[fusion_text]
এক বছরের শিশু স্কুলে যায়, তাও আবার সারাদিন থাকে! একথা যেদিন প্রথম শুনেছিলাম, আমি অবাক হয়েছিলাম।
[/fusion_text]
কিন্তু সত্যি, জাপানে প্রতিটি শিশু এক বছর বয়স থেকেই স্কুলে যায়। হাসি, আনন্দ আর খেলাধুলায় বেড়ে ওঠে।
এ শিশুদের জন্য আছে জাপানে বিশেষ স্কুল, নাম তার ‘হুকশু’। যাকে কিন্ডারগার্টেন বা পশ্চিমা ধাঁচের ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ বলা যাবে না। পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল, আমাদের প্রাথমিক স্কুলের মতো। সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক, এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যও।
ভিন্ন ধরনের এই স্কুলে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বাবা-মায়েরা তাদের শিশুকে দিয়ে যান। বিকেল ৪টা-৫টায় বাবা-মা শিশুকে নিয়ে আসে। শিশু সারাদিন স্কুলে নিরাপদে থাকে,তাই বাবা-মাকে শিশু নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হয় না।
স্কুলে শিশু খেলা করে, খাবার খায়, দুপুরের সবাই একসঙ্গে ঘুমায়, গরমের সময় একসঙ্গে জলকেলি করে। একতার সাথে সব শিশু বেড়ে উঠে অনবদ্য বন্ধনে।
শিশুকে সময়মত স্কুলে দেয়ার জনপ্রিয় রীতি যদি কোন পিতা-মাতা না মানলে ধরে নেওয়া হয়, বাচ্চা বা পিতা-মাতার সমস্যা আছে। তাছাড়া ‘হুকশু’ না গেলে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির সমস্যা হয়। আধুনিক জাপানে পিতা-মাতারা শিশুদের নিরক্ষর রাখেন না। এখানে সবাই একশ’ ভাগ শিক্ষিত।
‘হুকশু’ স্কুলে কী শেখানো হয় তা নিয়ে আমার বেশ কৌতুহল ছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকদিন নিজের শিশুকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে জেনেছি। অভিবাদন, প্রশংসা, একতা, অন্যের ক্ষতি না করা, স্বাস্থ্য ও জিনিসের যত্ন নেয়া, নিজের কাজ নিজে করা- এসব শিশুর প্রথম পাঠ এখানে।
আশ্চর্যের বিষয়, শিশুর স্কুল ব্যাগে কোন বই থাকে না ! থাকে দাঁত পরিষ্কারের ব্রাশ, ছোট টাওয়াল, একটি পানি পানের গ্লাস ও রুমাল, ভাতের ‘ছোট টিফিন কৌটা’, চপস্টিক আর একটা ছোট নোট খাতা। বাড়ি থেকে ভাত নিলেও স্কুলে রান্না করা একই রকম সুষম সবজি, তরকারি ও ফলমূল দেয়া হয়।
বিশেষ দিনে বিশেষ আয়োজন হলে তা স্কুলের দরজায় রাখা কাচের বাক্সে রেখে পিতা-মাতাকে দেখানো হয়। কোন বিশেষ উৎসব বা ঋতু পরির্বতন হলে তার নমুনাও প্রবেশদ্বারের টেবিলে সাজিয়ে রেখে শিশুদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়। পিতা-মাতাদেরকেও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় উৎসবের আগমন।
জাপানি স্কুলে হয় পিতা বা মাতাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হয়। ড্রাইভার, খানসামা বা অনাত্নীয় কারো মাধ্যমে শিশুকে স্কুলে পাঠানো এখানে অঘোষিত নিষিদ্ধ ! কেউ পাঠায় না। সবাই নিজের শিশুকে নিজেই স্কুলে নিয়ে যায়।
ট্রাফিক কম, প্রত্যেক অঞ্চলে পরিকল্পনামাফিক স্কুল ও সবার গাড়ি থাকার কারণে বাংলাদেশের মতো ভোগান্তি নেই এখানে। আবার কারণ ছাড়া এক অঞ্চলের শিশু অন্য অঞ্চলের স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায় না। ঢাকার মতো অলিতে-গলিতে বাঙলা-ইংরেজি, ভালো-খারাপ স্কুল নেই। সব স্কুল ভালো, সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলেই পড়া ও পদ্ধতি এক।
