১৯৮৭ সালে এসএসসি পরিক্ষায় তিন অংক বিষয় ( গনিত, উচ্চতর গনিত ও বুককিপিং) তিনটাতেই আমি ৮০%+ লেটার মার্ক পেয়েছিলাম । আমি অংকে ভালো – এটা বলা যেতে পারে। কিন্তু জাপানীদের ধর্মপালন নিয়ে সাধারণ শতকরা অংকটি মেলাতে আমার ১০ বছর লেগেছে। জরিপ মতে জাপানে- ৮০ ভাগ বৌদ্ধিষ্ট , ৭০ ভাগ সিন্তু, ৩০ ভাগ নাস্তিক, ৩ ভাগ খৃষ্টান, ১ ভাগ অন্যান্য । সর্বমোট ১৮১% । বাড়তি ৮১% কোথায় থেকে আসলো?
২০০৫ সালে জাপান আসার আগে জানতাম, জাপানীরা বুদ্ধিষ্ট । আসার পর একই ঘরে বুদ্ধিষ্ট ও সিন্তুদের বিগ্রহ দেখে অবাক হয়েছিলাম। আগ্রহের সাথে বিষয়টি ঘাটাঘাটি করার পর জেনেছিলাম। একই জাপানী একই সঙ্গে ২ বা দুইয়ের অধিক ধর্ম পালন করে ।
এই বিষয়ে একটি প্রবাদ আছে – জাপানীরা জন্মে সিন্তু হয়ে, বাঁচে নাস্তিকের হয়ে আর মরে বুদ্ধিষ্ট হিসাবে । একজন জাপানি একাধিক ধর্ম পালন করে বলেই – শতকরা অংকটি জটিল হয়েছে।
বর্তমানে বৌদ্ধ ও সিন্তুর পাশাপাশি খৃষ্টান ধর্মের কয়েকটি রীতি আনন্দের সাথে পালন করে। শতভাগ জাপানী তরুণ জাপানীরা – ক্রিসমাস পালন করে। ক্রস নিয়ে নানা ধরনের পশ্চিমাদের মত ফ্যাশন করে । এমনকি খৃষ্টান না হওয়ার পরও চার্চে গিয়ে বিয়ে করে। পশ্চিমাদের আভিজাত্য বিয়ের পোষাক ও রীতি খুবই তরুণীদের খুবই পছন্দ । তাছাড়া সিন্তু বা টেডিশন্যাল বিয়ের চেয়ে চার্চে গিয়ে বিয়ে করলে খুবই কম খরচ হয়। নরকের ভয়, হিংসা ও শ্রেষ্টত্বে ত্রাসকে উৎসাহ দেয় না – এমন সব পথকেই জাপানীরা স্বাগত জানায়।
ক্রিসমাসের সময় – পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আলোকসজ্জা একটি আয়োজিত হয় টকিওতে । খৃষ্টান না ওয়ার পরও ঘরে ঘরে কেক কেটে যীশুর জন্মদিন পালন করে। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাস-ফেরি, মার্কেট সবজায়গায় সবাই ক্রিসমাস-ট্রি’র শোপিস সাজায়। যীশু – জাপানীদের নবী না হলেও তাকে গ্রহন করেছে।
অধিকাংশ জাপানী বাস্তববাদী, হইলৌকিক হলেও মানবিকগুণে গুণান্বিত! বিজ্ঞানের জয়জয়াকারের মাঝেও এখন জাপানে নতুন নতুন ধর্ম অবতারনা ও প্রচারিত হয়। বহুমত বহুপদ এর মাঝেও এখানে হানাহানি,অস্থিরতা ও মতের শ্রেষ্টত্বের বড়াই খুবই কম। এ ব্যাপারে জাপান সরকারের নীতি – সব কিছুই করা যাবে , কিন্তু অন্যের ক্ষতি, মারামারি ও মানবাধীকার লঙ্গন করা যাবে না । কোন সভা, সঙ্গ বা ও উৎসবের আগে স্থানীয় সরকার থেকে ‘কারো জন্য ক্ষতিকর কিছু বলা বা করা হবে না’ বলে আয়োজকদের দস্তখত দিতে হয়। স্থানীয় প্রশাসন – আয়োজনের সফলতার জন্য কমিউনিটি রিডিও ও সরকারি পত্রিকায় প্রচার করে।
সবাই পুরাপুরি এই নীতি পালান করে । মারামারি ও ঝগড়া জাপানী সমাজে শুন্যের কোঠায়।
জাপানীরা ধর্মকে মতবাদের চেয়ে – মানুষ হওযার ও ভালোথাকার পথ হিসাবে গ্রহন করে। ভালো লাগলে সহজে যেমন গ্রহন করে, ভালো না লাগলে সহজে তেমনি পরিত্যাগ করে । এ জন্য পিতা-মাতা, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি যাজকগনের জোড়-জব্বরদস্থি করে না। সবাই স্রষ্টাকে ‘খামিসামা’ বলে। একে অন্যের ধর্ম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে, মিলে মিশে সবাই শান্তিতে দিন কাটায়।