জাপানি বিয়েতে শ্বশুর-জামাইয়ের পাঞ্জা এক ব্যতিক্রম ঐতিহ্য। যেন কন্যা ছিনিয়ে নিতে জামাইকে শ্বশুরের কাছে পেশির পরিচয় দিতে হচ্ছে !
জাপান এশিয়ার একটি দেশ হলেও এর ধর্ম-আচার-প্রথা অন্যদেশ থেকে একেবারে ভিন্ন! আধুনিকতায় এদের সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সহনশীলতা ও স্বাধীনতা এসেছে, ঝামেলামুক্ত হয়েছে জীবন, কিন্তু নিজস্বতা হারায়নি।
আধুনিক এ যুগে, বিশেষ করে ১৯৮০ সালের পর থেকে বিশ্বায়নের প্রভাবে নারী-পুরুষ উভয়েই বেশ বিয়ে বিমুখ।এর মূল কারণ জীবন-যাপন ও কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততা, নিজের পছন্দ মত থাকার স্বাধীনতা, সন্তান ও জীবনসঙ্গীকে লালনের আস্থার অভাব, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি । তারপরও প্রতিবছর গড়ে সাত লাখ বিয়ে হয় জাপানে।
বলা হয়, জাপানিদের জন্মহার স্বাভাবিক রাখার জন্য, বিয়ে ও সন্তান গ্রহন আরও বাড়ানো দরকার। বর্তমানে যে হার আছে, এভাবে চললে সাতশ’ বছর পর জাপান নাকি জনশূন্য হয়ে যাবে! তাই পরিবার, সমাজ, সরকার- চারদিক থেকে জাপানিরা বিয়েও সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ পায়।
তবে বহু বিয়ে, সমকামী বিয়ে, ক্ষণিক সম্পর্ক- এসব এখানে অঘোষিত নিষিদ্ধ। কিন্তু ভিন্নজাতির, ভিন্নবর্ণের ও ভিন্নধর্মের মাঝে বিয়েকে এখানে খারাপ মনে করা হয় না, অনেকক্ষেত্রেই আধুনিক ও মুক্তমনা বলে যুগলদের প্রশংসা করা হয়।
জাপানের শহর ও গ্রামে বিয়ের রীতি, তরুণ-তরুণীদের জীবনযাপন ভিন্নরকম। গ্রামের বিয়েগুলো সাধারণত পারিবারকেন্দ্রিক হয়। এদিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ মিল আছে। তবে শহরের সম্পর্কগুলো অনেকাংশে ‘লিভ-টুগেদার’ কেন্দ্রিক। জানা-শোনা দুজন মানুষ একসাথে থাকে, যতদিন না তারা মনে করে একে অপরের সাথে সারাজীবন কাটানো যায়, ততদিন সাধারনত বিয়ে করে না। তবে সন্তান হলে বা নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করে ফেলে।
পশ্চিমা ধাচের ফ্যাশন জাপানি তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় হলেও তারা সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বহুগামিতা’ ও যৌন স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে জাপানিরা বেশ রক্ষণশীল, মানবিক ও ধর্মকেন্দ্রিক। জাপানি তরুণ-তরুণীরা সাধারণত একসঙ্গে অনেকের সাথে সম্পর্ক করে না; যে করে তার কপালে দুঃখ আছে। জানাজানি হলে তার সঙ্গে কেউ সহজে মিশতে চায় না, নিরাপদ মনে করে না।
দিন দিন জাপানের গ্রামগুলোতেও ‘লিভটুগেদার’ বাড়ছে। তবে শহর থেকে এর রূপ কিছুটা ভিন্ন। গ্রামের সম্পর্কগুলো সাধারণত সহজে যৌনতায় গড়ায় না, আর গড়ালে তা বিয়েতে পরিণতি পায়। তাছাড়া বিয়ে বর্হিভূত সম্পর্কে সন্তান জন্মালে তার দায়িত্ব মা-বাবাকে নিতে হয়। বিয়ে না হলেও বাবা-মার পরিচয় পায় সন্তান। বাবাকে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হয়। এক্ষেত্রে শিশু সাধারণত মায়ের কাছেই থাকে।
