স্বর্ণদ্বীপে ফলেনমাস্ক , অন‍্যরকম গল্প

অবকাশ কাটাতে স্বর্ণদ্বীপে বিলিয়নিয়ার ফলেনমাস্ক আসলো। সঙ্গে কেউ নেই, একা। পুরো শান্তি ও স্বস্থি তার দরকার, তাই সঙ্গে কাউকে আনেনি। এসেই সে একা পুরো দ্বীপ একা হেটেছে। দেখে হতবাক হয়েছে স্বর্ণদ্বীপের সব মানুষ দ্বীর্ঘজীবি, সুখী। পৃথিবীর সব মানুষ যেখানে বেশীদিন বাঁচার জন‍্য দিনগুনে, এখানে মানুষ মরার জন‍্য দিনগুনে। মানুষ সহজে মরে না, বয়সের টানে পিতাপুত্রের চামড়ার ভাঁজ যেন একই রকমের।কুকড়ানো। কে পুত্র, কে পিতা বুঝার উপায় নেই।

সৈকতের পাশে টুরিস্টস্পটে রাখা বেঞ্চিতে বসে আম্রিকান দামি দামি এটাসেটা খাচ্ছে ফলেনমাস্ক। দ্বীপের আদি ষ্টাইলের প্রাকৃতিক খাবারে তার আস্থা নেই। জীবাণুর ভয়ে সব সময় তঠস্থ থাকে। দ্বীপের পানি পর্যন্ত সে পান করে না। কোন কিছু খেতে বাধ‍্য হলে তিনবার চেখে নেয়।

একটু দূরে আরেক বেঞ্চিতে বসে এক বৃদ্ধ মনের আনন্দে বাঁশি বাজাচ্ছিল। নাম তার সুখরাজ। স্বর্গীয় বাঁশীর সুরের মুর্ছনায় আবেশিত হয়ে, সুরের টানে সকল অহংকার ত‍্যাগ করে মাস্ক বৃদ্ধ বংশীবাদকের কাছে যেতে বাধ‍্য হয়। কাছে যাওয়ার সাথে সাথে বৃদ্ধের বংশীধ‍্যান ভেঙ্গে যায়। মাস্ক বৃদ্ধকে বলে,
– আপনার বাঁশির সুর অপূর্ব। আমি কি আপনার বেঞ্চিতে একটু বসতে পারি।
– বসেন।
– ধন‍্যবাদ। কতক্ষন নীরব থাকার পর, এদিক ওদিক তাকিয়ে মাস্ক হেভারসেক থেকে চিপসের প‍্যাকেট বের করে। বলে,
– চিপস খাবেন? আরেকটা প‍্যাকেট আছে। আম্রিকান ‘করমরে’, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি চিপস। বৃদ্ধ বলে,
– ধন‍্যবাদ। আমি আম্রিকান আর চাইনিজ খাবার খাই না। ব‍্যবসার জন‍্য চাইনিজ আর মার্কিনীরা খাবারে ক‍্যামিকেল মেশায়, কারসাজি করে। এদের যে কোন খাবার খেলেই আমার পেটের অসুখ হয।
– তাই নাকি?
– জি, তয় আপনি কে?
– আমাকে চিনেন না? সবাই আমাকে চিনে। আমি চাঁদে ও মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসত বানানোর প্রকল্পের উদ‍্যোক্তা, নাম মাস্ক।
– তাই নাকি? বেশ অদ্ভত কাজ তো? তয় খামিসামা এত সুন্দর একটা গ্রহ দিলেন, আপনি হঠাৎ করে অন‍্যগ্রহে যাওয়ার চিন্তা করছেন কেন?
– এই গ্রহটা তো অনেক ছোট? পরিবেশ, জলবায়ূ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অল্পদিনের মাঝেই এটা মানুষের পূর্ণ হয়ে যাবে। বাসের অযোগ‍্য হয়ে যাবে।
– আপনার ধারনাও ভুল। পূর্ণ হবে না। আপনি কি জানেন না রাশিয়া, চায়না, ব্রাজিল, কানাডা এমনকি আপনার দেশ আম্রিকার কত বড়? এসব দেশের তিনভাগের দুই ভাগ এখনো খালি। পান্তানাল ও আমাজন সহ পৃথিবীর অনেক জায়গায় বার্জিনল‍্যান্ড আছে যেখানে গত ৪.৫ বিলিয়ন বছরেও একবারের জন‍্য মানুষের পদচিহৃ পড়েনি। যে হারে মানুষ বাড়ছে, সেভাবে জন্মহার থাকলেও আরো অন্তত ১ লাখ বছরেও পৃথিবীর ঘনবসতি টোকিও মত ঘন হবে না।

