যে শিল্প ও সাহিত্য কুসংস্কারচ্ছন্ন নির্দেশনাকে সঞ্চারিত করে; যে শিল্প পতিত রিপু কামোদ্রেককারী, মিথ্যা, অহংকার অভিমানে ভরপুর; জাতীয় বীরদের উচ্ছাসিত প্রশংসামূলক জয়গান করে মানুষকে সংকীর্ণ জাতিবোধে আবদ্ধ করে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে; সর্বোপরি এককেন্দ্রিক অন্ধ অনুরাগ প্রতিষ্ঠা করে বিলাসিতায় অনুপ্রাণিত করে- সে শিল্প সহিত্য অসৎ ও ক্ষতিকর। শান্তি নষ্টকারী এমন শিল্প প্রকাশ জনসাধারণ দ্বারা নিন্দিত ও ধিকৃত হবে! শিল্পকে শুধু অস্বাভাবিক চিন্তা ও জীবনচর্চায় অভ্যস্থ এলিটদের দাবী মিটালেই চলবে না, শিল্পকে বৃহৎ শ্রমজীবি জনগোষ্ঠীর দাবী মেটাতে হবে।
শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে তলস্টয়ের এ দর্শন আমাকে আন্দোলিত করে, আবেগে ভাসায়, প্রতিদিন নতুন নতুন স্বপ্ন দেখায়। শিল্প রাজ্যের মহারাজা লিও তলস্টয় আমার প্রেরণা!
তলস্টয় তার ভাবনাগুলো শুধু তার সাহিত্যে সীমাবন্ধ রাখেন নি, পুরোটাই প্রতিফলন করে ছিলেন নিজের জীবন চর্চায়। ইউরোপের বিবেক, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট উপন্যাসিক ও নীতিবাদি দার্শনিক তলস্টয় বিশ্বাস করতেন,
– শিল্পের বদনাম ও সীমাবন্ধতা শিল্পের নয়, শিল্পীর। শিল্পই তো শিল্পীর পরিচয়। শিল্প ও শিল্পীর জীবন যদি এক না হয়, তবে শিল্পীর জীবন ও সৃষ্টি দুটোই অস্বার্থক হয়ে যায়। যে শিল্পী, নিজের শিল্পাদার্শে- নিজের জীবনকে সাজায় না, সাজাতে পারে না, তা সাধারণ মানুষের জন্য অচল, ব্যর্থ!
তলস্টয় সাহিত্য ও জীবনকে অভিন্ন করে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। যা পৃথিবীর খুব কম শিল্পী-সাহিত্যিকের জীবনেই দেখা যায়। এই কারনেই তলস্টয় শিল্প রাজ্যের মহারাজা।
জমিদার পুত্র লিও তলস্টয় জন্মে ছিলেন ১৮২৮ সালের ২৮ শে আগষ্টে, রাশিয়ার তুলা প্রদেশে। তিনি ছিলেন জমিদার নিকোলাচ ইলিচ ও প্রিন্সেস মেরীর ভোলকোন সকির চতুর্থ সন্তান। রাশিয়ায় দাসপ্রথা বিদায়লগ্নে, আভিজাত্যের দুর্ভেদ্য দূর্গ ও মেহনতি মানুষের নিদারুন দুর্দশা মুখোমুখি দেখে দেখে বড় হয়েছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই তলস্টয় পাঠ্য পুস্তকের বাহিরে বিশাল জ্ঞানরাজ্যে বিচরণ করতে ভালোবাসতেন। দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটাতেন সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে। যা ছিল, নিজের অজান্তেই মহান লেখক ও মহামনিষী হওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি।
১৮৪৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একগুয়েমী পাঠে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছিলেন জন্মস্থান ইয়াসনায়া পোলিয়ানা গ্রামে। শুরু করেছিলেন খামারের কাজকর্ম ও ভূমিদাসদের দেখাশোনা। কিন্ত মানুষের উপর মানুষের প্রভূত্ব জাহির তিনি বেশী দিন করেন নি! ফিরে আসলেন মস্কোতে। অভিজাত বন্ধুদের সঙ্গ দোষে জড়িয়ে পড়েছিলেন উশৃঙ্খল ও অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে। তলস্টয় শান্ত-সুবোধ স্বভারে ছিলেন না, প্রচুর দেনা করেছিলেন, বিষয় সম্পত্তি নষ্ট করে ফ‚র্তি করেছিলেন। এমন উল্লাসময় জীবনযাপনের ক্ষণিক আনন্দে, প্রতিক্ষণ আতœদহনে ভোগতেন। আতœ সমালোচনা করে প্রতিদিন ডাইরী লিখতেন। এই ডাইরী লেখা থেকেই ১৮৪৭ সালে শুরু হয় তলস্টয়ে সাহিত্য যাত্রা।
