আমার পুত্র করোনেট (১২) লেখাপড়ায়’ বেশ ভালো, কিন্তু প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকে। বইপত্র-রুম গোছায় না! অতি ব্যস্ত থাকে! খেলাধূলার চেয়ে ডিজাইন-এনিমেশনের প্রতি তার টান। হয়তো বাবার স্বভাব বেশী পেয়েছে! আমরা ওকে কম্পিউটারের প্রতাপ ছাড়া সৃজনশীল জীবন-যাপনে অভ্যস্থ করতে চাই, কিন্তু পারি না। আমি যখন কম্পিউটার বন্ধ করতে বলি, তখন বিরক্ত হয়ে বলে,
– দিনে মাত্র দেড় ঘন্টা ব্যবহার করি! এত ডিষ্টার্ব কর ক্যান? তোমার মত সারাদিন ব্যবহার করি না! তুমি আগে কম্পিউটার ছাড়, তারপর আমি ছাড়ুম!..
“কলিকালের পুলাইপান, শাসন করার যায় না! মুখে উপর উল্টো কথা শুনাইয়া দেয়!” আমি মনে মনে বলি, “আমি কি তা পারবো রে বাবা? এটাই তো আমার নেশা-পেশা!..”
তার মানসিক চাপের কারণ অাবিস্কারের জন্য ‘ইউকা'(৫৫+) নামের এক কবিরাজের কাছে হঠাৎ আমার বউ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল! মরমীবাদ ও শক্তির প্রবাহের প্রতি আমার আস্থা থাকলেও কবিরাজীর প্রতি আমার ভক্তি নেই । একেবারে অবৈজ্ঞানিক, ভন্ড ও অশিক্ষিত মনে হয়।
জ্ঞান, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও অধিকার চর্চ্চায় জাপান এশিয়ার একনম্বরে হলেও; আজো এখানে নানা ধরনের আদি চিকিৎসা, কবিরাজী, হেকেমী, ঝাঁড়-ফুঁ এশিয়ান দেশগুলোর মতোই জনপ্রিয়। উন্নত হওয়ার পরও জাপান তার নিজস্ব প্রাচীন রীতিগুলো পরিত্যাগ করেনি। পুইরা বানাইয়া হাসপাতাল গুলো এখনও ঔষধ দেয়। কুসংস্কারগুলো বেশ গর্বের সঙ্গে লালন করে। জাপানিরা বলে,
– এগুলো আমার সম্পদ, আদি কালচার, কোন না কোন ভাবে সংরক্ষণ করতেই হবে!…
অযুক্তিক ও ক্ষতিকর দিক পরিত্যাগ করে জাপান আদি রীতি ও প্রকটিস গুলো অাধুনিকায়ন করেছে, যা অফিসিয়ালি স্বীকৃত ও সিটি অফিসে অধীনে সব রের্কড আছে!
‘মেইড ইন জাপান’, এমনি একটি ঝাঁড়-ফুঁ’র নাম ‘রেইকি’। যীশু’র মতো হাত দিয়ে ছোঁয়ে এ পদ্ধতিতে রোগ ভালো করে দেয়া যায়! জাপানে রেইকি’র উৎপক্তি হলেও সারা দুনিয়ায় এটি এখন বেশ নেচারাল হিলিং মেথড হিসাবে জনপ্রিয়।
পশ্চিমা আধুনিক ক্যামিক্যাল চিকিৎসার পদ্ধতি প্রতি সাধারনতঃ জাপানিদের ভক্তি কম। এরা বলে, তরিৎ লাভ হলেও ক্যামিকেল নাকি লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী করে! তবে ইষ্ট-এশিয়ান প্রাকৃতিক চিকিৎসার প্রতি আমার বউয়ের একটু বেশী টান। জীবন ও ভাবনা প্রকৃতি নির্ভর করতে পারলে জান দেয়! বেশী দাম হলেও আরগানিক খাবার কিনে! অন্য প্রদেশের মাছ-মাংস-সবজি পর্যন্ত কিনতে চায় না। আমার মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি লাগে!
