জাপানী ঘর জামাই

আমি ঘর জামাই না! শুশুর বাড়ী থেকে ৮০০ মাইল দূরে, নিজের বাড়িতে থাকি, নিজেরটা খাই, নিজেরটা পড়ি! পুরো স্বাধীনতা আছে। ২০০৫ সাল থেকে আমি জাপানে থাকি। ভাষা ও আচারের ভিন্নতা ছাড়া তেমন খারাপ অভিজ্ঞতা হয়নি । জাপানের শহর ও গ্রামের সংস্কৃতিতে ভিন্নতা আছে, যেমনটা আছে অন‍্য দেশগুলো। শহরের মানুষ সাধারনত আত্নকেন্দ্রিক ( স্বার্থপর বলা যেতে পারে ) ও একরোখা; আর গ্রামের মানুষ সামাজিক ও অনেকটা স্বার্থহীন ( অঞ্চল ভেদে ভিন্নতা অবশ‍্যই আছে)।

শুধু জাপানে না, সব দেশেই ঘর জামাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কম। অন‍্যের খেয়ে, অন‍্যের পড়ে তো, আর যাহোক মোড়লগিরি-মাতবরি দেখানো যায় না, দেখানো ঠিকও না। তবে এটা সঠিক, সব জাপানীদের নিজস্বতা আছে। স্বাধীন ভাবে নিজের মত করে থাকতে ও ভাবতে পছন্দ করে, যাদি ফুটাংঙ্গিগিরি কম করে। অ‍ন‍্যের সম্পদে ও পছন্দে নাক গলায় না । বহুত পিরিতি দেখিয়ে অন‍্যের ব‍্যাক্তিগত তথ‍্য জানতে চায় না । ( যেমন প্রথম দেখাতেই বলে না – তোমার বাবা কি করে, তুমি কি কর, কত টাকা বেতন পাও, ব‍্যাংকে কত টাকা আছে ইত‍্যাদি) । গরীব হলে জাপানীরা হেলা করে না, ধনী হলে হিংসা করে না! হয়তো এই কারণে অযথা বাহুদূরী ও ঝগড়া-ঝাটি কম হয়। যার কিছু না, সেও চুরি বা ধান্দাবাজি চিন্তা করে না। সম‍স‍্যা কাটিয়ে উঠার সব চেষ্টাই করে। যা আমাদের – মটিবেশনের অনেকটা উল্টা!

আর সম্পকর্ের বেলায় সব শহরেই একই রকম। যেমন – আমরা যখন ধানমন্তিতে থাকতাম। ৩৬ ফ্লাটে ৩৬ ফ‍্যামিলী একই সঙ্গে থাকতাম । কিন্ত আমাদের সঙ্গে সম্পকর্ ছিল মাত্র – ২টি ফ‍্যামিলী। বাকীরা হয়তো চিনতো না, জানতোই না । আমি অবাক হয়েছিলাম – ১২/এ এর বাসা পরিবর্তন করে যখন ২৮ নম্বর যাচ্ছিলাম, এক পরশী আমাকে জিজ্ঞাস করে, আপনি কত নম্বরে থাকতেন । তার মানে তিনি আমাদেরকে চিনতেন বা জানতেন না।

২০১১ সাল থেকে আমি সাদো দ্বীপ থাকি ( টোকিও থেকে অনেক দূরে, অনেকটা আমাদের কুতুবদিয়া দ্বীপের মতো…)। এটি একটি প্রান্তিক সবুজ-দ্বীপ শহর। শহর হলেও গ্রামের সব গুণই এখানে আছে। এখানে, জাপানের অন‍্যান‍্য গ্রামের মতো পারিবারিক-সমাজিক বন্ধন দৃঢ়! সব পড়শী সবাইকে চিনে, জানে। খাতির-যত্ন করে । তবে বাংলাদেশের মত রান্না করে টিফিন-ক‍্যারিয়ারে মোরোগ-পুলাও বাসায় পৌঁছে না দিলেও; পড়শি তার ক্ষেত থেকে সবচেয়ে ভালো সবজি ও ফল দেয়। পুটলা ভতর্ি করে বাচ্চাদের কাপড়-চোপড়-খেলনা উপহার দেয়। (অসাগারি)

গত বছর এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার । আমারা একটি হাইভিশন (বড় টিভি) কেনার পরিকল্পনা করছিলাম । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমার স্ত্রী ফেইজবুকে পরামর্শের জন‍্য একটি পোষ্টিং দিল – ‘কোন ব‍্যন্ডের দাম কম ও ভালো হবে?’ ঘন্টা খানেকের মাঝেই একজন ফোন করল, বলল – ‘আমাদের ৪টা হাইভিশন আছে, ভাই-বোন টোকিওতে চলে যাওয়ার পর ২টা ঘরে পড়ে আছে। তোমরা চাইলে ১টা নিতে পার, টাকা দিতে হবে না । ১.৫ লাখ টাকা দামের টিভি বিনাপয়সায় পেলাম! আনার সময মাত্র ২হাজার টাকা অকাশী (বিস্কুট) নিয়ে গেলাম । সেই অদেখা ফেইবুক বন্ধু, আমাদের পেয়ে মহাখুশি। ২ ঘন্টা আলাপ করলো, প্রকৃত বন্ধু হলো! আড্ডার সময় দামী দামী ( প্রায় ১০ ইয়েন খরচ করে ) খাবার খাওয়ালো,এগিয়ে দিল।

আরোটি ভিন্ন অভিজ্ঞতাও হয়েছে। যেমন ২০০৫ সালে, প্রথম পুত্রের জন্মের সময়, আমি ঢাকা থেকে এসে প্রায়শঃ শুশুর বাড়ীতে থাকতাম। একবার, টানা ৭ মাস শুশুর বাড়ী তে ছিলাম। বিনা-পয়সায় থাকা-খাওয়ায় বাঙালীর অহংঙ্কারে ভাঙন ধরেছিল। শুশুর-শাশুড়ীকে থাকা-খাওয়ার টাকা দেয়ার সাহস হয়নি। কিভাবে ঋণ শোধ করা যায় তার ফন্দি খুঁজছিলাম। ঠিক এই সময়- বাংলাদেশে আমি একটি বিরাট অঙ্কের প্রজেক্ট করেছিলাম। হাতে অনেক টাকা। একদিন খাবার টেবিলে ( কুদাতচুতে) আমার শুশুরী আলোচনা করছিল – উনি ২ লাখ টাকা দিয়ে একটি টিভি কিনতে চান, এর জন‍্য আগামী মাসের খরচ একটু কাটছাট করতে হবে। আমার অহৎকে সোজা করার জন‍্য, সুযোগের সৎব‍্যবহার করলাম, বললাম- “বেয়াদবি না করলে – টিভিটা আমি কিনে দিতে চাই।” শাশুড়ি তো শুনে অবাক! গরীব বাংলাদেশী বলে কি! সত‍্যিই যখন টাকাগুলো দিলাম, আমার স্ত্রী হাসতে সবাইকে বললো, “সিরাজী সানই মনেহয় প্রথম বাঙালী, যে কোন জাপানীকে বিনালাভে এত বড় উপহার দিল…”। আমার শাশুড়ী মুচকি হেসে বললেন – সিরাজী সান মনে হয়, অনেক ধনী মানুষ!

August 22, 2016