বিদেশে যাওয়ার পর প্রায় সবারই, বিশেষ করে বাঙালির দেশপ্রেমের মাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে যায়। সবার বেলায় যা হয়, আমার বেলাতেও তাই হয়েছে।
জাপানে আসার পর থেকে দেশ নিয়ে আমার স্বপ্ন ও অভিযোগের শেষ নেই। সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করি ! কেন বাংলাদেশ উন্নত হবে না ! জাপানের চেয়ে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি, জনসম্পদ বেশি, আমরাও তো এদের মতো মানবিক ও কর্মঠ? কী আমাদের সমস্যা! কীভাবে অতিক্রম করা যায়! ইত্যাদি।
জাপান ও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৫০ গুণ তফাৎ দেখে আমি মাথা চুলকাই। নিজের প্রতি নিজে অভিযোগ করে কষ্ট পাই, বাংলাদেশ কী পারবে এই স্কেলে আসতে!
জাপানি ও বাংলাদেশিদের ব্যবসার ধরণ, সেবার মান মাথায় রেখে যখন আয়ের পরিমাণ তুলনা করি, তখন মাথা নত হয়ে যায়। আসলেই এরা অনেকগুণ এগিয়ে।
ধিক্কারে কষ্ট কমে না, পদে পদে মনে হয়- বাংলাদেশের মানুষ, ব্যবসা ও সেবা ঠিকমত বোঝেন না। বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,অথচ অধিকাংশই এটাকে সহজ ও সুন্দর করতে পারেন না। এমনকি করার ইচ্ছাও আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু লাভের অংশ সবাই চায় পুরোটা।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার হলো, যখন আমি সকালে অতি সহজে জাপানি-ট্যাক্স দিয়ে আসলাম ‘সেইভ অন’ নামের একটি বেসরকারি শপে গিয়ে। সিটি অফিস থেকে পোস্টে পাঠানো ফরমে নিজেই নিজের আয়, সহজ অঙ্কে ট্যাক্স হিসাব করে দিয়ে আসলাম।
কেউ ভয় দেখালো না, কোন ঝামেলা নেই। পুরো টাকা সঠিকভাবে সরকারের খাতায় চলে যাবে। সঠিক খাতে, সঠিকভাবে ব্যয় হবে। আমি অবসরে (৬৫ বছর বয়সের বেশি) বিদেশি হওয়ার পরও ইন্সুরেন্স-পেনশনের পাওনা ঠিকভাবে পেয়ে যাব। কোন ঘুষ বা তদবির লাগবে না।
অথচ বাংলাদেশে ট্যাক্স দিতে কতই না ঝামেলা! প্রতিবার যেতে হয় নির্দিষ্ট অফিসে, নির্দিষ্ট অফিসারের কাছে, তাও আবার উকিল বা দালাল-কনসালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে। এই সহজ কাজটি বাংলাদেশে উকিল সাহেবরা কীভাবে গুপ্তভাবে করেন, তা আজও বুঝি না। দেশের আয় ও জনগণের স্বস্তি বাড়ানোর চিন্তায় পুরো প্রক্রিয়াটাই যেন অলস।
আমি বুঝি না ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে অফিসে যেতে হবে কেন? পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বা নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে জাপানের মত সহজে দেওয়া যায় না?
ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়ার পরও কেন বাংলাদেশে ট্যাক্স-পেয়াররা সুবিধা পায় না? শুনেছি বৃদ্ধ বয়সেও নাকি কেউ কিছুই পায় না। প্রত্যক্ষ সেবা না দিয়ে ব্যবসা করার রীতিটা বাংলাদেশের রাখা ঠিক নয়। ‘সেবা ও গ্রহণ’ এই নীতি চালু করতে পারলে আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশে ব্যবসায় সফলতা আসবে।
বাংলাদেশেও আমি ট্যাক্স দেই- উৎস কর। আগে উকিল সাহেবের মাধ্যমে দিতাম। একদিন উকিল মিয়া আমাকে বলে, “স্যার, আপনি এত ট্যাক্স দেন, অফিস থেকে তো সন্দেহ করবে। আপনি বিদেশে থাকেন। হয়তো ভাববে, আপনার অনেক কালো টাকা আছে।”
উকিল সাহেবের কথায় আমার রাগ হয়েছিল। পরে আমার সহকারী বলেছেন,”উকিল সাহেব আপনাকে ভয় দেখিয়ে বাড়তি কিছু আদায়ের চেষ্টা করছিলেন।”
এরপর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে, কর-মেলায় রির্টান জমা দেওয়া শুরু করি। হঠাৎ সত্যিই একদিন এক চাপ-দাড়িওয়ালা অফিসার আমাকে ধরে ফেললো, “এই সাহেব, এত ট্যাক্স দেন কেন? আপনার অনেক টেকা আছে মনে হয়। স্যারেরা তো আপনাকে ধরবো।
এই নেন আমার ভিজিটিং কার্ড, অফিসে আইসেন।চা-নাস্তা খাওয়ার কিছু টাকা দিয়েন, সব ঠিক কইরা দিমুনে। ট্যাক্সের পরিমাণ কমাইয়া দিমুনে।কোন ঝামেলা হইবো না।”
আমি তো শুনে হতবাক ! যিনি আমার কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করবেন,আর উনিই আমাকে বলছেন কমিয়ে দিবেন ! হায়রে সরকারি ব্যবসা, লাভের খাতায় শূন্য।
বাংলাদেশে ১২ বছর কাজ করেছেন, এমন এক জাপানি উন্নয়নকর্মী বন্ধুকে বিষয়টি বললাম।সে বললো, “এখন বুঝেছো জাপান কেন উন্নত? কেন মাথাপিছু ৫০ হাজার আয়, কেন আমরা বিশ্ব ব্যাংক থেকে টাকা নেই না? তোমাদের সরকার তো মানুষের কাজ থেকে টাকা নিতে চায় না।
“আমরা শতভাগ মানুষ ট্যাক্স দেই। পদে পদে উৎসাহ পাই। সহজ সব নিয়ম। মানুষকে সুবিধা না দিলে ব্যবসা ভালো হয় না।”
আমি একটু তর্ক করতে চাইলাম। সে থামিয়ে দিয়ে বললো, “তোমরা যেভাবে চল, তোমাদের দেশের অফিসাররা যেভাবে সেবা দেন, ট্যাক্স নেন, অনিশ্চয়তায় তহবিলে রাখে, সেভাবে চললে জাপান পাঁচ-দশ বছরের মাথায় গরীব হয়ে যাবে। যদি পারো, এ নিয়ে লিখো।”
জাপানি বন্ধুর সেই কথায় এই লেখা লিখলাম। তাকে উৎসর্গ করলাম। একটাই প্রত্যাশা- বাংলাদেশের ভ্যাট-ট্যাক্স প্রক্রিয়া সহজ, সুন্দর ও স্বচ্ছ হোক।
—————————————————————
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত/ ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