‘হিমালয়ের উন্থান’ প্রাচীন কালের আমার একটি লেখা, জাপানি যৌতুক ও ভালোবাসার পাহাড়।
১৯৯৭ সাল, যে যুগে আমার ল্যাপটপ ও আইফোন ছিল না, সে যুগের আমার একটি লেখা- ‘হিমালয়ের উন্থান’। পুরাতন পান্ডুলিপি’র গাট্টিতে আজ পেপার কাটিংটি খুঁজে পেলাম।
লেখাটি ছাপা হয়েছিল মুক্তকষ্ঠে , ১৯৯৭, ১৫ সেপ্টেম্বর। তখনো আমার প্রাণে বিশ্বাস ছিল, আমি লেখক হতে পারবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষে, ভূবিজ্ঞান পড়েও বিজ্ঞানী হতে মন চায়নি। কেরিয়ারিষ্ট না হয়ে, গান্ধীজি-ফুকুওকা’র মত অলটারনেটিভ হওয়ার দারুণ সাহস দেখিয়েছিলাম। টানা পাঁচ বছর লেখালেখির চেষ্টা করেও যখন দেখলাম – ৫০০০ হাজার টাকাও রোজগার হয়নি। চাকুরি-বাকরির খবর নাই । তখন বুঝলাম এপথে আর থাকা যাবে না। আব্বা-আম্মার চরম বকাবকিতে লেখালেখি ছাড়লাম, কাগজ-কলম ছেড়ে মাউস-প্যাড ধরলাম, মাল্টিমিডিয়া ডিজাইনে মন দিলাম, বিয়ে করার চিন্তা শুরু করলাম। ভাবতে শিখলাম,
– ‘সংসার ধর্ম, পরম ধর্ম’! জীবন- সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আর ভালোবাসায় ভর্তি। এবার সংসার শুরু করতেই হবে।
কিন্তু ইত্যিমধ্যে সাত বছর পার হযে গেছে। পরিচিত সব সুন্দরীর বিয়ে হয়ে গেছে। জুনিয়র যারা খালি ছিল, তারাও চিনেও না চেনা, না চেনার ভান করতো। পরে কারণটা বুঝলাম,
কারণটা অনেকাংশে অর্থনৈতিক। গায়ের বঙ্গবাজারের কমদামের টিশার্ট’, চোখে সানগ্লাস নাই, হেঁটে গেলে সুগন্ধির ভুরভুরি না ঝরা, তাই হয়তো কেউ রাজি হয়নি। আগ্রহ দেখায় নি, এমনকি গররাজিও না।
সবচেয়ে বড় কষ্ট – একটি রিজিওনাল এনজিওতে জান-কোরবান ভলেন্টিয়ার ছিলাম। শত শত সুন্দরীর আনাগোনা ছিল সেখানে। নিয়মিত রুমান্টিক গল্প শুনতাম, উল্লাসিত ও উত্তেজিত হতাম। সবাই আমার চরিত্র সততা, কাজে দক্ষতা ও একাগ্রতার প্রশংসা করতো – কিন্তু একজন বাঙালী নারীও বলেনি – আই লাভ ইউ।
বাংলার নারীদের পছন্দ শেষমেষ বুঝেছিলাম। ভালো ছাত্র ও ভালো চরিত্রে অধিকারী হলেই যে ভালো বাঙালি বউ পাওয়া যায় না – তার প্রমান আমি। ১৬বছর শিক্ষা জীবনে ৯বার ক্লাসে প্রথম হয়েছি, চেহেরা হিরোদের মত না হলেও খারাপ না, জীবনে কোন চুরি-ডাকাতি, গুন্ডমি-বদমাইশি করি নাই, সে দিকে কোন বাঙালি সুন্দরী চোখ যায়নি, চোখ গিয়েছে আমার নিলামী শার্টের পকেটের দিকে।
স্বেচ্ছায় দারিদ্রতা প্রহন মহামতি-মানবদের জীবনে গ্রহনীয় হলেও, সাধারণ জীবনে নয়। মহামতি ষ্টাইলে জীবন-যাপন-দর্শন থাকার পরও, বাঙালি নারীদের প্রফেশন্যাল ভালোবাসার বলয়ে ঢুকতে না পারার এত ভালোবাসা হীনতা, এত ব্যর্থতা, এত অবহেলাতেও আমার মন খারাপ হয়নি। দিন দিন বিয়ে ও সংসার নিয়ে আমার ধারণা পাল্টাতে শুরু করলো – বিয়েশাদী যত না রুমান্টিক ভালোবাসা, তার চেয়ে বেশী অর্থনৈতিক।
আল্লাহ’র কি লীলা। যখন বাঙালি ললনারা বেরাজি, তখন দূরপ্রাচ্য থেকে জাপানি সুন্দরী আমার লাগি ঢাকায় হাজির। অল্প কয়েকদিন একলগে খিচুরী খেয়েই বিনা যৌতুকে বিয়ে করে ফেললাম। জীবনে প্রেম আসার সাথে সাথে আমার লেখালেখির প্রেমও চলে গেল, মাল্টিমিডিয়া প্রফেশন্যাল হওয়া দরজা খুলে গেল, রোজগার শুরু হলো ।
আমি বরাবরি লোভ ও যৌতুক বিরোধী। তারপরও বাঙালির স্বভাব মত গোপনে ভেবেছিলাম- জাপানি বিয়ে করলাম। বিরাট ধনী দেশের মানুষ। এবার সাত বছরের বেকার জীবনের রোজগারের উসলটা মিটে যাবে। এক লাফে বিলিয়নিয়ার হযে যাবো। তার আর হলো না !
