আমার পুরো স্কুলজীবনটা কেটেছে দুপুরে পুড়ি বা সিঙ্গারা খেয়ে! দুপুর হলেই ক্ষুধায় কারত থাকতাম, আমার প্রিয় নরারুণ বিদ্যানিকেতনে! ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত, স্কুলের কাছেই বাড়ি থাকার পরও, যেতাম না। আশানুরুপ ক্লাসে পড়ালেখার অবস্থান না করতে পেরে পিতামাতা-স্যারদের তাপে ও চাপে থাকতাম!
প্রাইমারীতে প্রথম হলেও, শহরের হাইস্কুলে – ৬ম থেকে ৮ষ্টম ক্লাসে, রুল থাকতো ১৫ এর পরে। এত পরে রুল হাজিরা দিতে আমার ভালো লাগতো না! কিন্তু প্রথম ব্রেঞ্চিতে বাসা ও আশা হারাইনি। সতি্যই টেষ্ট, প্রি-টেষ্ট ও এসএসসিতে প্রথম হয়ে, সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলাম!
– গেরামের এই পুলাডা এত ভালা ছাএ হইলো কেমন?
যখন আমার ক্লাসে ফলাফল ভালো হতে শুরু করলো, আমি উপরে উপরে ভদ্র-সুবোধ থাকলেও; স্যার বা মা-বাপের আদেশ অমান্য করেই বাড়ি চলে যেতাম। দুপুরে বাড়ি যাওয়া নিষিদ্ধ থাকলেও – থোর কেয়ার করতাম!
টিফিনের ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে, পুড়িটা হাতে নিয়েই, ২ মিনিটের মাঝেই, কাউকে না বলে- বাড়িতে ফুট! ভর দুপরে মা বাড়িতে দেখে অবাক হতেন, বকা দিতেন!
– স্কুল পালাইয়া আইছস নাকি?
– না, খাইতে আইছি!
– রান্না শেষ হয় নাই, খাবি কি? এখন আইসোস ক্যান! তোর বাপে জানলে রাগ করবো, স্যারেরাও মাইর দিব!
– আরে না, মারবো না । এখন আমি ভালা ছাত্র । কথা দিলাম, আগামীবার আমার রুল নম্বর ১ হইবো! তাড়াতাড়ি কুমড়ার পাতা দিয়া একটা নুনা-ইলিশের টুকরা বা মাছ-ডিম যা ইচ্ছা ভাইজা দেও !
আম্মা সহজ-সরল, তাই কবতো! আধা কাঁচা মাছ ভাজি দিয়ে, ততা ভাতের কয়েক নলা খেয়েই স্কুলে দৌড় দিতাম! সদ্য পরা পেটে জল-ভাত নড়াচড়া করতো, দৌড়ের উপর ব্যাথ্যা পেতাম! স্কুলে ফিরতে দেরী হওযার জন্য মাঝে মাঝে স্যারের বেতের ভারি খেতাম! বেশী না – ১০ মিনিট দেরীর জন্য ১০ টা আঘাত! অনেক সময় রাগি স্যারেরা ক্লাসের বাহিরে দাড় করিয়ে রাখতো! জানালা দিয়ে দেখতাম প্রিয় বন্ধুরা- মুচকি মুচকি হাসছে। ক্লাসের সুন্দরী বান্ধবীদের চাপা হাসিতে- লজ্জায় নুয়ে যেতাম! তারপরেও পালিয়ে টিফিন খাওয়া ছাড়তাম না!
আমার স্কুল জীবনের টিফিনে এই করুণ দশা হলেও, আমার সন্তানেরা বেড়ে উঠছে, ‘সুষম খাদে্য’!
পছন্দ হোক বা না হোক – জাপানে সব শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলে খেতে হয়! একই খাবার, দুপুরে! ধনী-গরীব বাঁচ-বিচার নাই! প্রতিটি জুনিয়ার হাইস্কুল ও হাইস্কুলে রয়েছে ডাইনিং রুম, রান্না ও খাবারের বিশাল আয়োজন। শিশুরা বিভিন্ন ঋতুর সবজি-ফলও ফলায়। নিজেদের তৈরী খাবার নিজেরা খায় প্রায়শঃ ! সুষম খাদ্য তৈরী ও গ্রহনের অভ্যাস, জাপানে শিক্ষার অংশ ।
আমার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল- বাংলাদেশে কেন সুষম খাদে্যর টিফিন চালু হয় না। জীবনমুখী শিক্ষা ও ভাবনা চালু হয় না! প্রয়োজনে পিতামাতা বাড়তি টাকা দেয়া দিতে পারে! সরকারও তো দিতে পারে, দেয় না কেন? শিশুরা অপুষ্টি আর ক্ষুধায় বেড়ে উঠবে! অসুস্থ জাতি গাঢ়ে রেখে- সরকার অফিস-দালান-টাকা দিয়ে করবে কি?
বাংলাদেশে একটি উন্নয়নশীল দেশ, লক্ষ লক্ষ শিক্ষার খাবার তো ব্যয়বহুল। তাছাড়া বাংলাদেশ তো সামাজতান্ত্রিক দেশ না! এত টাকা পাবে কোথায়? পিতামাতারাও তো উন্নতদেশের মানুষের মত ভ্যাট-ট্যাক্স দেয় না, দিতে পারে না! আয়োজকরা ফাঁক পেলেই
“সরকারকে মাল দরিয়া মে ঢাল”!
চুরি-তসরুফ করে! বিরাট ঝামেলার কাজ!
এই স্বযুক্তিতে আমার অভিযোগ কেটে গিয়েছিল । অবশেষে বাংলাদেশ সরকার ‘ওয়েলফেফার ষ্টেট’ ও ‘সামাজতান্ত্রিক দেশ’ গুলোর মতো টিফিন নীতি চালু করেছে। জেনে আনন্দিত হলাম।
আশাকারি, ধনী-গরীর শিশুরা একসাথে, একই খাবার খেয়ে -সম্পর্কে, বর্ণে ও স্বভাবে; জাপান ও স্কা্যানডেনেবিয়ানদের মত সমতা আনবে। চালু হবে, সুস্থ জীতি গড়ায় সুষম খাদে্যর আরো সচেতনতা। আর স্কুলের শিক্ষকরাও, শিশুদের খাবারের টাকা মারিং না করে শিক্ষার মর্যাদা রাখবে।
=======
সরকারের সায় পেল ‘স্কুল মিল নীতি’এখন চুরিদারি না হইলেই হয়!
( সারাদেশে সব প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেড় কোটি শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে দুপুরের খাবার সরবরাহে একটি নীতির খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।)