামলার পিছনে গেছে! নিজের বাড়িটা আছে, মাইনসের ক্ষেতে কাম করি কোন রকমে চইলা যায়!
স্বহাস‍্যে আমরা মার্ক থ্রী ক‍্যামেরার দিকে তাকিয়ে সরল ভাবে বলে,
– তোমার ক‍্যামেরাটা খুব সুন্দর! কত দাম?
আমি দাম বলতে ইতস্ততার করছিলাম! আরেকবার জিজ্ঞাস করাতে বললাম
– চার লাখের মত, কাজের জন‍্য কিনেছি!
– ওরে বাপরে!
হাতের আঙ্গুল দিয়ে হিসাব করে বলে
– আমার ৫-৬ বছরের কামইয়ের চাইতেও বেশী! এত টাকা পাও কই! তুমি তো দেখছি লাখপতি, অনেক ধনী? …
আমি ইতস্ততার করছিলাম জেনে, প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
– কয় ছেলেমেয়ে, কোথায় থাকো?

আম গাছের ছায়ায় বসে দু’ই বন্ধু নানান বিষয়ে আলাপ করছিলাম। আর ভিতরে ভিতরে আমার বিলিয়ননিয়ার না হতে পারার কষ্ট, আকাশচুম্বী স্বপ্ন গুলো গল পড়ছিলো! একটি স্বচ্ছল ও সচেতন পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে আমার পথ চলাতে তেমন সমস‍্যা হয়নি! বিশ্ববিদ‍্যালয় পেরিয়ে আজ আমি কতদূর এসেছি! গ্রাম থেকে মফস্বল, মফস্বল থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে জাপান, দেশ-বিদেশ নাই, গরুর মত কাজের নেশায় থাকি! জীবনের পথ চলায় কত কিছুই না পাইলাম, কত কিছু খাইলাম, কত কিছু দেখলাম, তারপরও মন ভরে না! বাবা-মা একটু ধনী না হলে, আমার স্বপ্নগুলো না থাকলে হয়তো আমিও ইউনূসের মতো শেষের দিকে থেকে যেতাম!

দুইবন্ধুর তুমুল হাস‍্যরসে আলাপের সময়, একটি ছোট মেয়ে আমারদের কাজ আসে! আমাকে দেখে লজ্জা পায়। ইউনূস কাছে টেনে, আদর করে বলে
– আমার একমাত্র মাইয়া, সোনিয়া!
সঠিক বাংলা খুঁজে না পেয়ে বললাম, হাজিমেমাসতে, নাইচ টু মিট ইস!
ইংরেজী-জাপানী শুনে মেয়ের লজ্জা যেন আরের বেড়ে গেল! আস্তে আস্তে বাবাকে বলল,
– মায়ে সেমাই বারছে, খাবার লইগা ডাকতাছে!

ঈদের দিনে দুপুরে, বন্ধুর বাড়িতে কড়া মিষ্টি সেমাই খেলাম! টিউবওয়েলের টাটকা ঠান্ডা পানি ডেকরে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্তিতে আমার বুক ভরে গেল। রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় আপন মনে অশ্রু ঝরালাম!
“এত পাবার পরও কেন আমরা সুখী হই না! কেন বারবার অহংকারে ডুবে যাই? কেন এত কষ্ট দেই, কেন এত কষ্ট পাই?…”

—————–
” আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥…”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বি.দ্র. : যারা না পাবার কষ্টে আছেন, তারা পিছে পড়া বন্ধুরদের সঙ্গে এই ঈদের ছুটিতে সাক্ষাৎ করবেন! আমি নিশ্চিত – আপনার জীবনে শান্তি ও স্বস্তির হাওয়া বইবে!

June 24, 2017