ভোগের স্রোতে কচুরীপানার মত ভাসতে ভাসতে যখন তলস্টয় কোন কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না, তখন বুঝেছিলেন- এ পথ আসল পথ নয়। এই গভীর ভাবনায় ১৮৫১ সালে মস্কোর জীবনের ইতি টেনে ককেসাসে চলে আসলেন। স্বোচ্ছাসেবক হিসাবে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে যেতে লাগলেন সাহিত্য সাধনা।
১৯৫২ সালে নিজের ছেলেবেলার কাহিনি দিয়ে প্রকাশ করলেন প্রথম উপন্যাস ’শৈশব’। প্রথা বিরোধী এ উপন্যাসটি প্রকাশের সাথে সাথে চারদিকে সাড়া জাগিয়েছিল। এ উপন্যাসে বিশ্লেষন বিস্তৃত না হলেও, অন্তরঙ্গ অন্তদৃষ্টির অভিব্যক্তি ছিল। নবাগত তলস্টয়ের সৃজনশীল এ প্রকাশকে তৎকালীন অনেক বিখ্যাত লেখক প্রশংসা করেছিলেন।
সৈনিক জীবনের কর্তব্যপরায়নতা ও অসীম সাহসীকতার জন্য ১৮৫৪ সালে কমিশন পেয়ে ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অসহায় সৈনিকদের রক্তপাত, ধ্বংসের নগ্নতা, মিথ্যা দাম্ভিকতা তাকে আহত করতো। একসময় শান্তির কামনায় অস্থির হয়ে উঠেন। সৈনিক জীবনের চতুর্থ বছরে, ১৮৫৭ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেন। ১৮৬০ সালে শুরু করেছিলেন বিশ্বভ্রমন। বিশ্ব বৈচিত্র্যতা দেখে া আরো ভাবুক হয়ে উঠেছিলেন। পশ্চিমা বাস্তববাদীতা, ঐশ্বর্যময়তা ও অহংঙ্কারে ব্যথিত হয়ে- শুরু করছিলেন অন্যরকমের আধ্যাতিœকতা, যা কেবল মহামানবদের জীবনেই দেখা যায়।
নানান দেশ ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে আতœীয়তা গড়ার ব্যাকুলতা বোধ করছিলেন। অবশেষে কুলশতামুক্ত জীবনযাপনের জন্য আবার নিজের সবুজঘেরা গ্রামে চলে আসলেন। শুরু করলেন গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে স্থায়ী বাস! । লাভ করলেন জমিদার ও ভুমিদাসদের সাথে বিরোধ মিটানোর নব্যসৃষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদ। ভালোবেসে বিয়ে করলেন নিজের চেয়ে ষোলবছরে ছোট সোফিয়াকে।
দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিকে তলস্টয় প্রচন্ড সুখী ছিলেন । এ সময় তার পারিবারিক দর্শন ছিল, ’মানুষকে এমনভাবে বাঁচতে হবে, যাতে সে নিজের ও স্ত্রীর প্রতি বেশী কর্তব্য পালন করতে পারে।’ চৌদ্দ সন্তানের জনক তলস্টয় স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি প্রচন্ড অনুরাগী ছিলেন। তার এ জীবনদর্শনের অভিব্যক্তি ঘটেছে বিবাহিত জীবনের পরে লেখা কয়েকটি উপন্যাসে। জীবনের দুপুর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমি ও আভিজাত্যে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কলহে জড়িয়ে পরেন। সংসার জীবনে প্রচন্ড সুখী থেকে প্রচন্ড অসুখী হয়ে যান ।