– অভাবা যে দিকে তাকায়, সেদিকে সাগরও শুকায়।
সবেমাত্র বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন করছি, কমদানের রেস্টুরেন্টে নতুন বউকে নিয়ে তেহারি-বিরানী খাই। একদিন সুন্দরী বলে,
– আপনার তো এখন টাকা নেই। এক বছর আমি জাপানে কাজ করতে চাই। রোজগারের পর সংসার শুরু করবো। কি বলেন?
আমি নীমরাজি হয়ে বললাম – ঠিক আছে, যা ভালো তাই করেন, আমার ভিন্নমত নাই।
নতুন বউ জাপানে চলে আসলো। বউয়ের অনুপস্থিতিতে মোহাম্মদপুরে মেছের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম। বউ আমার জাপানে কাজ করেছে। বেতন মাসে অন্ততঃ দুই-তিন লাখ তো হবেই । এবার আমার বিলিয়ন হওয়া পথ কেউ আটকাতে পারবে না। এক বছর পর, ঢাকায় স্থায়ীভাবে যাওয়ার আগে বউ আমার জিজ্ঞাসা করে,
– আপনার জন্য জাপান থেকে কি আনবো?
যৌতুক হতে পারে, তাই আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। বললাম,
– আমার জন্য কিছু লাগবো না। আপনি চলে আসেন। আমার তো এখন দৃকে চাকুরি আছে। বেতন কম হলেও, খারাপ না, চলা যাবে।
দৃকে যোগদানের পরের থেকেই ফটো্গ্রাফার হবার- আমার ‘সুপ্ত ভাবনা’টা জাগ্রত হয়েছিল। কিন্তু প্রফেশন্যাল ক্যামেরা কিনা সামর্থ্য ছিল না। তাই কাউকে নিজের স্বপ্নের কথা বলতাম না। বলতাম – আমার কাজের এরিয়া মাল্টিমিডিয়া ডিজাইন, এই লাইনেই থাকতে চাই।
প্রায়শঃ মনে মনে ভাবতাম, জাপান থেকে বউ যদি একটা ক্যামেরা আর ল্যাপটপ আনতো ভালোই হতো।
একবছর পর- বিমান বন্দরে বউকে রিসিভ করার সময়, অনেকগুলো ব্যাগ থেকে একটা সুন্দর ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে বলে,
– এটা আপনার জন্য। এখানে একটি ডিজিট্যাল ক্যামেরা আছে – সনি সিডিক্যাম, আর একটি হিটাচি ল্যাপটপ ।
কথাটা শুনে, আমি যেন ভালোবাসার চাঁদ হাতে পেয়েছিলাম। মনে আমার আনন্দ যেন আর ধরেনি। নতুন বউয়ের চেয়ে , ব্যাগটাকে আপন ও কাছে মনে হচ্ছিলো।
বউ আসার পর কিছুদিন আনন্দে কাটলো দুইমাস যাওয়র পরও জাপানি কোন টাকা দেয় না, টাকার কথাও বলে না। শরম কেটে যাওয়র পর বললাম,
– কত টাকা এনেছেন?
– কিসের টাকা?
– সংসার চালানো টাকা আনেন নাই?
– না, আপনার ক্যামেরা, ল্যাপটপ, আত্নীয়দের উপহার, বিমানের টিকেট আর কিছু বই-পত্র কিনেতেই সব শেষ হয়ে গেছে।
বিস্মিত হয়ে বললাম
– বলেন কি, তাই নাকি? তাহলে এখন কিভাবে সংসার চলাবেন? আপনি জাপানি মানুষ, আমার অল্প বেতনে কি আপনাকে লালন-পালন করতে পাররো? কম দামের বাসায় তো থাকা যাবে না, সিকিওরিটি ব্যাপার আছে না?
বউ অবাক করে বলে,
– কম দামের বাসায় আমি থাকতে পারবো , পারবেন না কেন? বাংলাদেশের সবাই থাকতে পারলে আপনিও পারবেন।
– আপনি তো বাঙালি বউ না। জাপানি, যেখানে সেখানে কি রাখা যাবে?
– আরে না, কেউ জিজ্ঞালে বলবো, আমি জাপানি না, চাকমা। দেখতে তো একই রকম।
– সবই বুঝলাম, তাহলে একটা বছর সেপারেট থেকে লাভটা কি হইলো?
– সারাজীবন টিকবেন কিনা একটু টেষ্ট করলাম। জাপানে যাওয়ার লোভে, ইয়েন পাওয়া লোভে বিয়ে করেছেন কিনা, টেষ্ট করলাম
– কি বুঝলেন?
– আপনি পাশ, ফাস্ট ক্লাস ফাষ্ট! লোভ নাই।
এ বলে কাছে আসে, রুমান্টিক হাসিতে হাসে।
যেমন কথা তেমন কাজ। ঠিক তাই হলো দশ বছর জাপানি – বাঙালি হয়ে, চাকমা নারীদের লুঙ্গি পড়ে ঢাকায় কাটিয়ে দিল।
আমিও মন থেকে মুছে ফেলেছিলাম – আমার বউ জাপানি। বাঙালি যুগলদের মত -দু’জনে বাংলা কথা বলতাম, হাত দিয়ে ঝাল ভাত খেতাম। যখন তখন মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারে যাওয়ার ছলে রিক্সপ্রেম করতাম। বাজারের সব দোকানদার আমাদের চিনতো। রিক্সা থেকে নামার সাথে সাথে সবজিওয়ালা, মুরগীওয়ালা ডাকাডাকি শুরু করে দিতে।
– মামা মামাী আর আমার এখান থেকে জিনিষ নিবেন।
এভাবেই শুরু হয়েছিল আমার জীবনোপন্যাসের নতুন পর্ব।
—
সাদো, জাপান
১৮ই আগষ্ঠ, ২০২২