আমি জাপানে দৈত্যের নাচ দেখেছি- এ কথা শুনলে, নিশ্চিত করে বলা যায়, অধিকাংশ মানুষই আমাকে হয় পাগল বা অতি আলাপী বলবে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী উৎসুকেরা হয়তো শিশুর মতো নানা প্রশ্ন করে বিষয়টাকে পেঁচিয়ে ফেলবে।
কিন্ত কথা সত্যি। আমি দৈত্যের নাচ দেখেছি। দৈত্যের নাচের কথা প্রথম যেদিন শুনেছিলাম আমারও বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছিলাম- এটা কী করে সম্ভব? তাও আবার জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাপানে!
২০১১ সালে প্রথম যখন সাদো দ্বীপে আসি, জাপানি বন্ধুদের কথায় অনুমান করেছিলাম- দৈত্যের নাচ, হয়তো প্লানচেট, জ্বিন হাজির, যাদু-মন্ত্রের মতো কিছু একটা হবে।
এক বন্ধু বললো- বসন্তের শুরুতে দেখতে পারো! এ কথা শুনে আমার গা ছম ছম করেছিল, ভয়ে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই আমি যাদু-মন্ত্র, প্রাচীন কুসংস্কার পছন্দ করি না। আমার বয়স যখন দশ কিংবা বারো, একবার মুক্তাগাছায় নানার বাড়িতে জ্বিন হাজির দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রথম প্রথম আমি তো বিশ্বাস করতে চাইনি। কিন্তু রাতের অন্ধকারে অদ্ভুত কণ্ঠে জ্বিনকে কথা বলতে শুনে অবাক হয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি না বলে, যখন রাতের মজমার নীরবতা ভঙ্গ করেছিলাম, জ্বিনের আছর পাওয়া লোকটি আমাকে মারতে এসেছিল!
পাহাড়, বন, সমুদ্রে ঘেরা সাদো দ্বীপকে প্রথম থেকেই আমার রহস্যময় মনে হয়। সবকিছুই অন্যরকম- একটু বেশি সরল, একটু বেশি ভালো; যা সন্দেহ জাগায়। যখন জানলাম- সাদো দ্বীপ একসময় নির্বাসনের জন্য ব্যবহার করা হতো, তখন ভয় ও রহস্যের মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। হাজার বছর ধরে নাকি, মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে এই দ্বীপে অনেক পরাজিত রাজা, যোদ্ধা, প্রতিবাদী, বিপ্লবী আর অপরাধীদের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। আজকের সাদোবাসীর জনগণ নাকি তাদেরই উত্তরসূরি।
বসন্তের শুরুতে এক বিকালে কাছের সিন্তু শ্রারইন (দেবালয়) থেকে বিকট ঢোলের শব্দ আসছিল! শব্দটির সঙ্গে পূজার ঢোলের শব্দের মিল পাচ্ছিলাম, কিন্তু বিকট। বন্ধুরা বললো- আজ দৈত্যের নাচ হবে, চল যাই দেখে আসি!
ভয় ও উৎসাহ মিশ্র প্রত্যাশা নিয়ে শ্রাইনের সামনে দিয়ে দেখি, সত্যিই কয়েকটি দৈত্য নাচছে। আমি তো দেখে অবাক। ভয়ার্ত কিন্তু অনুপম নাচ।
নাটুয়াদের পোশাক, ঝাঁকড়া চুল, রাক্ষসের মুখোশ আর দর্শকদের উৎসুক দৃষ্টিতে, নিজেকে মনে হচ্ছিল- রাক্ষসের দেশে আমি এক আমন্ত্রিত অতিথি। চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকের মতো দৈত্যদের উথাল-পাতাল নাচে আমি মুগ্ধ হলেও মন থেকে ভয় কাটছিলো না। দৈত্যের লাঠির মারের ভয়ে দৈত্যের কাছে যাইনি! সঙ্গে থাকা বান্ধবী আশ্বস্ত করলো- বিপদজনক কিছুই হবে না। ভয় পেয়ো না! জাপানি দৈত্য, কিন্তু অনেক ভদ্র!