সারা দুনিয়াতেই বিয়ে হয় ধর্ম বা আইনকেন্দ্রিক। জাপানে ধর্ম যাই হোক না কেন, আইনগতভাবে সিটি অফিসে নিবন্ধন করতেই হবে সবাইকে। আইনের পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মকেন্দ্রিক বিয়েও এখানে জনপ্রিয় ও সর্বজনস্বীকৃত।
জাপানিদের ধর্মবিশ্বাস বেশ জটিল। একজন মানুষ একইসঙ্গে একাধিক ধর্ম পালন করেন। কেউ নাস্তিক হলেও ধর্মীয় আচারগুলোকে সামাজিক ও মানবিক আচার হিসাবে মানেন। অস্বীকার বা বিদ্রোহ করেন না। তাই বিয়ের সময় শ্রাইন বা গির্জায় যেতে কেউ অস্বীকার করেন না।
জাপানি বিয়ের প্রথম পর্ব হয় সাধারত ‘সিন্তু’ ধর্মমতে। এসময় কনে ঐতিহ্যবাহী সাদা জাপানি পোশাক পরেন, আর বর পরেন ধূসর অতনো-কিমোনো। প্রার্থনার আগে বর-কনে দু’জনই বিশুদ্ধ ‘সাকি’ বা ওয়াইন পান করে।
তিনবার গন্ধ নেওয়ার পর ছোট তিন বাটি ওয়াইন পান করে বর ও কনে। জাপানিরা ‘তিন’ সংখ্যাটিকে পূর্ণতা ও সাফল্যের প্রতীক মনে করে। জাপানিদের বিশ্বাস, ওয়াইন পানের পর শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতা আসে, পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদের সাথে উত্তর পুরুষের মঙ্গলযাত্রারও দুয়ার খুলে যায়। এই পর্বে কনের শুভ্রপোশাক শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক বলে মনে করা হয়। দু’পক্ষের মা-বাবা ও আত্নীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে পিনপতন নিরবতায় সমস্ত প্রথা পালন শেষে বর-কনে একে অন্যকে নমঃ করে। জীবন সাথী হিসাবে মেনে নেয়।
এরপর শুরু হয় নানা পর্বের রিসিপশন। রিসিপশনে বর-কনে দু’জনই দামী ‘কিমোনো’ পরে। ঐতিহ্যবাহী জাপানি বিয়ের পেশাকের দাম এত বেশি যে, বর-কনে একবার পরার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করতে চায় না। তাই ‘ওয়েডিং হাউজ’ থেকে ভাড়া নেয় প্রায় সবাই।
রিসিপশনের সময় নানা ধরনের কৌতুক করা হয়। বর-কনে প্রতি পর্বে পোশাক পরিবর্তন করে নতুন রূপে হাজির হয়, যা একধরনের রীতি ও বিনোদন। এসময় জাপানিরা সামুরাই আমলের পোশাক পরে মজা করে, তলোয়ার দিয়ে কেক ও কাটে কেউ কেউ।
তবে আধুনিক বিয়েতে পাশ্চাত্য স্টাইল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অধিকাংশ কনের পছন্দ হলিউডের সিনেমার মত ‘ওয়েস্টার্ন লং ওয়েডিং ড্রেস’। জাপানিরা শতকরা ১ ভাগের কম খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হলেও ৬০ ভাগ বর-কনে বিয়ে করে চার্চে গিয়ে। জনশ্রুতি আছে- জাপানিরা তিনধর্মের জাতি। একজন জাপানি জন্মে সিন্তু হয়ে, বিয়ে করে খ্রিস্টান হয়ে, আর মরে বুদ্ধিস্ট হয়ে!
