( Working-class women in Bangladesh. )
খালারা আমাদের পরিচিতজন। খালা মানে মায়ের বোন। মায়ের আসল বোনকে আমার গায়ে মাখলেও, কর্মজীবি নারী খালাদের গায়েমাখা নিয়ে প্রশ্ন আছে। মুখে, কথায় কথায় খালা বললেও, আমাদের অন্তরে বহুলাংশে এদের বাস নেই।
এই শ্রমজীবি শ্রেণীটা- ১ম মহাযুদ্ধের আগে, সারা পৃথিবীতে দেশে দেশে শিকল বাঁধা দাস হিসাবে – ইংরেজ সহ, ইউরোপিয়ান সভ্যজনদের দ্বারা, যা ইচ্ছা তাহাই ভাবে, ‘পশুর’ মত ব্যবহৃত হতো। ভারতবর্ষে যারা সুন্দরী ছিল, তারা রাজা-বাদশাহ, সম্রাট-জমিদারদের বাঈজীখানায়, হেরেমখানায় অতিযত্ন পেত।
খালারা আমাদের সমাজের বিশাল অংশ। অনেকটা পুচ শুকনো বিষফোঁড়ার মত সমাজের গায়ে বেঁচে থাকে । যার ব্যাথা মাঝে থাকলেও, আমরা ভোগ করতে করতে সহে গেছি। এখন, বুঝেও না বুঝার ভাব করি। অনেকটা চিরস্থায়ী ভেবে মেনে নিয়েছি।
খালাদের হাতে- আমরা যারা সুবিধাভোগী তাদের রান্না হয়, কাপড়কাচা হয়, অফিসারদের ছেলেমেয়ে বড় হয়। এরা প্রায়শঃ উচ্ছিষ্ট ও উদ্বৃত্ত খায়। সবার আগে দামী মাছ-মাংস দেখে রান্না করলেও, সবার পরে খায় ! কখনও খেতে পায়, কখনো পায় না।
বাসাবাড়িতে স্থায়ী বুয়া খালারা আমাদের একই ঘরে, একই ছাদের নীচে, সবচেয়ে কাছাকাছি থাকলেও, সবচেয়ে দূরে যেন বাস করে। আমাদের অমর্যাদা হবে, তাই আমাদের পাশের চেয়ারে বাসতে সাহস ও সুযোগ পায় না। আমরা যা খাই, আমরা যা পরি, তা তারা কল্পনার তুলিতেও আঁকতে পারে না। ববং দামী স্পেশ্যাল কিছু কিনে দিলে, এরা বব্যহার করে না। দামী সবান বা কাপড় কিনে দিলে, ব্যবহার না করে ট্রাঙ্কে রেখে দেয়। গ্রামদেশে যাওয়ার সময়; ছেলে-মেয়ে ও আত্নীয়স্বজনকে উপহার দেয়ার জন্য নিয়ে যায়।
আমার জাপানি নায়িকা, মানুষে মানুষে তফাৎ বুঝে না, আলাদা করতে পারে না। এটা তার রোগ বা অভ্যাস না। জন্মগত সংস্কৃতি। বাইডিফল্ট আধুনিক জাপানিরা সব মানুষকে সমান মনে করে। নিজের কাতারে রাখে। প্রথম থেকেই বউ আমার – ঢাকার বাসায় বুয়া না রাখার পক্ষে। আমি বলছিলাম,
– আপনি বিদেশী, সুন্দরী-শিক্ষিত মানুষ, ঘর পরিস্কার করবেন, রান্না করবেন, এটা মানায় না। মানুষ খারাপ ভাববে। তার এক উত্তর ছিল,
– আমি তো গৃহিনী, হাউজ ওয়াইফ! ঢাকায় আমার তো কোন কাজ নাই। বসে বসে খাব কেন?
– এটা বাংলাদেশের এলিটদের সংস্কৃতি। ধনী-শিক্ষিতদের বুয়া দিয়ে কাজ করায় (যদিও আমি তেমন ধনী না)
বউ আমতা আমতা করতো। প্রথম আমি বিষয়টি বুঝি নাই। পরে যখন- তার ‘প্রেমে ভাগের’ আশঙ্কাটা বুঝলাম; তখন তাকে বুঝিয়ে ছিলাম ।
– মহামতি সিরাজ, অত খারাপ মানুষ না। আপনার ভালোবাসার গোলাপফুলের পাপড়ি ছিড়ে আরেকজনকে দিব না। এক্সটা মেরাইটাল রিলেশনশীপে বিশ্বাসী নয়।
যখন মহামতি আসল চরিত্রটা বুঝলো, জামাই তার ভালোবাসার সম্পর্কে পিওর, তখন ঢাকার বাসায় বুয়া রাখতে সায় দিয়েছিল। বাজারে গেলে, বুয়ার জন্য একই ব্যন্ডের সাবান-প্রসাধনীর দুইসেট কিনতো। বুয়া ব্যবহার না করলে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় ঝারি দিত। অনেকবার বলার পরও, খালা য়খন ব্যবহার করতো না। একদিন কারণটা জানতে চাইলে, মুক্তাগাছা থেকে আনা খালা বলেছিল,
– মামা, মামীরে কন, এত দামী সাবান আমি গায়ে দিতে পারি না। চামড়া খসখস করে। আমার লইগা হয়, তিব্বত না হয় দেশী লাক্স সাবান আনবেন।
ঘরের বুয়াদের বিষয়টা আমাদের জানা থাকলেও, আমরা কি জানি – বাংলাদেশের প্রতিটি বাজারে, বিশেষ করে রসুন পিয়াজের আড়ৎএ থাকা খালাদের বাস্তবতা? তাদের জীবন কিভাবে চলে? শুনেছি, এরা কেউ কেউ দমে দমে বিড়ি টানে, অধিকাংশ স্বামী-সংসার হারা, দিনে আড়তে কাজ করে – রাতে অধিকাংশই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় দেহব্যবসা করে, লাং রাখে।
শ্রমজীবি, কর্মজীবি নারী দেশে থাকবে না , এটা আমি চাচ্ছি না। এটা কোন দেশেই সম্ভব না। মানুষকে তো কাজ করেই খেতে হয় , ও হবে। আমার চাওয়া – অর্থনৈতিক ও সমাজিক মর্যাদার ব্যবধান নিয়ে।
আমার বর্তমান বাস- জাপানেও কর্মজীবি নারী আছে। কিন্তু সবাই শিক্ষিত ও সচেতন। বেতন ও শিক্ষার ব্যবধান না থাকার কারণে, মর্যদাতেও তেমন হেরফের নেই। মালিকের মত বুয়ারাও উন্নত ডেসিং করে, গাড়ি চালায়, একই দৃষ্টিতে দেকে। ফলত কেউ চুলে ধরা তো পরের কথা, ধমকও দিতে পারে না। গৃহকর্তীর চেয়ে অনেক জাপানি বুয়া সুন্দরী হওয়ার কারণে, অধিকাংশ জাপানি বউ ‘শেয়ার্জ নিগারের’ মত সংসার ভাঙার ভয়ে, স্বামী হারানের ভয়ে তঠস্থ থাকে। হয়তো, টানাটানি পাশাপাশ এ কারণে জাপানি বউয়েরা, ঘরে বুয়া রাখে না, রাখতে চায় না। রাখলেও ঘরে রাত্রিযাপন করতে দেয় না।