বিলসন্ধ‍্যা
Massland , বিল

এক গৃহহীন হতদরিদ্র আধা পাগল রাস্তায় দাঁড়িয়ে বহুতল ভবনের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘ঘরে থাকতে কইতাছেন ভালা কথা, থাকুম, কিন্তু যার ঘর নাই বাড়ি নাই, সে থাকবো কোথায়? পথশিশু, বস্তিবাসী ছাড়াও, ঢাহার শহরের বেশীর ভাগ মানুষের আমার মত ঘরবাড়ি নাই, ভাড়াবাড়িতে থাকে! বড়াই করে! টানা কয়েক মাস কাজকাম না থাকলে, আয় রোজগার না হইলে, দেখি না কয়জনের শহরপ্রেম, ফুটাঙ্গি থাকে! সবাই আমার লাহান, সমান হইয়া যাব।’

এ বলে অট্ট হাসিতে হাসতে থাকে, পাগল।

এটা-সেটা করে কতক্ষণ থেমে থাকার পর, পাগলটা আবার প্রলাপ বকতে শুরু করে, ‘নাটকের প‍্যাথেটিক পর্ব শুরুর আগেই, চল নিরাপদে, সবুজ-শ‍্যামল যে গেরামে জন্ম হয়েছিল, সেখানে চইলা যাই। ভালাবাসা পাবার সাথে সাথে, করোনামুক্ত পরিবেশ পাবা। নদী-বিলে মাছ ধরবা, পুকুরে সাঁতার কাটবা, তরতাজা সবজি খাবা। নদী আর প্রকৃতি দেইখা দেইখা, নির্মল হিমেল বাতাস খাইয়া অপার শান্তি পাবা। হয়তো বুকে লুকিয়ে থাকা কবিতাও মুখে ফুটবে।

পাগলের চিল্লাচিল্লি শুনে টক্কর আলী ৩য় তলার বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। টক্কর আলিকে লক্ষ‍্য করে পাগল বলে, ‘আগেই কইছিলাম, গেরামের পোলা লও গেরামে যাই, কেউ কথা শোন নাই, এমনকি রথি-মহারথি, মন্ত্রী-মিনিষ্টারাও শোনে নাই! নীচে নাইমা আসো! আও চইলা যাই, পাগলের এই শহর থেইকা লাভ নাই, চল পালাই।

পাগলের বকবকানি শুনে টক্কর আলি আইসোলেশনের অতি কষ্টেও মজা পায়! হাসে আর মনে মনে বলে, ‘দুনিয়াতে পাগলের সংখ‍্যা দিন দিন বাড়ছে।’

টক্কর আলির হাসি দেখে পাগল আবার বলতে শুরু করে,

”হাইসো না হাইসো না, নিটকাইয়া আর হাইসো না, দুবাইয়ের বুর্জখলিফা কাঁপতাছে! প‍্যারিস, লন্ডন, নিউয়র্ক পুরো খালি! সব বিল্ডিং ভয়ে থরথর করতাছে, চল পালাই, গেরামে যাই! নিজের জায়গায় যাই! দুইদিন আগে বা পরে ঐখানেই তো কব্বর টা হইবো, আগেবাগে গেলে অসুবিধা কি?’

পাগলের কথা শেষ হওয়ার পর, চারদিক অসম্ভব ভয়ার্ত নীবব লাগে। তিন তলা থেকে বামে ডানে তাকিয়ে পুরো রাস্তা দেখে, পুরো শহর খালি, একা একা লাগে। টক্কর আলি হৃদয় মৃত‍্যুভয়ে কেঁপে উঠে। চির বিদায়ের আশঙ্কায় অনুভূতি জেগে উঠে, সবকিছু যেন ভেঙ্গে পড়ে। আশেপাশের সব বিল্ডিংএর কাঁপন অনুভূত হয়। কষ্টে, দীর্ঘশ্বাসে চোখ বন্ধ করতেই টক্কর আলির কল্পণায় ভেসে উঠে, ছেলেবেলায় দেখা নিজ গ্রামের বিলের ধারে সূর্যাস্তের দৃশ‍্য। কতদিন দেখা হয়নি প্রিয় গ্রামের শেষ সোনালী আলো। বোধ করে – স্বর্গে আছি, নিজগ্রামে একজনকেও এখনো করোনা ধরেনি, একজনও এখানে মারা যায়নি! সব রহমত গ্রামে!

চোখ খুলতেই দেখে পাগলটি তার পুটলা থেকে একটি বনরুটি বের করে খাচ্ছে, খাদ‍্যদানা দাড়ি-মোছ লাগছে, এদিক সেদিকে ছিটছে! অস্পষ্ট কন্ঠে বলছে, ‘চিন্তার কারণ নাই, ক‍েবারে-বাবারে ছাড়া গেরামে কোন কিছুর অভাব নেই। কোন কথা না বইলা, সুবোধ বালক ও বালিকারা যদি শান্তিতে থাকতে চাও, বাঁচতে চাও, নিজ গেরামে চলে যাও। হে কমরেডগণ, গেরামে তোমার সব আছে, তুমি তো ঐখানে সর্বহারা নও, ঐখানে তুমি রাজা, অমৃতার সন্তান!’

‘শহরে ঘর নাই বাড়ি নাই, চল নিরাপদ গেরামে যাই!’
এ শ্লোগান জপতে জপতে চৈরঙ্গীর থেকে সুরু এক গলিতে ঢুকে যায়। পাগলটাকে আর দেখা যায় না, আর কথা শোনা যায় না। টক্কর আলি ঘরে এসে, বিছানায় শুয়ে বিশ্রামের চেষ্টা করে। হোম কোয়ারেন্টাইনে, দীর্ঘ গৃহবাসের অবসাদ মনে, তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ, শৈশব থেকে পুরো জীবনের ঘটনা হৃদয়ের পর্দায় সিনেমার মত দেখতে থাকে। পাগলের প্রলাপগুলো নিজের জীবনের সাথে মিল খুঁজে পেয়ে কষ্ট পায়। শৈশবের আনন্দ আর স্বর্গসুখ হারিয়ে হৃদয় হাহাকার করে! অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ভাবে, ‘কেন এত কষ্ট, কেন অযথা ব‍্যস্ত বড়াইয়ের জীবনযাত্রা। সুখে থাকার জন্য এত আয়োজন, এত কৌশল, এত ছলছাতুরি কি আসলেই দরকার? আমি কি এতদিন ঠিক পথে চলেছি?’

টক্কর আলি একা একা কাঁদে, জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করে!

Bill , Marshland , বিল

April 17, 2020