তলস্টয় জমির মালিকানাতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন ’বায়ূ ও পানি’র মত, ’জমি ও মাটি’ প্রকৃতিক সম্পদ। বাতাস ও জলের মালিক যেমন মানুষ হতে পারে না, জমির মালিকও মানুষ হতে পারে না। মাটি, পানি ও জমিতে সবার সমান অধিকার আছে। এই প্রাকৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেই, শয়তান তার অনুসারীদের দ্বারা অধর্ম ও অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। মহাপাপে ভাসাচ্ছে সারা দুনিয়ার মানুষকে। জমি সংক্রান্ত এই দর্শনের পরিচয় তার অনেক লেখাতে পাওয়া যায়। ’পুনরুন্থান’ উপন্যাসে বিষয়টি স্পষ্ট।
তলস্টয় তার বিশাল জমিজমা ট্রাষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন বলে, স্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে ঘটা বিষাধময় বৈরীতা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কষ্ট দিয়েছে। স্ত্রী সোফিয়া ছিলেন বিলাসী, সম্পদ লোভী! তলস্টয় ছিলেন নীতিবাদি, যুক্তিবাদী, জমির মালিকানায় অবিশ্বাসী।
জীবনের শেষের দিকে তলস্টয়ে সঙ্গে স্ত্রী সঙ্গে সম্পর্ক কত করুণ ছিল, তার প্রমান পাওয়া যায় ১৮৮৪ সালে বোনের কাছে লেখা স্ত্রী সোফিয়ার এক চিঠিতে- একপাল ছেলেমেয়ে জন্ম দিয়ে, সে সুখ ও পরিবারের প্রতি কর্তব্য কোনটাই অনুভব করতে পারেনি! আমার প্রতি তার উৎসাহ ক্রমেই কমছে। আমি অপমান বোধ করছি। আমরা কখনো তর্কে লিপ্ত হই না। কেউ কারো কাছে অনুভূতি প্রকাশ করি না। সন্তানসহ এ বিরাট সংসার, এবং আমার গর্ভাবস্থার কারনে, আমি সত্যিই রোগ বা দূঘটনা কামনা করছি! যা আমাকে শান্তি দিবে। এ জীবন ছেড়ে চলে যেতে সহযোগীতা করবে।…
স্ত্রীর নিত্য অভিযোগ নিয়ে তলস্টয় তার ডাইরীতে লিখেছেন- কে সন্তানদের দেখাশোনা করবে? দয়া ও আস্থাহীন, দূর্বল ও অস্থির চিত্তের ঐ নারী? যে কোন কারণ ছাড়াই নিজেকে অবসাদ গ্রস্থ করে তুলেছে! সে নিজেও ভুগছে, আমাকেও ভুগাচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি প্রত্যক্ষ ভূমিকা না রেখে কি ভুল করেছি? আমি ভালো কিছুর জন্য প্রার্থনা করছি, কিন্তু বুঝতে পারছি আমি অসহায়!….
কল্পনাপ্রসূত অলংকারে সজ্জিত দুর্বোধ্য সাহিত্য রচনার পরিবর্তে- সাবলিল, বাস্তবধর্মী, অভিজ্ঞতালব্দ বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত শিল্প সৃষ্টিতে পারদর্শী ছিলেন তলস্টয়। তিনি রচনায় ব্যক্তিক ছাপ রেখে চরিত্র রুপায়ন করতেন। ভাবতেন প্রতিটি ঘটনা যেন নিজের সামনে ঘটছে। প্রতিটি সংলাপ যেন তার অন্তর থেকে বের হচ্ছে। এককথায় সাহিত্য চর্চাকে তিনি আরাধনা মনে করতেন। আলনিন, নিকলোডোভ, ইউজিন তার সৃষ্ট চরিত্র- ব্যক্তি তলস্টয় বলে পরিচিত।
তলস্টয়ের ’কসাক’ গল্পগুচ্ছ (১৮৫৪)- ভালমন্দের বোধহীন, যুক্তিবাদ ও নীতিবাদের উর্ধে, প্রকৃতি প্রভাবিত জীবনের জয়গান। অভিজাতদের ব্যর্থতা, হঠাৎ পক্ষ বদল, আদর্র্শহীনতা এবং বিবেকহীনতার প্রতি ব্যঙ্গ করে তিনি লিখেছিলেন, ’দুই হুসার’ (১৮৫৬), লুসিনি (১৮৫৭), তিনটি মৃত্যু (১৮৫৯) ইত্যাদি চমকপ্রদ ছোটগল্প। সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতায় লিখেছিলেন সিভাসটোপল (১৮৫৫) গল্পমালা। বিশ্লেষন করেছিলেন- সামরিক বাহিনীর মানুষদের ভয়, সাহসিকতা, উন্নাসিকতা ও প্রবৃত্তি। বিষয়টি সবচেয়ে সফল ব্যখ্যা করেছিলেন তার বিশ্বখ্যত সৃষ্টি ’ওয়ার এন্ড পিস’ (১৮৬০-৬৬) উপন্যাসে।
