মোহাম্মদপুর টাউনহলের দিনমুজুরদের জটলার মত, রাস্তার মোড়ে একদন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এমপি, মন্ত্রি, কৃষক, মুজুর সবাই কোদাল, দা, খন্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; শীতের ভোরের প্রচন্ড ঠান্ডায় সবার শ্বাস দিয়ে বাস্প-ধোঁয়া বের হচ্ছে, রাস্তাঘাট পরিস্কারের জন্য ওয়ার্ড অফিসের নিদের্শের অপেক্ষো করছে, এমন দৃশ্য বাংলাদেশে অকল্পনীয়। কিন্তু তুখোড় পুঁজিবাদি দেশ, এক সময় দূরপ্রাচ্যের সাম্রাজ্যবাদি জাপানে এ দৃশ্য স্বাভাবিক। দেশের, বিশেষ করে গ্রাম ও মফস্বলের রাস্তাঘাট জাপানে, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নিবিশেষে সবাই মিলেমিশে পরিস্কার করে। এ সমাজিক কাজে কোন বরাদ্ধ নেই, নেই রাজনীতি, ফান্ড, দূনীতি ও ক্ষমতার ক্যারাবেরা।
করোনায় যখন সারা বিশ্ব আতঙ্কিত, তখন আমরা সাদোতে রাস্তা পরিস্কার করছি। আমি আর্শীবাদপুষ্ট যে দ্বীপে থাকি, সেখানে করোনার আক্রমণ নেই, এখনো কোন রোগী ধরা পড়ে নাই। মনেহয় মেইনল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে, বা আদি থেকে অনেক নির্বাসিত মহামতির আস্তানার কারণে এই পূণ্যভূমিতে রহমতটা আজো আছে।
জাপান পুঁজিবাদি দেশ হলেও, মানুষ এখানে সম্পদ ও বংশের বড়াই করে না, কেউ পার পায় না, কেউ পূঁজির প্রসঙ্গ টানলে, বাহদূরী করলে হাসির পাত্র হয়। সম্পদশালী হয়ে কেউ কোন বাড়তি সুবিধা পায় না। যার আছে সে যেমন বলে না আমার আছে, যার নাই সে’ও বলে আমার নাই! অনেকটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র প্রখরতার সমাজ, কেউ কারে তেমন বিরক্ত করে না। সম্পদ ও বংশের বিচারে সম্পর্ক উঠানামা করে না।
টাকার বড়াই ব্যংকে, ক্ষমতার বড়াই পদে আর বংশের বড়াই চরিত্রে রেখে জাপানে জীবনযাপন করতে হয়। কেউ গা গরম করলে, শক্তি দেখালে, আইনের সাথে সাথে, বিনাপয়সা ইয়াকুজা মানে মাফিয়া অপবাদ, উপাদি পেতে হয়। ফলে কে লাখপতি, কে কোটিপতি, কে হাজারপতি বুঝার উপায় নেই, সবাই সাদাসিদে শার্ট-গেঞ্জি পড়ে, যতদূর সম্ভব ভদ্রতা ও বিনয় দেখায়!। অযথা অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগীতা করে না। যাদের টাকা পয়সা রাখার জায়গা নেই, তারা সাধারনত ডাকঢোল না পিটিয়ে, বারে গিয়ে দামী দামী বিদেশী খাবার খায়, পাগলা পানি পান করে, জুসি ললনাদের সাথে জুস খায়, জাপানি গাড়ি না চালিয়ে দামি বিএমডাবলিও, কেডিলাক গাড়ি চালায়, অর্থ বার্ণ করে, হারমাতি দেখাতে পারে না! টাকা উড়ানোর কালচার জাপানের গ্রামে নেই, আছে মেঘাসিটিতে, হোটেল আর এপার্টমেন্টর খুঁপড়ি রুমে।