বৃদ্ধ অতানাবের কথা শুনে মাস্ক হতবাক হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, “বৃদ্ধকে তো দেখে অশিক্ষিত মনে হয়েছিল, উনি তো দেখছি শিক্ষিত। সন্তের মত কথা বলে। অনেক কিছু জানে মনে হয়।” ভাবনা ভেঙ্গে মাস্ক বলে,

– আপনি তো দেখছি অনেক তথ‍্য জানেন। গভীরভাবে ভাবেন। তয় এসব কোথায় থেকে জানলেন? ইন্টারনেট থেকে বুঝি? আমি ইন্টারনেট নিয়েও কাজ করি, নিয়মিত মহাশূন‍্যে স‍্যাটেলাইট পাঠাই। ইন্টারনেটের গতি যাতে আরো বাড়ে, তথ‍্যভান্ডার যেন আরো সমৃদ্ধ ও নিরাপদ হয় এরজন‍্য স্পেসস্টেশন বানিয়েছি, দিনরাত কাজ করি।
– ইন্টারনেট, সেটা আবার কি?
– ওরে বাবা, ইন্টারনেট কি আপনি বুঝেন না? আপনি কি এই যুগের মানুষ? তাহলে শিখেন কিভাবে? যোগাযোগ করেন কিভাবে?
– বই পড়ে, টিভি দেখে শিখি। প্রকৃতি থেকে, বন্ধুদের সাথে আলাপ করে শিখে? আমার একটি সুন্দর ল‍্যান্ডফোন আছে, ৪৭ বছর বয়স, এখনো সুন্দর কাজ করে।

এমন সময় ফলেনমাস্কের দামী কেচলা ফোনটা বেজে উঠে। নম্বর চেক করে বলে, একটা জরুরীফোন বউযের কাছ থেকে এসেছে, একটু অপেক্ষা করুন।

ফোনে চলতি ইংরেজীতে কথা বলার পর থেকে মাস্ক আগের মত প্রাণবন্ত নেই।গুছিয়ে কথা বলতে পারছে না। সব কিছু যেন ভেঙ্গে পড়ছে। বারবার দ্রুত নিজেকে তুলে ধরে রাখার সবচেষ্টা করছে। কেমন যেন মনমরা, আনমনা, অস্থির । বৃদ্ধ বলে,
– অশান্ত হয়ে গেলেন কেন?
– দুঃখের খবর, আমার ৪০টি স‍্যাটেলাইটকে সৌরঝড় গ্রাস করেছে। অনেক ক্ষতি হয়ে গেল বুঝি।
– কত ক্ষতি হবে?
– অনেক, আনুমানিক এই দ্বীপের মত ১০টা দ্বীপ কেনা যাবে!
– তাই নাকি? অনেক টাকার ব‍্যাপার সেপার।
– জি
– তয় ৪০টি স‍্যাটেলাইটের দাম কি আপনার প্রাণের চেয়েও বেশী দামি?

বৃদ্ধের কথা শুনে মাস্ক চমকে যায়, সচেতনতা জেগে উঠে। প্রাণের চেয়ে দামী জিনিষ তো দুনিয়াতে নেই। এই ভাবনায় মাস্কু পুরো নীরব হয়ে যায়, যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে। কোন উত্তর না নিয়ে ফলেনমাস্ক বলে,

– ব‍্যবসার কথা বাদ দেন। আজ ক্ষতি হয়েছে, কাল লাভ হবে, লাভ-লোকসান দুইয়ে মিলেই তো ব‍্যবসা। বড় বড় স্বপ্ন আর ব‍্যবসার ভারের ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, একটু শান্তির জন‍্য স্বর্ণদ্বীপে এসেছি। শান্তি আমার চাই ই।

– ভালো। ধন‍্যবাদ। এই দ্বীপটা আসলেই সুন্দর, শান্তির নীড়। চাইলে এখানে আপনি আমার মত শান্তি ভোগ করতে পারেন। শর্ত শুধু প্রকৃতিকে মেনে নেয়া, গ্রহন করা। এই দ্বীপের সবকিছুই আমার কাছে স্বর্গের মত মনেহয়। কোন কিছুতেই ভুল ধরতে পারি না। সব কিছুই যেন মনেহয়, যেমনটা দরকার তেমন করেই সাজানো।
– ঠিক বলেছেন। পারফেকশনের সাথেই প্রকৃতি সব সাজায়। ভারসাম‍্যতাই প্রকৃতির ধর্ম।
– প্রকৃতি বলেন কেন? স্রষ্টা বললে আরো সঠিক হবে, সবকিছুকে আরো কাছে পাবেন, জীবন্ত মনে হবে, একতা বোধ করবেন।