১৮৮০ সালের দিকে ’ওয়ার এন্ড পিস’ এবং ’আনা কারানিনা’ প্রকাশিত হবার পর থেকে তলস্টয় আধ্যাতিœকতা দিকে ঝুঁকে পড়েন। যা তার সাহিত্যকর্ম, দর্শন, সমাজ ও চেতনাতেও আধ্যাতিœকতা প্রাধান্য পেতে থাকে। তিনি প্রচলিত অন্ধ-গোড়া খ্রীষ্টবাদকে পাশ কেটে, সন্তের অবস্থানে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতেন এক অপরুপ স্বপ্নরাজ্যের। জয়গান করতেন নৈতিকতা আর মানবতাবাদের। তার ধার্মিক আচরণে আনন্দিত হয়ে চার্চ তাকে সম্বর্ধনা দিলে, তিনি অন্ধত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেন,
– আমি প্রচলিত অন্ধকারছন্ন খৃষ্টবাদে বিশ্বাসী নই! আমি কোন গীর্জার অর্ন্তভূক্ত নই!….
ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন বলে, তাকে খ্রিস্ট ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এসময় তিনি বলেছিলেন, যারা স্রষ্টা ও যীশুকে নিয়ে ব্যবসা করে তাদের চেয়ে আমি ভালো খ্রিস্টান । ধর্ম থেকে কুসংস্কার এবং অন্ধ-গোড়ামীকে বাদ দিলে যে বিশুদ্ধ মানবিকতা থাকে, তার প্রতি তলস্টয়ের পূর্ণ সমর্থন ছিল। এ নিয়ে তিনি নিজস্ব মতবাদ ’তলস্টয়িজম’ গড়ে তুলেছিলেন। যার সারমর্ম –
বিশুদ্ধ ধর্ম মানব কেন্দ্রিক। স্রষ্টা ও স্রষ্টার রাজ্যত্ব মানুষের মাঝেই নিহিত। মানুষের লক্ষ্য সুখ অর্জন করা। যা সৎকর্ম করে, লোভ-লালসা-হিংসা-ক্রোধ রিপু ত্যাগ করে পাওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র যুদ্ধ নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে মানুষকে কোন কাজে বাধ্য করানোও অপরাধ, পাপ! সমাজের বিত্তশালীরা নিজের স্বার্থে দুষিত ও কৃত্রিম সভ্যতা গড়ে তুলছে, মিথ্যা মুল্যবোধের সৃষ্টি করছে- যা থেকে মুক্তি আবশ্যক।
তলস্টয় শুধু মানুষকে মানুষের প্রতি হিংসা থেকে নিবৃত হবার কথা বলেননি। জীবহত্যা ও মাদকদ্রব্য বর্জনের কথাও বলেছেন। কারণ এসব মানুষের মানবীয় গুণাবলীকে কুলষিত করে।
স¦ার্থক সাহিত্যিকের পাশাপাশি তলস্টয় সমাজ সংস্কারক ছিলেন। ছিলেন খৃষ্ট ধর্মের মহৎ ব্যাখ্যাকারক। সাহিত্যিক ও দার্শনিক হিসাবে বিশ্বখ্যত হলেও সংগীত ও চিত্রকলাতেও পারদর্শী ছিলেন। রচনা করেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটক। তলস্টয় শিল্পকে শুধু মুষ্টিমেয় শিক্ষিতজন ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মাঝে সীমাবন্ধ রাখতে চাননি। ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে। রাজদরবারের রথি-মহারথি থেকে শুরু করে অতি সাধারন মানুষ সবার সাথে তিনি মিশতে পারতেন। কে কী বলবে তার ভয় না করে ন্যায্য কথা সবসময়ই বলতেন। সমাজের উন্নয়নের জন্য বাস্তবধর্মী প্রস্তাব রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন মহাতœাগান্ধীর মত জন রাস্কিনের অনুসারি। প্রচলিত ধর্মের পাশাপাশি প্রচলিত সাহিত্যের প্রতিও তার আস্থা ছিল না। তিনি বলেছিলেন,
– শিল্প সাহিত্যের স্বার্থকতা শিল্পীর অন্তরে উপলদ্ধ অনুভূতির সংক্রামনে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চারণে। যে শিল্প যত বেশী সংক্রামন করতে পারে, সে শিল্প ততবেশী স্বার্থক, জনপ্রিয়। কারণ শিল্পীর সৎ অনুভূতি মানুষের অন্তরকে সংক্রামন করবেই। অনুভূতি উচ্চস্তুরের হলে, মানবপ্রেম ও করুণা নির্ভর হলে, তবে তা উচ্চমান সম্পন্ন হতে বাধ্য।