মেঘাসিটির মানুষের টাকা থাকলেও, রাস্তা পরিস্কার না করতে হলেও, অন্যকে সেবার করার ঝুটঝামেলা না থাকলেও, জীবন হয় বন্ধুহীন, কমিউনিটিহীন। জীবনে থাকে না উৎসবের আনন্দ, ভালোবাসার সুবাস। পরিপাটিতা নগর জীবন যেন নিজস্ব চারদেয়ালেই সীমাবন্ধ থাকে। ধনী কেউ মারা গেলে আসল করুণ বাস্তবতাটা ফুটে উঠে, হাসপাতালের কয়েকজন নার্স-ডাক্তারই মৃত্যু সংবাদ জানতে পারে, হাতেগোনা কয়েকজন হয়েতা কাঁদে, দোয়া-প্রার্থনা করে, পারিবারিক আত্নীয়স্বজনদের ছাড়া অন্যদের ধন্যবাদ পায় না বললেই চলে। এ’বিষয়ে জাপানের গ্রামে ও মফস্বলের দৃশ্যটা পুরোই উল্টো, অনেকটা বাংলাদেশের মতো! কেউ ইন্তেকাল করলে সারা শহরে গাড়ী করে দেহ ঘুরানো হয়, সব প্রিয় ও পরিচিতজন কে জানান দেয়া হয়, হাজার মানুষ শোকযাত্রায়, চিরবিদায়ে অংশগ্রহন করে। অন্যজনকে দেয়ার, অপরকে ভালোবাসার উত্তরটা স্পষ্ট হয়ে উঠে বিদায় উৎসবে। আর জনসেবা করলে তো কথায় নেই মিষ্টার রিগানের মত অন্তষ্টিক্রিয়া হয়।
জাপানের জনসেবার ধরণটা বাংলাদেশ ও প্রশ্চাত্যের মত না, এত ঘনঘটা হয় না; মিটিং-মিছিল, সভা-সমিতি, দান-খয়তার কেন্দ্রিক না। পুরোটাই যেন ব্যক্তিগত চর্চ্চা ও সামাজিক অংশগ্রহন কেন্দ্রিক। চাপাবাজি, মোসাহেব, চামচারা জায়গা পায় না, মূল্যায়ন পায় প্রকৃতই ফলোয়ার আর ভালোবাসার সারথীরা।
জাপানের প্রতিটি গ্রামে নিয়মিত ঋতুভিত্তিক উৎসব হয়, মেলার আয়োজন হয়, যা শুধুই মেলা নয়, মানুষের মিলনমেলা। আমি এই মিলনমেলা গুলো পারতপক্ষে মিস করি না। মাসের নিদ্দিষ্ট দিনে, কাজের পোষাক পড়ে খন্তি কোদাল দিয়ে জাপানে রাস্তার ধার পরিস্কার করা একধরনের উৎসব। আমার প্রিয়, উৎসবের আনন্দে কাজ করি। এটা শুধু রাস্তা পরিস্কার নয়, ভালোবাসার প্রকাশ। পিতামাতাকে শুধু রাস্তা নয়, স্কুলও নিদিষ্ট সময় পরপর পরিস্কার করতে হয়। আমি এ সুযোগ গুলো এনজয় করি। অলস কেউ অংশগ্রহন না করলে জরিমানা দিতে হয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের প্রতি দায়িত্বহীনতার গ্লানি বইতে হয়, যা খুবই লজ্জাকর। প্রথম প্রথম আমি বাঙালি শিক্ষিত-সচেতন ব্যক্তিত্বের আবেগে এই ছোটকাজ গুলো করতে চাইতাম না। একদিন বউয়ের ঝাড়ি খেয়েছিলাম- রাস্তা, স্কুল, কলেজের সুবিধা নিবেন, টেককেয়ার করবেন না, এটা তো অন্যায়। একধরনের চিটিং ।
এখন আমি জানি ও মানি, যে রাস্তার সুবিধা আমরা সবাই ব্যবহার করি, তা রক্ষার দায়িত্ব তো সবারই। জাপানে, পরিরেশের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, কমিউনিটি কাজের পুরো বিষয়টা একজন দায়িত্বশীল কমিউনিটি লিডার ও কমিটি’র মাধ্যমে পরিচালিত হয়। অনেকটা বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার চেয়ারম্যানদের মত এদের পদ, এ কাজের জন্য কেউ টাকা পয়সা পায় না, নির্বাচনও নেই। কমিউনিটির গণ্যমাণ্যদের দ্বারা লিডার সিলেকশন