শিশু অস্বাভাবিক ভালো বা খারাপ কিছু করলে, বিশেষ নির্দেশনা থাকলে শিক্ষক-শিক্ষিকা নোট লিখে দেন। বাবা-মা তা দেখে বিষয়টিতে নজর দেন। স্কুল থেকে শিশুকে বাড়ির কোন কাজ দেয়া হয় না। যা শেখার শিশুরা স্কুলেই শেখে।
জাপানিরা বলে, বাড়ি হলো বিশ্রাম ও ভালোবাসার জায়গা। আর স্কুল হলো শেখার জায়গা।
বন্ধু বা বান্ধবীর কিছু পছন্দ না হলে জাপানি শিশুরা ছোটবেলা থেকেই সরাসরি প্রতিবাদ বা ঝগড়া করে না। কোন কিছু খুব অপছন্দ বা খারাপ লাগলে শিশুরা সাধারণত কাঁদতে কাঁদতে শিক্ষক বা পিতামাতাকে জানায়। শিক্ষক ও পিতা-মাতারা শিশুদের শাসন করে কথায়, গায়ে হাত দেয় না। যেসব পিতা-মাতা বা শিক্ষক শিশুর গায়ে হাত তোলেন, তারা মন্দ মানুষ হিসাবে বিবেচিত হন সমাজে।
কোন শিশু ভুল করলে শিশুকে ততক্ষণ বোঝানো হয়, যতক্ষণ শিশু না বলে- ‘আমি বুঝেছি’। শিশুরা সাধারণত ভুল বোঝার পর কান্না করে, নিজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করে আর সে ভুলটি করবে না।
স্কুলের পাশাপাশি জাতীয় টিভি, ‘এনএইচকে’ একই ধারায় স্কুলে যাওয়ার আগে সকালে এবং স্কুল ফেরার পর শিশুদের জন্য নানা ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে। শিশু-হিরো অ্যানিমেশন, পুতুল নাচ, লোকজ নাচ-গানের অনুষ্ঠান জাপানি শিশুদের প্রিয়।
১৯৬২ সাল থেকে এনএইচকে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে শিশুদের অনুষ্ঠান তৈরি ও প্রচার করে। অনেকে বলেন, জাপানিরা সুশৃঙ্খল ও সৎ হওয়ার পেছনে ‘হুকশো’ ও ‘এনএইচকে’-এর অবদান সবচেয়ে বেশি।
জাপানের শিশুদের মাঝে বাংলাদেশের মতো পিতা-মাতার সামাজিক অবস্থানকেন্দ্রিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই নেই। স্কুলে প্রথম হওয়া রীতির পরিবর্তে এখানে আছে গ্রেড পদ্ধতি। কোন শিক্ষার্র্থী ফেল করে না । ককোন কারণে কোন বিষয়ে শিশু খুব খারাপ করলে, শিক্ষক-শিক্ষিকাকে জবাবদিহি করতে হয়।
আমি তো দেখে অবাক ! এক বছরের বাচ্চারাও স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। যেহেতু শিশু নিজে পুরোপুরি বুঝতে পারে না, তাই বাবা বা মায়ের সঙ্গী হয়ে, কোলে করে শিশু ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
আনন্দের সাথে শিক্ষা জাপানি শিশু-শিক্ষার শুক্তি। শহর কিংবা গ্রাম, সব স্কুলেই শিক্ষাপদ্ধতি এক। প্রকৃতি দেখা, জীবন থেকে শেখা, সুনাগরিক হিসাবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে ‘হুকশু’ স্কুল থেকেই নিয়মিত ভ্রমণ, সংস্কৃতি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
শিল্পচর্চা সব শিশুর জন্য আবশ্যক। আঁকাআকি, নাচ-গান, খেলা, আনন্দ-উল্লাসে প্রতিটি শিশু দক্ষতার সঙ্গে বেড়ে ওঠে। পিতা-মাতা পেশার বা সামাজিক অবস্থানের কারণে কোন শিশুই ভর্তি সুবিধা, অতিরিক্ত প্রশংসা ও অনুপ্রেরণা পায় না।
স্কুলের আচার ও পদ্ধতিতে শিশুর ধনী-গরীব, সাদা-কালো বা ধর্ম-বর্ণের পরিচয় বোঝার কোন উপায় নেই। সবাই সমান। কেউ কাউকে ছোট বা বড় ভাবে না। এ যেন পুঁজিবাদী দেশে সাম্যবাদের চর্চা!