তলস্টয়ের শিক্ষা দর্শন উচ্চ আদর্শবাদের কথা হলেও – নিজ দেশ রাশিয়ায় এর প্রভাব নগণ্য। তবে তার মতবাদ স্বদেশের সীমা পেরিয়ে- চীন, ভারতবর্ষ, ইউরোপ ও আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়েছিল। জীবনের শেষ পনর-বিশ বছর, তিনি ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ট বরনীয় মানুষ হিসাবে গণ্য হতেন। এ সময় তার জনপ্রিয়তা এত তুঙ্গে উঠেছিল যে- সারা দুনিয়া থেকে মানুষ তার জন্মস্থান ’ইয়াসনায়া পোলিয়ানা’ দেখতে যেত। তার গ্রামটি তীর্থে পরিনত হয়েছিল।
উল্লেখ্য ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতি বছরই তলস্টয় সাহিত্যে নোবেল; এবং ১৯০১, ১৯০২ এবং ১৯১০ শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত হয়েও- রহস্যজনক কারণে পুরুস্কার পাননি। তার নোবেল না পাওয়ার ঘটনাটি, মহাতœ গান্ধীর নোবেল না পাওয়ার মতোই বিতর্কের কারণ আজো।
তলস্টয় খৃষ্টধর্মের অবাদ বিচরনকে অতিরিক্ত বারাবারি বলে সমালোচনা করতেন। প্রথম থেকেই চার্চ সমর্থিত রুশ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈরীতা ছিল। তবে তলস্টয়ের অতি জনপ্রিয়তার কারণে, শাসকরা তাকে কোন শাস্তি দিতে সাহস পেতেন না। হিংসার এড়ানোর জন্য, রক্ষনশীলতা ও রোমানফ বংশ বিরোধী কিছু বক্তব্য ও সাহিত্য দেশের বাহির থেকে প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি তার বিখ্যাত রচনা ’শিল্প কি’ গ্রন্থটিও। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বৈরীতার কারণে, তলস্টয়ের কোন শাস্তি না হলেও- তার মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে সৈনিক বিভাগে কাজ না করার কারণে অনেক কে জনবিচ্ছিন্ন সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।
তলস্টয় ধর্মের কথা বললেও, ধর্মের নামে অধর্ম চর্চাকে সচেতন ভাবে বর্জন করেছেন। ফলে তার সাহিত্য হয়ে উঠেছিল সুন্দর, গভীর, মানবিক, অপূর্ব ও স্বার্থক। তার এই গুণের কারনেই তিনি আজ মহামতি, মনিষী ।
১৮৮৪ সালের পরে প্রতিটি রচনায় তলস্টয়ের এ চেতনা প্রতিটি সাহিত্যকর্মে সফলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্য জীবনের শেষ পর্যায়ে তলস্টয় সমাজ সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে, নিজের সম্পর্কে অর্জিত অভিজ্ঞতার রুপায়নে আরো বেশী সর্তক, আরো বেশী সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। যার প্রমান পাওয়া যায় ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ’ক্রেয়োটজার সোনাটা’, ও মৃত্যুর পর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ’ইবলিস’ গল্পে। তিনি ’ইবলিস’ গল্পে নিজের জীবনে মধ্যবয়সে ঘটা যৌন অভিজ্ঞতা সাহসের সাথে বলেছেন। ’অন্ধকারের শক্তি’ (১৮৮৯) ও ’নির্বানের ফল’ নাটকে তিনি কৃষক জীবনের বাস্তবচিত্র ও সামাজিক উন্মত্তকে ব্যঙ্গ করেছেন।