সাদোবাসী দৈত্যের নাচকে ‘ওনি-ডাইকা’ বা ‘ওনডাইকো’ বলে। জাপানি শব্দ ‘ওনি’ মানে দৈত্য আর ড্রামের তালে তালে নাচকে বলা হয় ‘ডাইকো’। সারা জাপানে প্রায় ৫০০০ রকমের ভূত-পেত্নী-দৈত্যের মিথ আছে। যা শুধু- শিশুদের রূপকথার অংশই না, স্থানীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত। জাপানের প্রায় সব সংস্কৃতি, উৎসব ও আচার কোন না কোন ভাবে প্রাচীন বিশ্বাস, স্থানীয় লোককথা ও মানবিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত।
সারা দুনিয়াতে দৈত্য, রাক্ষস ও অসুরকে যেখানে অশুভতার প্রতীক হিসাবে ঘৃণা করা হয়, সেখানে সাদোবাসী ‘দৈত্য’কে দেখে পুরোপুরি ভিন্নভাবে- সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে। স্থানীয় বিশ্বাস- অশুভ করার সব রকমের ক্ষমতা দৈত্য ও অসুরের আছে। দৈত্যকে খুশি রাখতে পারলে, সে কখনো ক্ষতি করে না।
ফলে সৌভাগ্য ও সফলতা আসে সহজে। এই বিশ্বাসে, সাদোবাসী ফসল কাটা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বসন্তের শুরুতে- পাড়ায় পাড়ায় ওনিডাইকো’র আয়োজন করে। অনুমানিক ৮৭৭ সাল থেকে সাদোতে ওনিডাইকো জনপ্রিয়তার সাথে চর্চা করা হচ্ছে! সাদোতে ১১০টিরও বেশি ওনিডাইকো লোকনৃত্য গ্রুপ রয়েছে! ১৯৩০ সালে পঞ্চম বার্ষিক জাতীয় লোক উৎসবে যোগদানের মাধ্যমে সাদোর ওনিডাইকো সারা জাপানে পরিচিতি লাভ করে।
অঞ্চলভেদে লোকনৃত্য ‘অনিডাইকো’ তিন প্রকারের হয়ে থাকে। ১) আইকাওয়া অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের বৃদ্ধদের নাচ, যাকে মামেমাকিও বলা হয়, ২) কুনিনাকি অর্থাৎ মধ্যঅঞ্চলীয় সাদা-কালো পোশাক পরে দুইটি ড্রাগন বা সিংহের সঙ্গে নাচ আর ৩) দক্ষিণদের ড্রামের বাজনার সাথে বাঁশি বাজিয়ে নাচ। তবে সব নাচেই ড্রামের তালে তালে ড্রাগন ও ওনি’র লড়াই চলে, অবশেষে ড্রামের কাছে এসে ‘ওনি’ নতি স্বীকার করে।
অশুভতা তাড়ানোর জন্য, ঝামেলামুক্ত রাখার জন্য; সাদোর প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানে ও উৎসব শুরু হয় দৈত্যের নাচ দিয়ে। সুস্বাস্থ্য, সৌভাগ্য, সুখ-শান্তি নিশ্চিতের জন্য একে এক ধরনের প্রার্থনা হিসাবে গণ্য করা হয়। উৎসব শুরুর আগে ‘ওনির দল’ ঘরে ঘরে যায়। আর্শীবাদ শেষে গৃহস্থ খাবারের আয়োজন করে, দান করে- মনে করেন দানের মাধ্যমে ওনি’র সন্তুষ্টি ও অকল্যাণ থেকে তার পরিবার ও ভাগ্য রক্ষা পাবে।
সংসারে শিশু থাকলে শিশুদেরকে ড্রাগন আলিঙ্গন করে অকল্যাণ মুক্ত রাখে। অঞ্চল ভেদে অনেক রকমের দৈত্য ও দৈত্যের নাচ আছে। নাচের প্রকার কিছুটা ভিন্ন হলেও ঝাঁকড়া চুল, চকচকে রঙ্গিন পোশাক, বাঁশ পাতা আর লতায় মোড়ানো জাপানি টাইকো ঢোল, মানুষ চালিত ড্রাগন আয়োজনে সবাই একই রকম। প্রাচীন এ লোকনৃত্য অতি জনপ্রিয় হওযার কারণে হয়তো- সাদোর সবচেয়ে উঁচু পর্বত ‘ডনডেন’ (৯৮০ মিটার) ওনিডাইকো ঢোলের বাজনা ‘ডন ডেনের’ নামের সঙ্গে মিলে। সাদো দ্বীপকে অনেকে ‘ল্যান্ড অফ ওনিডাইকো’ বলে।
জাপানের প্রতিটি প্রদেশে কোন না কোন বিশেষ সংস্কৃতি আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিকতায় উন্নত হলেও ক্ষতি করে না এমন ঐতিহ্যবাহী প্রথা ও আচারকে জাপান ত্যাগ করেনি। জাপানি প্রশাসন স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালনে উৎসাহ ও সহযোগিতা দেয়। হয়তো সেই কারণে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি আজও জাপানে টিকে আছে; ইউনেস্কো স্বীকৃত, বিশ্বখ্যাত ১৩টি ‘কালচারাল হেরিটেজ’ রয়েছে জাপানে।
—————————————————————
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত/ ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৬