এত ব্যস্ততাতেও মিন্টু ভুলিনি- ভোরের শিশির ভেজা বেলির হাসি, বাগানবিলাসীর রাত্রিজাগা ভালোবাসা, কারেরীর আয়ত চোখের লাজুক আবেদন। শাহাবাগের আঙ্গিনায়, মোড় বৃত্তে যন্ত্র দানবগুলো ঘুৎ ঘুৎ করে অবিরত ঘুরছে। কারো ক্লান্তি নেই! অনুভূতি যেন ভোতা! অকারণে সবাই যেন ব্যস্ত! ভাবটা এমন – একটু দেরী হলেই স্বর্গ হাত ছাড়া হয়ে যাবে! পেট্রোল পোড়ার গন্ধে, ধূয়োর ধুম্রজালে- স্বর্গযাত্রীরা ভুলেই গেছে- স্বর্গ এই শহরে নয়; গ্রামে! নদীর তীরে, কাশবনে, আগুনলাগা উষায়, পাখির গানে, ঝরনার স্রোতে!
শাহবাগে ইউনিভার্সিটির বাস আসতে আরো সময় লাগবে! তাড়া নেই! সিগ্রেটের ধুয়োর স্রোতে সকল অবসাদ ভাসিয়ে দিতে মন চায়! এমন সময় দৃষ্টিতে পড়ে, চাপা কামিজ পরা ষোড়শী ফুলকন্যার হাসি। ফুলের মুহু মুহু সৌরভে নিয়ে সে ঘুরছে। এদিক ওদিক ঘুরছে, ফুল ফেরি করছে। মোড়ে পার্ক করা ‘টাউন সাভিস’ ড্রাইভারের ইশারায় ফুলকন্যা কাছে যায়। কতক্ষন ফিস ফিস আলাপ শেষে, ড্রাইভার হাক দেয়,
– আজ আইমু! রেডি থাকিস!
ফুলকন্যার ত্বকের মসৃণতা, টেনে চুলবাঁধার বাহার, অমায়িক হাসি; আর বাঁশপাতা কামিজে ভাঁজপড়া যৌবন মিন্টুকে এক জগত থেকে অন্যজগতে নিয়ে যায়! সংসারী হওয়ায় আবেগ জাগায়। ফুলকন্যা আর ড্রাইভারকে, কয়েরকবার এপাশ ওপাশ করে দেখে। সম্পর্কটা বুঝার চেষ্টা করে। ড্রাইভারকে কয়েকবার লুঙ্গি আওয়াতে দেখে ভিতরটায়, কেন যেন মুচড়ে উঠে! সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে! সকল ‘টাউন সার্ভিসে’ আগুণ দিতে মন চায়। মন চায় ময়লা নোটে তাবত ফুল কিনে নিতে! বন্ধি ফুলকন্যাকে মুক্ত করতে। ঘোমটা পড়িয়ে ঘরে তুলতে।
ইচ্ছা অঙ্কুরেই ব্যর্থ হয়! কল্পনা বেশী দূর এগোয় না! হৃদয় ক্লান্ত হয়ে যায়,
– হে ফুলকন্যা, তুমি আমার! তুমি যোগ্য! কিন্তু দুঃখিত- তোমায় ঘরে তুলতে পারবো না! এ সমাজ মেনে নিবে না! তুমি যে দ্ররিদ্র! আমি তো ধনীর দুলাল! আমি তো ধনীগিরি শোষন-শাসনকে দুধেভাতে লালন করি!
একটু বেশী মনযোগী হতেই, মিন্টু ফুলকন্যার নগ্ন পায়ের দিকে নজর পড়ে! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহপাঠি বলে,
– কি দেখ? ঐ মাইডা কিন্তু খারাপ, জলবেশ্যা! দিনে ফুল বেছে আর রাইতে ফুল ফুটায়! হা হা হা…
– ক্যামনে বুঝলা?
– ওর খালি পা দেইখ্যা! এরা ইচ্ছা করেই সেন্ডেল পড়ে না! যারা এই লাইনের, তারা বুঝে যায়!
মেয়েটা কয়েকবার তাকিয়ে মিন্টুর মনোযোগ নেয়ার চেষ্টা করে! ব্যার্থ হয়ে রাস্তার ওপারে চলে যায়। হৃদয়ে ভালোবাসা আর আত্নকেন্দ্রিকতা ঝগড়া উঠে!
– এত সুন্দরী মেয়ে! এ পথে কেন?
ফুলকন্যার বিদায়ের সাথে সাথে বুক থেকে বিদায় নেয় ক্ষনিকের ভালোবাসা। মিলিয়ে যায় নেকড়ের সঙ্গে ফুলওয়ালীর হাসির জটিলতার প্রশ্ন। কল্পনায় ভেসে উঠে, গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আরেক পছন্দ কাবেরীর হাসিমুখ!
– ধনীর দুলালি কারেরী কি আমাকে গ্রহন করবে? দুনিয়াটা বড়ই জটিল! সব মানুষই নিজের চেয়ে ধনী, নিজের চেয়ে বড় মানুষের সঙ্গে আত্নীয়তা করতে চায়!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১০ই জানুয়ারী, ১৯৯৪