হয়, সিটি অফিস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পাবলিক মানির চুরিধারির, তসরুফের সুযোগ নেই, কেউ জনসেবার নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে না, গড়তে পারে না। যে কোন প্রকার অপচয় বা দায়িত্বহীনতার খবর ফাঁস হলে, পদ হারানোর পাশাপাশি মান-সম্মান যায়, নিজের আইডিতে অপরাধের চিহৃ পড়ে। যেহেতু কোন সুবিধা নাই, যে সব মানুষের সমাজ সেবার বাড়তি প্রেম আছে, তারাই শুধু সমাজনেতা হতে চায়, পারে। বাংলাদেশের মত মেম্বার-চেয়ারম্যান হতে অনেক মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। কমিউনিটির কাজ কমিউনিটি করে ফেলে বলে – এনজিও’র রাজত্ব নেই জাপানি সমাজে। গুটিকয়েক যে এনপিও, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানান ভাবে সহযোগীতা করে, উঠে দাঁড়াতে। সাধারণত মানুষ পূর্ণ্যির মানসিকতায় না, দায়িত্বের মানসিকতা গরীবদেশের মানুষকে মুক্তহস্তে দান করে। যারা উন্নয়নসংস্থা চালায়, তারা সমাজে সেনসে, অধ্যক্ষ হিসাবে সম্মানিত হয়।
ভোর সকালে নিবো’র রাস্তা পরিস্কার করতে পেরে, বাঙালি অহং মাটিতে ঢেলে দিয়ে ভারমুক্ত হয়েছি! শারীরিক পরিশ্রম করে, কয়েকজন নতুন সুনয়নার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, মন শান্তিতে ফুরফুরা, আনন্দে ভরা। দুই সুন্দরীর কাছ থেকে দাওয়াত পেলাম, দেখি না বাড়িতে গেলে কি খাওয়ায়। জাপানি বাড়িতে দাওয়াত মানে, বাংলাদেশের মত পোলাও মাংস না, কিপটেমির জাহির- স্বাদহীন গ্রীণ-ট্রি আর দুই একটা সেমবে, বিস্কুট, সাথে নানান জাতের হালকা আলাপ। এদের আলাপ আমি বেশীক্ষন মনযোগ দিয়ে শুনতে পারি না, বাংলাদেশের দাওয়াতের মত গামলা ভর্তি মাংস, পোলাও, বোরহানি কল্পনা করি, নষ্টালজিয়ায় ভুগি।
জাপানের মত, ঢাকাসহ বাংলাদেশের সকল শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট যদি জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নিবিশেষে সবাই একসাথে নিয়মিত এমন পরিস্কার করতো; কোন প্রকার রাজনীতি, ফান্ড, দূনীতি ও ক্ষমতার ক্যারাবেরা না করতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। শুধুমাত্র সরকার ও এনজিও’দের উপর সমাজ উন্নয়নের চাপটা কমতো।
বাংলাদেশী সমাজের বর্তমান অবস্থাগতি, শ্রেণী প্রখরতা, পুঁজিবাদি চিন্তা ও তীর্যক আত্নসম্মানে তেজ দেখে আমার মনেহয় বাংলাদেশে এখন অসম্ভব। এজন্য প্রথমে বাংলাদেশের দরকার শিক্ষা, সচেতনতা আর অন্যকে নিজের মত সমান মনেকরতে শেখা। অন্যের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ মনেকরা। সমাজটাকে নিজের পরিবারের এক্সটেনশন মনে করা। তাহলে হয়তো দৃশ্যপট, বর্তমান নাটকের অমিমাংসিত কাহিনি বদলে যাবে!
নিবো, জাপান
২৯ মার্চ, ২০২০