পারফেকশন ও ইমপারফেকশন, কুয়ালিটির কুতুকুতু যে একটা রোগ- তা যদি কেউ, যে কোন বিষয়ে জাপানিদের সাথে একদিন একটি কাজ করে তা, সহজে বুঝে যাবেন। জাপানিদের এই রোগ সুচিবাই রোগের চেয়েও মহাভয়াবহ!
রোজগারের বিকল্পপথ থাকলে নিশ্চত বলবেন- ছাইড়ে দেয় মা, কাইন্দা বাঁচি। মনেহয় এই কারণেই জাপানিদের সঙ্গে প্রবাসীদের গালায় গলায় ভাব নাই। বাঙালিরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নিজস্ব কমিউনিটি ও ফাপড়বাজির স্টাইল গড়ে তুলেছে।
সব জাপানিরা সাধারনত ক্ষুরধার নিঁখুত ভাবে কাজ করে, নইলে টাকা নাই, শান্তি নাই! আর বাঙালিদের বেলায় ঠিক উল্টোটা- হেলাফেলা, ইয়ার্কিঠাট্টা, কিন্তু লাভের বেলায়, বেতনের ষোলআনা। বিষয়টা নিজের ও নিজের জাতির দূর্বলতা, যা স্বীকার করতে আমার কষ্ট ও দ্বিধা নেই । আমি মনেকরি , যদি বাঙালি তাদের দূর্বলতাটা বুঝে ও পরির্বতনে সিরায়াস হয়, তবে দ্রুত আরো সফলতা পাবে।
আমি আউট সোসিং এর লোক। গত ২০০১ সাল থেকে মাল্টিমিডিয়া, গ্রাফিক্স ও ভিডিও’র ভিনদেশী কাজ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পেট চালাই। সহজে কাজ ও টাকা পাওয়া যায় বলে, সবার মত আউট সোর্সিং আমার বেশ পছন্দ।
গত ১০-১৫ বছর ধরে ভারত-ফাকিস্তানের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আইটি’র আউট সোর্সিং বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে আছে। ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান কাজের বন্যা বাংলাদেশে থাকলেও, জাপানি কাজ তেমন নেই। আমি অনেক চেষ্টা করেও, জাপানি কাজ বাংলাদেশে তেমন নিতে পারি নাই। কারণটা জাপানিদের পারফেকশন আর আমাদের ইমপারপেকশনের সাথে যুক্ত।
আমি আমার একাধিক জাপানি ক্লাইন্টকে জিজ্ঞাসা করেছি,
– জাপানে কাজ না করিয়ে , বাংলাদেশে ও ভারতে শাখা খুলে কাজ করালে তো অনেক কম দামে কাজ করাতে পারে, করাও না কেন?
তারা বলে,
– তোমার ধারণা ভুল । আমি জাপানে কাজ করালে কম দাম পড়ে।
– কি বল? বুঝলাম না বুঝাইয়া কও।
– ভাষা, সংস্কৃতি ও পারফেকশন কুয়ালিটি একটা মেজর বিষয়! জাপানের যে কোন কোম্পানী বা ব্যক্তিকে দিয়ে যদি সফটওয়ার, ভিডিও বা ওয়েব সাইট বানাই, তবে একবার-দুইবার দেখিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু ইন্ডিয়া বা বাংলাদেশে করালে ১০বার বুঝিয়ে বলেও, ঠিক কুয়ালিটিটা পাওয়া যায় না । সময় ও বাড়তি কাজে হিসাবে করলে, দাম অনেক বেশী পড়ে। টাইম ইস মানি।
– তাই নাকি?