হুকশু স্কুলের প্রতিটি উপাদান ও আয়োজন শিশুদের আনন্দ, চিন্তা ও দক্ষতার উন্নয়নের পাশাপাশি চরিত্র গঠনের অনুকূল। কোন কিছু ভুল প্রমাণিত হলে সেই সময়েই তা পরিবর্তন বা সরিয়ে ফেলা হয়।
‘হুকশু’তে আমার সব ছেলে-মেয়েরা গিয়েছে। আমি দেখেছি, এ এক দারুণ পদ্ধতি। এসব স্কুলে নারী শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। সবাই শিশুযত্নের ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত । মায়ের মতই শিক্ষকরা শিশুর যত্ন নেন, শিক্ষা দেন। হৃদয়ের বন্ধন এমন দৃঢ় হয় যে
স্কুল পরিবর্তনের বা বিদায়ের সময় শিশুও তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদে।
আমি যখন সকালে আমার শিশুকে স্কুলে নিয়ে যাই, সবসময় দরজায় একজন শিক্ষককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তিনি অভিভাবক ও শিক্ষার্থী, দুজনকেই ‘শুভ সকাল’ বলেন। নেতিবাচক শব্দ স্কুলে একেবারেই ব্যবহার করা হয় না। সততা, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়া হয় পদে পদে।
আদর্শের যে আচরণ আমরা শিশুকে শেখাতে চাই, তা শিশুর সামনে প্রতিদিন চর্চা করে জাপানি স্কুলে শিশুর অভ্যাসে পরিণত করা হয়। আনন্দের সঙ্গে স্কুলে সব ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে খেলে। গড়ে উঠে একই পরিবারে সদস্যের মতো ভালোবাসার বন্ধনে।
এ স্কুলে শিশুরা সাধারণত ছয় বছর পর্যন্ত যায়, এরপর প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ইতোমধ্যে ‘হুকশো’ স্কুলেই শিশু নিজের শরীরের যত্ন নেয়া, অন্যকে ভালোবাসা, লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা শিখে ফেলে।
গত পনের বছরে পিতা-মাতা তো পরের কথা, জাপানি শিশুদেরকেও রুক্ষ স্বরে ঝগড়া করতে দেখিনি। এ যেন এক অসম্ভবের দেশ! ঢাকার মত, এখানে পিতা-মাতার স্কুলের সামনে মজমা বসিয়ে, ঝাল-মুড়ি খেয়ে সময় নষ্ট করেন না, পাহারা দেন না।
গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই স্কুলের পরিবেশ ও শিক্ষাপদ্ধতি প্রায় একই রকম। সরকারি, বেসরকারি সব স্কু্লকেই জাতীয় শিক্ষানীতি ও অনুমোদিত পাঠপদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
স্কুলে অঘোষিত কোন ব্যবসা বা আয়ের সুযোগ নেই। সব হিসাব ও পরিকল্পনা উন্মুক্ত ও স্বাভাবিক। ঘোষণার বাইরে সবকিছুই বেআইনি ও দণ্ডনীয়। কেউ সীমা অতিক্রম করে না সাধারণত। যদি কখনো কিছু ঘটে, মিছিল মিটিং ছাড়াই- শুধু অভিযোগের ভিত্তিতেই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়।
‘হুকশু’তে প্রতিটি ছেলে-মেয়ের জন্মদিনের কেক-পার্টি আয়োজন করা হয়। বিষয়টি প্রথম শুনে আমার বেশ অন্যরকম মনে হয়েছিল। প্রতিটি ছেলে-মেয়ের জন্মদিন যদি পালিত হয়, তাহলে তো প্র্রতিদিনই কারো না কারো জন্মদিন থাকবে। তারপর খোঁজ নিয়ে দেখি, প্রতি সপ্তাহে একবার সাপ্তাহিক ‘শুভ জন্মদিন’ আয়োজন করা হয়। ওই সপ্তাহে জন্ম নেওয়া সব শিশুর জন্মদিন একসঙ্গে পালন করা হয়। মূল উদ্দেশ্য- শিশুদেরকে বিনোদন, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেওয়া।
মনোবিজ্ঞানের মতে, শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে পাঁচ বছরের রেকডিং-এর ওপর ভিত্তি করে। এসময় নাকি শিশু যা দেখে-শুনে ও বুঝে তার উপর ভিত্তি করেই শিশুর চরিত্র, ভাবনা, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। হয়তো বৈজ্ঞানিক এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই জাপান সরকার শিশু শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের শিশুরা সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকে। ধনী শিশুদের কিছু সুযোগ থাকলেও বড় হয় ‘কাজের মানুষের’ কোলে, আর গরীর শিশুদের শিশুকাল কেটে যায় ঘোরাঘুরি করে। ফলে সারাজীবন শিক্ষাহীন শিশুকালের খেসারত দিতে হয়।
জাপানের মতো বাংলাদেশের শিশুদের জন্য ‘হুকশু’ স্কুলের মতো স্কুল হলে কতই না ভালো হতো! ধনী-গরীব সব শিশু সমান সুযোগ, শিক্ষা ও মর্যাদায় বড় হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা, সব শিশুকে শিক্ষার আনন্দের বৃত্তে আনা হোক আমাদের ব্রত।
—————————————————————
বিঃদ্রঃ – বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত / ১১ নভেম্বর, ২০১৬