ব্রাজিল যাত্রা
 
২০০০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ছিল আমার বিদেশযাত্রার বছর। এমনও দিন গেছে, প্রতিমাসে কয়েকবার বিদেশ যেতে হয়েছে, যতনা কাজের কারণে – তার চেয়ে বেশী ছিল ফুটাঙ্গি দেখানোর জন‍্য।
 
নিজের টাকা তেমন লাগেনি। গরীব দেশের মিডিয়া, অধিকার ও উন্নয়নকর্মী হওয়ার কারণে দাওয়াতের সঙ্গে টিকেট, হোটেল বুকিং আর ছোট লেকচারের বিনিময়ে ডলারও পেয়ে যেতাম। বিষয়টা বেশ ভালোই লাগতো। নিজেকে এলিট এলিট মনে হতো!
 
প্রায় ২০টি দেশে অহরহ ভ্রমনের মাঝে ব্রাজিল যাত্রা ছিল আমার সবচেয়ে দীর্ঘপথের ভ্রমন। বাংলারাইটস্ / দৃকের প্রতিনিধি হিসাবে ২০০৩ ব্রাজিল গিয়েছিলাম, ১১ দিনের এক আন্তর্জাতিক কলোকিয়ামে যোগ দিতে। ঢাকা-দিল্লী-লন্ডন-সাওপাওলো, এই দীর্ঘপথ যেতে প্রায় ২ দিন লেগেছিল। গোলার্ধে বাংলাদেশের প্রায় বিপরীতের ব্রাজিলের অবস্থান ( প্রকৃতপক্ষে চিলি)! সময়ের ব‍্যবধান, বৃটিশ এয়ারলাইন্সে বিয়ার-ওয়ানের গন্ধ, ঘুমন্ত সব যাত্রীর মাঝে নিঘুম থাকার বেদনা, টানা বসে থাকতে থাকতে কোমড়ের ব‍্যাথা আজো মনে পীড়া দেয়। ঢাকায় এসে কানে ধরে ছিলাম, আর বিদেশ যামু না! কিন্তু কাজ আর বিনা-পয়সায় পাঁচতার হোটেলো থাকার লোভ সামলাতে পারিনি!
 
লন্ডন থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ির পর যখন সাওপাওলে এয়ারপোর্টে নামলাম; একদল সুন্দরী অধিকারকর্মী আমাদেরকে সম্বধর্না দিতে এগিয়ে আসলো। আমরা ১৯২ জন আন্তজাতিক একটিভিষ্ট ছিলাম! একে একে সবার পরিচয় জানছে, এমব্রেস করছে ও হালকা চুমুও দিচ্ছে। আমার পালা আসতেই আমি টেনশনে প্রায় পড়ে গেলাম। নারীর নরম বুকের প্রথম ছোঁয়ায় আমার লাজে যেন জান যায়।
 
তখনও বিয়ে করেনি। বিয়ে ছাড়া নারী-পুরুষের সঙ্গ আমার কাছে অকল্পনীয়। আয়োজক ‘অ‍্যানিসান’ বুঝে ফেললো, আমি ফ্রি কালচারে অভ‍্যস্থ নয় । জিজ্ঞাসা করলো –
– বাংলাদেশে কি মুসলিম দেশ?
আমি মুচকি হাসলাম!
 
এরপর থেকে আমার কাছে, খাবার সহ সব কিছুই না চাইলেও হালাল ফ্লিলটার হয়ে আসতো। তারপরও সানপাওলো বিশ্ববিদ‍্যালয়ের দামাল ছেলে-মেয়েরা মানতো না । ওয়ান পান না করলেও প্রতিরাত্রে ২০ ডলার করে চাঁদা দিতে হতো।
 
সবচেয়ে অবাক লেগেছিল গভীর রাত্রে যখন ‘রিও ডি জেনারিও’ থেকে আগত এক সুন্দরী অধিকার কর্মী হোটেলের লবিতে দীর্ঘ রসালো আলাপের শেষে বললো,
– আজ, আমি তোমার রুমে রাতে থাকতে চাই!
 