– হ, ঝগড়া, মনকষির ঝামেলাও কম হয়। তোমরা বাংলাদেশীরা তো একটু ভালো। ইন্ডিয়ান আউট সোসিংএর লোকজন তো, অল্প টাকায় কাজ নেয়ার পর, আধাকাজ করে বলে, এটা অনেক টাকার কাজ, বড় কাজ, বাড়তি বাজেট না করলে, কাজটা করতে পারবো না। ঝুলাইয়া রাখে। যা জাপানিদের কাছে অসহ্য, বাটপারি। আর ফাঁকিস্তানিরা তো কিছু কাজ করে, অর্ধেক টাকা নিয়ে ফুট দেয়, আর যোগাযোগ রাখে না।
শুধু বাংলাদেশ না, সবোপরি- পৃথিবীর সব দেশেই, পারফেক্ট তো দূরের কথা- এমন মানুষ অনেক আছে, যারা বেসিক বিষয়ে দক্ষ ও পারফেক্ট না। অন্যের সুবিধা ও অসুবিধা বুঝে না।
বাংলাদেশীদের বেলায়- এটা ঘটে আধুনিক স্কুল-কলেজ ও পরিবারগুলোর অমনযোগীতার কারণে, লোভ কারণে! চাকুরী, মানে টাকা কেন্দ্রিক শিক্ষায় অতিমনেযোগীতার বলে। আত্নকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার প্রবল প্রতাপের কারণে।
আসলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দক্ষ, সুখী ও সুন্দরভাবে সততার সাথে জীবন যাপন। ফুটাঙ্গি দেখানো না, দক্ষতা ও মর্যাদায় বৈষম্য তৈরী না। এ ব্যাপারে জাপান অনেক এগিয়ে। জাপানিরা এত এগিয়ে, পারফেকশনে এত কড়া, আত্নকেন্দ্রিক- বেসিক বিষয়েও কম্পোমাইজ ও হারমোনাইজ করতে চায় না! ফলে পারফেকশের নামে যত্রতত্র অত্যাচার চলে। অযথা জটিলতা করে , যা আমার কাছে মানসিক রোগ মনেহয়। ফলে জাপানিরা গ্লোবাল বিজনিজ আনন্দের সাথে, লাভের সাথে করতে পারে না। দৃশ্যত চাইনিজদের কাছে ফেল করেছে।
জাপানে কাজের চাপ ও পারফেকশনের নিয়ে ‘কোম্পানী বস’ দের বাড়াবাড়ির কারণে অনেক আত্নহত্যাও ঘটে। আর বাঙালির বেলায় ঘটে- ছলছাতড়ি, ঠাট্টামশকরা করে সিরিয়াসনেসকে তেল দিয়ে গলানোর তদবীল। বাস্তবতা জটিল হয়ে গেলে, বাঙালী পালায়। রাগে, দুঃখে কষ্টে বলে – “দরকার নাই, দরকার নাই..”
উল্লেখ্য ২০০৭ সালে একবার সিরাজগঞ্জে, একদল জাপানি ও কোরিয়ান ডাক্তার টিমের সঙ্গে একটি চক্ষু শিরিরে গিয়েছিলাম। বাঙালি জোয়ান ডাক্তার, রোগীদের চিকিৎসা রেখে কোরিয়ান সুন্দরী নার্সের লগে টাঙ্কি মারছিল । ছবি তোলা ও এটাসেটা নেয়ার নামে, মাইয়ার গায়ে হাত দিয়ে, ফূর্তি করার চেষ্টা করছিল। রিরক্ত হয়ে জাপানি টিমলিডার মিষ্টার শিরাসি আমাকে বলেন,
– তোমাদের ডাক্তারটাকে থামতে বল, কাজে মন দিতে বল। খুব ফাইজলামি করছে।
আমি ডাক্তারকে একপাশে ডেকে নিয়ে কানে কানে বললাম,
– ভাই, দেশের মানসম্মান খায়েন না। লাগাইতে মন চায়, জায়গা মত লাগায়েন, এখানে না!
– চেতেন কেন, ইয়ার্কি করতাছি!
– গায়ে হাত দেন কেন?
– ভাই, সিরিয়াস হয়েন না! বউ নাই, বয়স হইছে, চান্স নিতাছি। মালটা ভালা আছে। একটু লাইন করাইয়া দেন।
অতি পারফেকন যেমন ভালো না, বেশী হেলাফেলাও ভালো না। জাপানি ও বাংলাদেশী দুই ধরণের পারফেকশনের লগে কাজের আমার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা।
গত মাসে একটি জাপানি ওয়েবসাইট কাজ শেষ করেছি। ১৫ দিনের কাজ, শেষ করতে লাগলো ৭ মাস। কানে ধরে বলেছি,
– আল্লাহ এমন জাপানির পাল্লায় আর ফেলিও না।এদের টাকা পাওয়া যেন মোহর পাওয়া।
আর বাংলাদেশ, গত দুই বছরে টাকা দিয়েও সময়মত সঠিক ভাবে বই প্রকাশ করতে বহুত ঝামেলা পোহাইয়েছি। লেখালেখা স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। বই লিখতে লেগেছে ৩ মাস, আর প্রকাশ করতে লাগলো ২+ বছর। ৪টা প্রকাশনীর লগোতে তেল দেয়ার পর, এবার তিন বইয়ের মাঝে ২টা বইমেলায় আসবে।