মুজিব বাইয়া যাওরে!….
১৯৭৫ সালে আমার বয়স ৬। তেমন বুঝমান হয়নি। বাবা আমার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন, আর বেদনায় ভাওইয়া সুরে গাইছিলেন, “মুজিব ভাইয়া যাওরে!….”
কেন কাঁদছিলেন, তখন বুঝতে পারিিন! তবে মনে আছে- অবাক হয়ে বাবার অশ্রু মুছে দিয়েছিলাম।
বড় হয়ে জেনেছি, যে দিন বাবা কেঁদেছিলেন, দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট! স্বপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন। আমার পিতা অফিসিয়ালি মুক্তিযোদ্ধা কিংবা আওয়ামীলীগের নেতা ছিলেন না। আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
– মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি তো তরুণ ছিলা, যুদ্ধে যাও নাই কেন?
বাবা কাঁদু কাঁদু কন্ঠে বলেন,
– সাহস কম আছিলো। বাড়িত থেইকা কেউ যাইতে দেয় নাই। যুদ্ধে যাই নাই ঠিকই, যুদ্ধের চেয়েও বেশী করেছি। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার ছিলাম। গ্রামে গ্রামে সাইকেল দিয়ে ঘুরে খবর সংগ্রহ করতাম। আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়াই ছিল আমার কাজ। সব সময়ই হাতের ভিতর আত্না লইয়া ঘুরতাম, যে কোন সময় রাজাকাররা আমাকে মেরে ফেলতে পারতো! জয়ের জন্য, আত্নরক্ষার জন্য যুদ্ধাদের হাতে তো অস্ত্র থাকে, আমার তো তাও ছিল না….বলে কেঁদে দিলেন!
– পাকিস্তান রক্ষার যুদ্ধে যাইনি, সাইকেল নিয়ে টইটই করে ঘুরতাম বলে, রাজাকার আর পাকসেনারা কয়েকবার ধরেছিল, মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আল্লাহর রহমতে প্রতিবারই কোন না কোন উছিলায় বেঁচে গেছি…
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গব্ন্ধুর প্রতি পিতার ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। ১৫ই আগস্টের দিন কাজ করতেন না। ফকির খাওয়াতেন। বাবা এখন এই জগতে নেই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, জাতির পিতার প্রতি তার ভালোবাসা আজো রযে গেছে, আমার অন্তরে। কেউ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে কুটুক্তি করলে পিতা ‘তেলে-বেগুনে’ রেগে যেতেন, সরাসরি বকাঝকা করতেন। আমি বকাবকি না করলেও, ক্ষুব্ধ হই। বালবেটা বলি!
আমরা মনেহয়, জাতীয় শোক দিবস ১৫ই আগস্টে, যে মানুষ উল্লাস করে, ভূয়া জন্মদিন পালন করে, সে যেই হোক, সে পৃথিবীর সবচেয়ে মন্দ বাঙালি! আমি স্কুল জীবন থেকে এই এক পক্ষের কাঙালি ভোজ, মিলাদ, কীর্তন-প্রার্থনা; আরেকপক্ষের জম্মোৎসব পালন, বড় বড় কেক কাটা দেখে আহত হয়েছি। এমন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কে কে হাততালি দিত, পত্রিকায় দেখা তাদের হাসিমূখ এখনে আমার চোখে ভাসে, আহত হই।
ছোট থেকেই বাবা আমাকে রাজনৈতিক ও সমাজ সচেতনতা শিখিয়েছেন, যা আজো আমাকে সুপথ দেখায়। আমার পিতা বিখ্যাত, অনেক বড় শিক্ষিত বা বিশাল ধনী মানুষ ছিলেন না, নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ ছিলেন, কিন্তু তার অন্তরে ভালোবাসা ছিল, দেশপ্রেম ছিল। এমন পিতার সন্তান হয়ে আমি গর্ববোধ করি।