একজন নারী আমার সঙ্গে রাত্রি যাপন করবে, শুনেতেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সবেমাত্র মিসুজু সানের সঙ্গে বিবাহ রেজিষ্টেশন হয়েছে, কয়েক দিন পরে সংসার শুরু করবো। এখন যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে তো বারোটা বেজে যাবে! মিসুজু সান না হয় শুনলো না, ‘নিত‍্য’ তো সবই দেখবে। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হয়ে গেলাম। আমি বললাম,
– তুমি বস, আমি রুম থেকে আসছি।
 
আমি সেইযে রুমে গেলাম আর নীচে নামিনি!
 
সকাল হওযার আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। হোটেলের জানালা থেকে দেখি, সারা আকাশ যেন স্বগীয়, পবিত্রার হাসিতে হাসছে। চারদিক অপরুপ আলোতে আলোকিত। বুঝলাম – সতিত্ব রক্ষার পুরুস্কারে তাঁর দেখা মিলেছে।
 
সেদিন যে আকাশ আমি দেখেছি, তা আজো দেখিনি। সকালে নাস্তার টেবিলে সুন্দরী আমাকে দেখে বললো,
– তুমি তো আর আসলে না । পরে অন‍্য বন্ধুর সাথে ঘুমিয়েছি।
আমি বললাম,
– দুঃখিত, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
 
—————
বি.দ্রঃ দীর্ঘদিন উন্নয়ন-ভ্রমনে নীরবতার পরও, মাল্টিমিডিয়ায় উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার কারণে – আমার কাছে এখনও প্রায়শঃ নিমন্ত্রণ আসে । আমি নিজে না গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব‍্যক্তি ও সংঘঠনকে ফরওয়ার্ড করে দেই।
 
২০১১ সালে সর্বশেষ থাই যাত্রার পর উন্নয়ন ভ্রমন ইস্তিফা দিয়েছি। ব‍্যংকক থেকে ‘ড্রাগন ফল’ নিয়ে এসেছি। সবাই আনন্দ করে খাবো! এসে থেকে সারা বাড়ীতে কান্নাররোল! বউয়ের দেখাদেখি ছেলে-মেয়ে দুটোই কাঁদছে! অনেকে অনুরোধের পর বউ কান্না থামিয়ে ফুপাতে ফুপাতে বলল,
– আপনি তো এনজিও’র লোক না। এনজিও সংক্রান্ত কোন ইনভাইটেশন আসলে, অযথা আপনি যাবেন না। এটা বাংলাদেশের জন‍্য আসে। সবাই বাংলাদেশকে ভালোবেসে ডেনেশনটা দেয়, যাতে বাংলাদেশ উন্নত হয়! আপনার আনন্দ-ফূর্তির জন‍্য না! অন‍্যরা, যারা সরাসরি মানুষের সঙ্গে কাজ করে তারা গেলে – বাংলাদেশের অনেক বেশী উপকার হবে। অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে। বিদেশ যেতে মন চাইলে নিজের টাকা দিয়ে যাবেন, টুরিজম করবেন। খরচের কষ্ট থাকলেও আনন্দ পাবেন।…
 
সেই নাকে খতের পর যে কয়েকবার বিদেশ ভ্রমন হয়েছে, সবই নিজের টাকায়! প্রথম প্রথম সর্বশান্ত মনে হলেও এখন গা সয়ে গেছে। মনেহয় এটাই স্বাভাবিক।
 
সত‍্যিই, নিজে বিদেশ না গিয়ে, অন‍্যকে ফরওয়ার্ড করে দিলে আরও বেশী আনন্দ লাগে। বন্ধুদের কাছ থেকে যখন ধন‍্যবাদ ইমেইল পাই, হাসোজ্জ্বল মুখ দেখি আনন্দের সীমা থাকে না।
August 5, 2017