অনেকক্ষণ সুমুদ্রের দিকে তাঁকিয়ে থাকার পর, সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসমান দুলখেলা মাছ ধরার নৌকা দেখিয়ে ফলেনমাস্ক বলে,
– কি অপূর্ব দৃশ‍্য, আমি যদি ঐ মাঝির মত আনন্দে মাছ ধরতে পারতাম, কতই না ভালো হতো।
– যদি মন থেকে চান, পাবেন। মানুষ মন থেকে যা চায়, তাই পায়।
– বুঝেছি। তয়, আপনি কি করেন?
– মাছ ধরি, ঐ জেলের মত মাছ ধরতাম। বয়সের কারনে পুত্রধন এখনো সাগরে যেতে দেয় না, যদিও আগের মতই আমি সবল। তারপরও মাঝে মাঝে ওর সাথে সাগরে যাই, মাছ ধরি।
– ও তাই বুঝি। অসাধারণ। তয় আপনার মাছ ধরার নৌকা কয়টা?
– একটা!
– মাত্র একটা? সারাজীবন কাজ করে মাত্র একটি নৌকার মালিক হয়েছেন? এত কম কেন?
– আমার তো একটাই দরকার। বেশী দিয়ে কি করবো? কে চালাবে? আগে আমি চালাতাম, এখন পুত্র চালায়।
– কেন আরেকজনকে দিবেন। হয় লোক রেখে চালাবেন, না হয় ভাড়া দিবেন। সে আপনার হয়ে চালাবে। বেশী বেশী মাছ ধরবে। বাজারে মাছ বিক্রি করে আরেকটা নৌকা কিনবেন। এভাবে আপনার অনেক নৌকা হবে, আপনিও আমার মত অনেক ধনী হতে পারেন।
– ও তাই নাকি, ধনী হওযার এই সহজ বুদ্ধিটা তো আমাকে আগে কেউ কখনো দেয়নি। তয় বেশী ধনী হয়ে লাভ কি?
বৃদ্ধের কথা শুনে মাস্ক হতবাক হয়। মনে মনে ভাবে, ধনী হলে কি লাভ, এই বুড়ো বুঝে না, ওনাকে কেমনে কি বুঝাই?
বৃদ্ধ অতানাবে বলে, কি ভাবছেন মিস্টার মাস্ক?
– তেমন কিছু না। ধনী হলে আপনার অনেক টাকা হবে। আপনি বসে বসে খাবেন। অন‍্যরা আপনার হুকুম তামিল করবে, অনেক সম্মান করবে। আপনি আরামে থাকবেন।
– আমি তো বসে বসেই খাই। অনেক আরামেই আছি। জীবনে কোন সমস‍্যা নেই। যা চাই, তাই পাই। আরামে থাকার জন‍্য এতকষ্ট করে অনেকগুলো নৌকার মালিক হওয়ার দরকার কি?
মাস্ক বৃদ্ধের কথা খোঁচার আঁচ পেয়ে অপমানবোধ করে। কিন্তু আবেগ দেখায় না। আরো শান্ত হয়ে বলে,
– ও তাই? আপনার তো অনেক টাকা নাই।
– তা ঠিক, তবে সুখ ও সন্তুষ্টি তো আছে। আপনার কি অনেক টাকা? আপনার কয়টা নৌকা?
– নৌকা নাই তবে অনেকগুলো গাড়ি আছে। আমার একটা কচলা গাড়ির কোম্পানি আছে, দামি দামি গাড়ি বানায়!
– তাহলে তো দেখছি আসলেই আপনি অনেক ধনী মানুষ।
– হ, লোকে বলে আমি বিলিয়নিয়ার।
– ওরে বাবা। এর মানে, আপনি অনেক বুদ্ধিমান, নিজের লাভের লাগি অনেক মানুষকে খাটাতে পারেন।
– খাটানো বলছেন কেন? আমি তো উদ‍্যেক্তা, ব‍্যবসায়ি। ব‍্যবসার মাধ‍্যমে মানবসেবা করি, মানুষের কাজ ও রুজির ব‍্যবস্থা করি, সমাজ সেবা করি।
– তা ঠিক। তবে ব‍্যবসায় শুভঙ্করি না থাকলে ধনী হওয়া যায় না। ছোট সময় আমার বাবা বলতেন, দুনিয়াতে যে যত মানুষকে ব‍্যবহার করতে পারে, ঠকাতে পারে সে তত ধনী, সে তত বিখ‍্যাত হয়।
– এটা তো সন্তদের দর্শন। আপনার বাবা কি সন্ত ছিলেন?