কর্মোদ্যম তলস্টয়ের শেষ জীবনে একা ও নিসঙ্গে কেটেছে। ছোট মেয়ে আলেকজেন্দ্রা ছাড়া সংসারের কেউ তার আদর্শ জীবন সমর্থন করে নি। তিনি যখন সম্পতি সমাজকল্যানে ট্রাষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন, স্ত্রী সোফিয়ার নেতৃত্বে মানসিক অত্যাচার অসহনী ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অবশেষে তিনি স্ত্রী’র কাছে আতœসমর্পন করেছিলেন। সাহিত্যের কপিরাইট সহ সমস্ত সম্পতি স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বসবাস শুরু করেছিলেন এক নির্জন খামার বাড়িতে। যেখানে তিনি সাধারণ কৃষকের পোষাক পড়তেন, নিরামিষ খেতেন, কায়িক পরিশ্রম করতেন। এ সময় তিনি হয়ে উঠেন পুরোপুরি অহিংসবাদী। গড়ে তুলেছিলেন – মহাতœগান্ধীর সঙ্গে পত্রযোগাযোগ। এই যোগাযোগ এতই গভীর ছিল যে, গান্ধীজী তার অফ্রিকা আশ্রমের নাম দিয়েছিলেন- ’ তলস্টয় ফার্ম’।
সংসার ত্যাগ করে তলস্টয়ের একা খামার বাড়িতে জীবনযাপন স্ত্রী সোফিয়া সহজভাবে নেননি। এসময় তার আচরণ রুঢ় থেকে রুঢ়তর হয়েছিল। অনুসারি ’কায়াজটকভ’এর সঙ্গে তলস্টয়ের দ্ব›দ্ব শুরু হলে, তিনি প্রতিকূল পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্য ব্যকুল হয়ে উঠছিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- নিরুদ্দেশে গৃহত্যাগের।
১৯১০ সালের ২৮ শে অক্টোবর রাত্রিতে সারা বাড়ি যখন আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ও ঐশ্বর্যের ঠমকে মত্ত, তখন নীড়হারা আহত পাখীর মত উ™£ান্ত হয়ে, অজানা পথে পা রাখলেন। তুষার পড়া ঠান্ডায় পথে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শয্যাশায়ী হলেন ষ্টেশন মাষ্টারের এক ঘরে। চারদিকে অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লো, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হলো, কিন্ত শেষ রক্ষা হলো না। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ১৯১০ সালের ৭ই নম্ভেবরে, ৮২ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন – শিল্পরাজ্যের মহারাজা , বিশ্ব সাহিত্যের মধ্যমণি লিও তলস্টয়।
খৃষ্টধর্ম থেকে বিতারিত, বিপুল জনপ্রিয় তলস্টয়ের সৎকারের জন্য শোক অনুষ্ঠানে পাদ্রীরা ভিড় করেছিল, কিন্তু জনগন কাউকেই তার লাশের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি! শেষে দেশ ও বিদেশের হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ পরম ভালোবাসায় শবযাত্রায় শামিল হয়ে, নিজ জন্মস্থানে ইয়া¯øায়া পলিয়ানা গ্রামে, কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই সমাহিত করে।
তথ্য সূত্র:
১) শিল্পের সরূপ/ তলস্টয় – অনুবাদ দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ। ২) ভলতেয়ার-ফুবেয়ার-তলস্টয়: ত্রয়ী উপন্যাস ও যুগমানস/ হোসেন উদ্দিন হোসেন, বাংলা একাডেমী। ৩) বিশ্বের শ্রেষ্ট গল্প : দেব সাহিত্য কুটির। ৪) তলস্টয় ও দস্তয়ভস্কি : পারিবারিক জীবনের তুলনামূলক চিত্র: আসিফ রশীদ। ৫) লেভ তলস্টয়: সাধ-জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি, মুক্তধারা। ৬) দ্যা ডিভেল: অনুবাদ ’শয়তান’, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র।