কবিবাজের কথা শোনা সঙ্গে সঙ্গে আমার তো রাগে চোখ দিয়ে পারলে রক্ত বের হয়। কল্পনায় ভেসে উঠেছিল বাংলাদেশের কবিরাজের পরিচিত মুখ!
‘ঝাকড়া চুল, লাল টকটকে ডেরাডেরা রক্তচোখ ওয়ালা একজন কড়া মেজাজের মানুষের ছবি, ভাঙ্গা গলায় জোড়ে জোড়ে কথা বলছে, শরীরে গন্ধের উৎকট তৈল দিয়ে ক্যারিশমা দেখাচ্ছে ইত্যাদি!’….
জাপানি কবিরাজের চিকিৎসালয় দেখে তো আমি মাথা খারাপ। আমার ধারনার ঠিক উল্টো! হিলিং সেন্টারের কামড়াটি ছোট হলেও সব কিছুই ‘পাঁচ-তারা হোটেলের’ রুমের মত সাজানো, মনকাড়া লাইটিং, পরিপাটি, সুগন্ধ ভরা, বুক সেলফে অনেক দূর্বভ বই। যা বাংলাদেশের এফআরসিএস ডাক্তার খানাতেও নাই!
আর কবিরাজ মানুষটি শিক্ষিত, সুন্দরী, স্মার্ট, মধু মাখা কন্ঠে স্মীত হেসে কথা বলেন!…
করোনেটের সঙ্গে কাউন্সিলিং করার পরে, খাটিয়াতে শুইয়ে, কতক্ষন দূর থেকে মন্ত্র-ফুঁ দিয়ে অবশেষে অাবিস্কার করলেন- করোনেটে ‘নেগেটিভ’ পাওয়ার বেশী, তাই ষ্ট্রেসে থাকে। ওকে পজেটিভ পাওয়া দিয়ে শক্তির বেলেন্সে আনতে হবে। কোন কিছুতেই চাপা-চাপি করা যাবে না। যা ভালো লাগে না, তাই যেন করতে দেয়া হয়। যেসব খারার, রঙের পোষাক ও আচরনে পজেটিভ পাওয়ার বাড়ে তার একটি তালিকা দিলেন!
পুরো চিকিৎসা পদ্ধতি আমি গেষ্টের চেয়ারে বসে দেখছিলাম । মাঝে মাঝে ছবি আর ভিডিও তুলছিলাম। টেবিলে রাখা মজাদার দামী বিস্কুট গুলো সাবার করছিলাম আর মিটিমিটি হাসছিলাম!
প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে- ইউকা সান, ১ ঘন্টা রেইকি করে, হাতের ছোঁয়ায় করোনেটে শরীরে পজেটিভ শক্তি প্রবাহ করলেন । ফি নিলেন ৭৫০০ ইয়েন ( ৭৫ ডলার)। এক ঘন্টায় ৭৫ ডলার রোজগার বেশ বড় অংকে আয়! দামটা শুনে আমি ইতস্ততা করলে, মিসুজু সান বলে,
– বেশী দাম না, দিনে ২-৩ জনের বেশী রোগী পায় না ! তাছাড়া কাজটি তো সবাই পারে না । শিখতে অনেক টাকা লেগেছে, কষ্ট হয়েছে…
চিকিৎসা শেষে, গাড়ীতে ফেরার পথে করোনেট কে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কেমন লাগছে? মানুষটা ভস্ড না তো?
– না বাবা! ভন্ডামী করলে কেউ আসবে না! ঠকালে পুলিশে ধরবে। পরীক্ষা দিয়ে রেজিষ্টেশন নম্বর নিতে হয়! দুই নম্বরী করার সুযোগ নই!… আমার আগের চেয়ে ভালো। উনার মেসেজে এত অারমে পেয়েছি যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!…
পুত্র ও বউয়ের কাবিরাজের অতি প্রশংসা শুনে তো আমি হাদারাম বোকা। বউ-পোলাকে ভালোবাসতে হলে তো দেখছি, এখন করিরাজী ভালোবাসতে হবে!