গত কয়েকদশক ধরে এখানে হরেক রকমের বিয়ের রীতি চালু হয়েছে- প্রাকৃতিক বিয়ে, গণ বিয়ে, বিদেশি বিয়ে, ভিন্নজাতিতে বিয়ে ইত্যাদি। কোন কোন যুগল তাদের পছন্দ মত বিভিন্ন ঋতুতে ও প্রাকৃতিক পরিবেশে গিয়ে বিয়ে করেন। সূর্যমুখির খেতে ফুলের আবেশে বিয়ে, সাকুরার হানামিতে (চেরি বা অন্য কোন ফুলের দৃশ্য দেখতে দেখতে) বিয়ে, মমিজির স্পটে (জাপানি ম্যাপল গাছের নিচে) বিয়ে, ঝর্ণার ধারে বিয়ে- বেশ আর্কষণীয়।
জাপানি বিয়ের উপহার দেওয়ার রীতি ও অঘোষিতভাবে বাধ্যতামূলক। তবে বাংলাদেশের মতো থালা-বাসন, ফ্রিজ, টিভি, গয়না নয়! এখানে উপহার মানে টাকা (ইয়েন), আর্কষণীয় নকশাদার ইনভেলাপে মোড়ানো নোট। কেউ দশ হাজারের কম দেয় না।
বর-কনে কাউকে দাওয়াত দিলে ধরে নেওয়া হয় অতিথি ‘স্বামী-স্ত্রী’ দু’জনেই আসবেন। কেউ না আসলে ধরে নেওয়া হয় সে বর-কনের মঙ্গল কামনা করেনি, প্রচণ্ড অভদ্র মানুষ!
‘জবহান্টিং’ বা চাকরি খোঁজার মত বতর্মানে জাপানে ‘স্পাউসহান্টিং’ বা পাত্র-পাত্রী খোঁজা জনপ্রিয়। যেহেতু তরুণ-তরুণীরা বিয়ে করতে চায় না, সন্তান নিতে চায় না, সেহেতু কোন কোন অঞ্চলে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ‘স্পাউসহান্টিং’ ইভেন্ট আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের মতে কনে দেখার রীতি জাপানেও আছে । তবে একটু ভিন্ন, পিতা-মাতা, আত্নীয়-স্বজন তেমন নাক গলান না, পাত্র-পাত্রীর পছন্দই আসল সিদ্ধান্ত। বর-কনে দেখাকে জাপানে বলা হয় ‘মিয়াই’। ঘটকমশাই বংশ, লেখাপড়া, স্বভাব, চরিত্র মিলিয়ে বর-কনেকে পরিচয় করিয়ে দেন। বর-কনেকে নির্দিষ্টস্থানে বা রেস্টুরেন্টে বসিয়ে চলে যান। বর-কনে খোলামেলা আলাপ করে, একসঙ্গে খায় ও একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করে। ভালো লাগলে ঘটককে বলে। তারপর বিয়ের আয়োজন করা হয়।
যাই হোক, বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথিদের সামানে পেশাদার নৃত্য পরিবেশক দলের সাথে বর-কনে নাচে, নাচে তার বন্ধু-বান্ধবও। শ্বশুরের সঙ্গে জামাই পাঞ্জা লড়ে ! বিশাল কেককাটার পর আগত অতিথিরা মন ভরে পান করে, শত প্রকারের খাবার খায়।
জাপানে প্রথম বিয়ের দাওয়াত খাওয়াটা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত করুণ এক ইতিহাস। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ক্ষুধায় যখন আমি কাতর, তখন খাবার আসলো এক টুকরা ‘সুসি’ (কাঁচা মাছের খাবার রেসিপি)। আমি তো দেখে হতাশ!
ভেবেছিলাম আর খাবার আসবে না, এ খেয়েই আজ থাকতে হবে। ওই সময় বাংলাদেশের বিয়েতে পোলাও-বিরিয়ানি, কোরমা-কালিয়া খাওয়ার কথা মনে পড়ছিল। আমি জানতামনা- জাপানি বিয়েতে একসঙ্গে অনেক খাবার দেয় না। এরপর একটার পর একটা প্রায় দুইঘণ্টা নতুন নতুন আইটেম আসলো। কতক্ষণ খাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
খেতে খেতে হল ভর্তি অতিথি সবাই শিল্পীদের নাচ-গান-কৌতুক দেখলাম। বর-কনে বিনোদন অনুষ্ঠানের পর সবাইকে গেইটে বিদায় দিল। গেইটে আয়োজন করা হয়েছে বর-কনের বেড়ে ওঠা জীবনের উপর ছবির প্রর্দশনী। সবাই একে একে বর-কনের সঙ্গে ছবি তুলছে আর শুভ কামনা জানাচ্ছে। আমিও ছবি তুললাম।
—————————————————————
বিঃদ্রঃ – লেখাটি বিডিনিউজ২৪ এ (২০ নভেম্বর ২০১৬) প্রকাশিত হয়েছে