স‍্যাটেলাইটের শোকে মাস্ক বারবার আনমনা হযে যাচ্ছে। মন যাওয়ার কথা মহাশূন‍্যে, সেখানে না গিয়ে আম্রিকায় চলে যাচ্ছে, কোনভাবে নিজেকে নিজের সাথে রাখতে পারছে না। এবার বুঝি শেয়ারবাজারে আমার ধস নামবেই।
এত অস্থিরতার মাঝেও মাস্কভাবে ‘স্বর্ণদ্বীপের আমাকে কেউ বিলিয়নিয়ার হিসাবে, কচলার মালিক হিসাবে জানে না কেন। কেউ তো বাড়তি সম্মান করছে না! কেউ কি আমার সম্পর্কে জানে না? এখানে একটি মিডিয়া সেন্টার বানানো জরুরী। মানুষকে লেটেষ্ট তথ‍্য জানানো দরকার। নইলে মানুষের আদিমতা, মূর্খতা কববে না। ব‍্যবসার ক্ষেত্র তৈরী হবে না। এই সুন্দরদ্বীপে নিজের গুরুত্ব কম, এই ভাবনায় মাস্কের মন হতাশায় ধসে পড়ে। চরম একাকিত্ব বোধ হয়, হৃদয়ে ভালোবাসাহীনতার তুফান জাগে। এখানে ডলারের দাম থাকবে না এটা কোন কথা হলো? এখানে মানুষ কেন বড় হতে চায় না, কেন মানুষ একে অন‍্যকে টপকে যেতে চায় না? কেন মানুষ বহেমিয়ান বুদ্ধ-গান্ধী’র মত নিমোহ থাকতে চায়? বিষয়টা নিয়ে গবেষনা করা দরকার। এদেরকে আধুনিক বানাতেই হবে।

বৃদ্ধের প্রশ্নবাণ থেকে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে মাস্ক নিজেকে নিজে বুঝ দেয়, ” তোয়াজ করবে কেন এখানে তো গাড়ি বা স‍্যাটেলাইটের দরকার নেই। দরকার শুধু শান্তি, সেটা তো দেখছি সবার ঘরে আছে। ”

মাস্কের সঙ্গে কথপোকথনের সময় হঠাৎ আরেক বৃদ্ধ কাছে আসে। মাথার চুল অগোছালো, আলোদুলো। বয়স তার আনুমানিক ৬৫ । হাতে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো বৃদ্ধ অতানাবের একটি প্রট্রোট ও একটি খাতা। নীচুস্বরে মাস্ক বলে,
– আপনার বন্ধু বুঝি?
– না, ও আমার একমাত্র পুত্র ‘কিমতারু’, বড় ডানপিঠে ছেলে। এখন ভদ্র হয়ে গেছে। আমার বয়স ৮৭ বছর, যে কোন মুহুর্তে খামিসামার কাছে চলে যেতে পারি, তাই ভয়ে থাকে। এখন অনেক কথা শুনে, সম্মান করে। কোন বেয়াদবি করে না।

এ বলে মাস্কের সঙ্গে বৃদ্ধ পুত্রকে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিমতারু বাবাকে খাতাটি দেখিয়ে বলে,
– বাবা, সুবচনটা তো ঠিক করে দিলে না। যে কোন মহুর্তে তো চলে যেতে পারো। তোমার কবরের শিলালিপিটা আগেবাগে বানিয়ে রাখা ভালো, দেখে দাও। বৃদ্ধ আনন্দ ও তৃপ্তির সাথে পুত্রের লেখা সুবচনটি পড়ে, একটু ঠিক করে দেয়।

” হে পথিক, মহাকালের মহাযাত্রায় ক্ষণিক বিরতি হয়েছে এ জনপথে আমার। এদ্বীপে ভালোবাসার একটি ছোট প্রদ্বীপ জ্বালিয়েছিলাম। তোমারা ভালোবাসার প্রদ্বীপ জ্বালাও, জীবন আলোকিত হবে, পূর্ণ হবে সকল সুখ আয়োজন।” ”

—-
শাহজাহান সিরাজ
জাপান, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

February 16, 2022