জাপানিরা কাঁচা মাছ খায় ! এ কথা শুনলে যিনি জাপানে আসেননি, নিশ্চিত তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। হয়তো বলবেন, কাঁচা খাওয়াতো আদিম স্বভাব!
জাপানিরা পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জাতিদের মধ্যে একটি। এটা কী করে এই আধুনিক যুগেও তাদের দ্বারা সম্ভব ? সত্যিই তাই, জাপানিরা কাঁচা মাছ খায়। এটা তাদের জনপ্রিয় খাবারের একটি, যার নাম ‘সুসি’ বা ‘সাসিমি’।
২০০৫ সালে আমি যখন প্রথম জাপানে আসি, সেদিন আমিও কাঁচা মাছ খাওয়ার কথা শুনে হতভম্ব হয়েছিলাম। খাবার টেবিলে যখন মাছের ডালা রাখা হলো, আমি বুঝতেই পারছিলাম না এগুলো কাঁচা মাছ। ভিনেগার মাখানো ভাতের সঙ্গে সুন্দর করে কেটে- ফুলের মতো রক্তলাল মাছের টুকরোগুলো সাজানো হয়েছিল। দেখে আমি অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম।
জাপানি বন্ধুরা যখন খাওয়ার অনুরোধ করলো, তখন আমি ইতস্তত করছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, মাছের কাঁটাগুলো হয়তো আমার মুখে বিঁধে যাবে, জিহ্বা ক্ষত-বিক্ষত হবে, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরবে।
কাচুমাচু করে চপস্টিক দিয়ে একটি সুসি মুখে দিতেই আমার ধারণা পাল্টে গেল। কী সুস্বাদু ! কাঁটা নেই, তুলতুলে নরম ! স্বাদে সারা মুখ ভরে গেল। এমন মজার খাবার যেন আমি কখনো খাইনি। ভাবছিলাম এ খাবার আমার অনেক আগেই খাওয়া উচিত ছিল।
উল্লাস নিয়ে এরপর খেতে খেতে জাপানি বন্ধুদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘সুসির’ উপর নানা প্রশ্ন। এটা কি মাছ দিয়ে তৈরি করা হয় ? এটা কি কোনো ভাবে রান্না করা হয় ? কাঁচা হওয়ার পরও কাঁটা নেই কেন ? কতদিন ধরে এই খাবার জাপানিরা খায় ? কেন খায়… ইত্যাদি।
এরপর থেকে আমি যখনই জাপানে আসি, সুসি খেতে ভুলি না ! যখনই জাপানি বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে, কি খাবে ?
আমি চোখ বুজে বলে দেই, সুসি ! মজার কাঁচা মাছ। আমার সুসিপ্রীতি দেখে বন্ধুরা প্রফুল্লের হাসি দেয় আর বলে, “তুমি তো দেখছি জাপানি হয়ে গেলে, শুধু সুসি খেতে চাও।”
সুসি মাছের নাম না ! খাবারের নাম ! মাছের নাম, জায়গার নাম, মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টের ব্রান্ডের নাম অনুসারে সুসির নাম ভিন্ন হয়। যেমন-চিরাসিজুসি, মাকিজুসি, ওরামাকি, ওসিজুসি, মাগুরো, নিরিজুসি ও ওকুরা ইত্যাদি।
হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ স্লাইস করে কেঁটে, ভিনেগার মাখানো গুহানের (ভাত) সঙ্গে মাছ দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা হয় এই সুসি। মাছের প্রকারের উপর এর স্বাদ নির্ভর করে। সুসি বানাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় বিশেষ প্রজাতির ‘স্যামন মাছ’, যা নরওয়ে থেকে আসে। আর সবচেয়ে সুস্বাদু, জনপ্রিয় ও দামি সুসি’র নাম ‘মাগুরো’।
সুসি সাধারণত নওড়ি (সামুদ্রিক হাইড্রিলা শৈবাল সবজির পাতা), সযোসচ, ডাইকন (মুলা) ও ওসাবি (এক ধরনের অতি ঝাঁঝালো আচার) বা আদা-বাটা দিয়ে খাওয়া হয়।
সুসি’র মাছ বিশুদ্ধ পানির মাছ। তাছাড়া প্রজাতিগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত। তাই কাঁচা হলেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না। জাপানের প্রতি শহরেই আমাদের বিরিয়ানীর দোকানের মতো নামকরা সুসির রেস্টুরেন্ট আছে, যা ‘সুসি বার’ নামের পরিচিত।
খাদ্যসহ জাপানের প্রায় সব সংস্কৃতিতেই নিজস্ব ধারা, আধুনিকতা ও স্টাইল আছে। সুসি বারে গেলে জাপানি হরেক রকমের খাবারের সমারোহ দেখে সহজে উচ্চমানের খাদ্য শিল্প বোঝা যায়। কাঁচা মাছের পাশাপাশি সবজির সজ্জা, অর্ধসেদ্ধ মাংস ও ডিম দিয়েও ভিন্ন স্বাদের সুসি তৈরি করা হয়।
সুসি খাবার সাধারণত বাড়িতে বানানো হয় না। কারণ খাবারের চেয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে মাছ কাটাতেই নাকি এর স্বাদ। তাছাড়া বাড়িতে বানানোর চেয়ে রেস্টুরেন্ট বা দোকান থেকে কিনলে খরচ কম হয়।
জেনে ভালো লেগেছিল যে জাপানিরা নাকি খাবার খাওয়ার আগে দেখে। দেখাতেও নাকি স্বাদ আছে। কোনো খাবার দেখতে সুন্দর না হলে জাপানিরা খেয়ে তৃপ্তি পায় না।
সুসি খাওয়ার সময় সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম কাঁচা চিংড়ীর সুসি খেয়ে। যে চিংড়ি আমি বাংলাদেশে খালি হাতে স্পর্শ করলে তিনবার হাত ধুঁই, সেই চিংড়ি জাপানে কাঁচা খেয়ে আনন্দিত হই। সত্যিই, পরিবেশ ও সংস্কৃতির অভিযোজন মানুষকে আনন্দের সাথে ভিন্নতাকে নিতে শেখায়।
প্রাচীনকাল থেকেই সহজে প্রাণিজ প্রোটিনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাগরঘেরা জাপানে সুসি জনপ্রিয়। কথিত আছে খৃস্টপূর্ব পাঁচশ’ শতাব্দী পূর্বে চীনে কাঁচা মাছ-মাংস খাওয়ার রীতি চালু হয়েছিল, যা পরে জাপানে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জাপানে এ সংস্কৃতি উত্তরোত্তর আধুনিকতা লাভ করেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘মুরোমাচি যুগ’ থেকে জাপানে সুসি অভিজাত্য লাভ করে। ‘ইদো যুগ’ থেকে তা আধুনিকতা পায়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পায়। পাশ্চাত্যে স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৮৩ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ‘সুসি’ শব্দটি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে।
বর্তমানে জাপানের পাশাপাশি আমেরিকা, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে জাপানি ‘সুসি’ জনপ্রিয় একটি খাবার। বিখ্যাত সব রেস্টুরেন্টে খাদ্য তালিকা বা মেন্যুতে সুসি’র নাম থাকে।
_____________________________________
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত / ২৮ অক্টোবর, ২০১৬